শুরু তরুণ প্রজন্মের দাপট! যশস্বী, শুভমনে বিলেতে সিরিজ়ের শুভ সূচনা, প্রথম দিনে ভাল জায়গায় ভারত

তরুণ দল, অকুতোভয়। ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ়‌ শুরুর আগে এ ভাবেই বর্ণনা করা হচ্ছিল ভারতীয় দলকে। লিডসে প্রথম দিনের পর বলা যায়, নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করেছেন ভারতীয় ব্যাটারেরা। অতীতে কবে সিরিজ়ের প্রথম দিনে ভারতের দুই ব্যাটার শতরান করেছেন তা জানতে গেলে মাথা চুলকোতে হবে। প্রথম টেস্টের প্রথম দিনের শেষে ভারতের স্কোর ৩৫৯/৩। ক্রিজ়ে রয়েছেন শুভমন গিল (১২৭) এবং ঋষভ পন্থ (৬৫)। ইংল্যান্ডে কোনও টেস্টের প্রথম দিনে এটাই ভারতের সর্বোচ্চ রান।

অধিনায়ক হিসাবে শুভমন জীবনের প্রথম টস হেরে যাওয়ার পর রবি শাস্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন, ‘ইটস্ এ গুড টস টু লুজ়’। অর্থাৎ, এই টস হেরে গিয়ে ভালই হয়েছে। কারণ ইংরেজ অধিনায়ক বেন স্টোকস বল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মাথার উপর গনগনে রোদ এবং আবহাওয়া গরম থাকায় বিলেতেও ভারতীয় পরিবেশ পেয়ে গিয়েছিলেন শুভমনেরা। অ্যালিস্টার কুকও বলছিলেন, “এই পরিবেশে ভারতকে অলআউট করতে না পারলে সারা দিন বল করে যেতে হবে।” সেটাই হল। উইকেট পড়লেও ভারতীয় ক্রিকেটারেরা খেলা বদলাননি। একই রকম মানসিকতা নিয়ে খেলেছেন।

আইপিএল খুব একটা ভাল যায়নি। ইংল্যান্ডে গিয়ে প্রস্তুতি ম্যাচেও রান পাননি। আসল ম্যাচে নামতেই অন্য রূপে দেখা গেল যশস্বীকে। গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে প্রথম টেস্টেই শতরান হাঁকিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডেও তার ব্যতিক্রম হল না। ক্রিকেটের ব্যাটিংয়ের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক দু’টি দেশেই শতরান হয়ে গেল। তার আগে ওয়েস্ট ইন্ডিজ়‌ সফরেও প্রথম টেস্টে শতরান করেছিলেন। এ দিন যশস্বী যে ইনিংসটি খেললেন তাতে ছিল শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ এবং নিয়ন্ত্রণ।

অফস্টাম্পের বাইরে বল করে তাঁকে ক্রমাগত প্রলোভন দেখিয়েছেন ইংরেজরা। কোনওটিতেই পা দেননি তিনি। মারার বল মেরেছেন। ধরার বল ধরে খেলেছেন। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ২৯.৫ শতাংশ ‘ফল্‌স শট’ খেলেছেন তিনি। অর্থাৎ মারতে গিয়েছেন, কিন্তু ব্যাটে-বলে হয়নি। ইংরেজ বোলারদের বিভ্রান্ত করতে এটাই ছিল যশস্বীর কৌশল। শতরানের থেকে ৯ রান দূরে থাকার সময় আচমকাই পা এবং হাতের পেশিতে টান ধরে। ডান হাতের আঙুল মুড়ে যাচ্ছিল। সেটা সামলেও শতরান করেন। কার্সের বল পয়েন্টে ঠেলে এক রান নেওয়ার পর হেলমেট খুলে যে লাফটা মারলেন, ওটাই অনেক জবাব দিয়ে গেল।

ইংল্যান্ডের পিচ যেমনই হোক, প্রথম এক ঘণ্টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সব দলই চায় এই সময় উইকেট না হারাতে। ভারত ঠিক সেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই খেলা শুরু করেছিল। দুই ওপেনার যশস্বী এবং কেএল রাহুল কোনও রকম ঝুঁকির রাস্তায় হাঁটেননি। অফস্টাম্পের বাইরে লোভ দেখানো বল ছেড়ে দিচ্ছিলেন। দু’-এক বার শরীরেও আঘাত খেতে দেখা গেল। দু’জনে ভালই এগোচ্ছিলেন। ২০১৩ সালের পর প্রথম বার লিডসে কোনও বিদেশি ওপেনিং জুটি ৫০ পার করেন।

যশস্বীর থেকে রাহুলকে ভাল ছন্দে দেখাচ্ছিল। স্টোকসকে পর পর দু’টি চার মারেন। কভার অঞ্চলের উপর দিয়ে ভাল শট খেলছিলেন। সেই শটই বিপদ ডেকে আনল। ব্রাইডন কার্সের একটি বল কভার দিয়ে পাঠাতে গিয়ে খোঁচা দিলেন। বল জমা পড়ে স্লিপে জো রুটের হাতে।

সাই সুদর্শন হেঁটে আসার সময় হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করছিলেন সতীর্থেরা। আইপিএলে প্রচুর রান এবং অফুরান আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে নেমেছিলেন তিনি। কিন্তু ক্রিজ়‌ে তাঁর স্থায়ীত্ব হল মাত্র চার বল। তিনটি বল খেলার পরেই রান করার জন্য অহেতুক তাড়াহুড়ো করতে দেখা যাচ্ছিল তাঁকে। ইংল্যান্ড শুরু থেকেই সুদর্শনের পায়ে বল করছিল। লেগসাইডের বাইরে করা স্টোকসের একটি বল সুদর্শনের ব্যাট ছুঁয়ে জমা পড়ল উইকেটরক্ষক জেমি স্মিথের হাতে। সুদর্শন হয়তো বুঝতে পেরেছেন, এটা টি-টোয়েন্টি নয়। লাল বলের ক্রিকেটে স্থায়ীত্ব এবং সংযমই হল আসল গুণ।

বিরাট কোহলির পছন্দের চার নম্বর জায়গায় নেমেছিলেন শুভমন গিল। ব্যাটিংয়ের ভারই নয়, অধিনায়কত্বের বোঝা নিয়ে নামতে হয়েছিল তাঁকে। প্রথম দিন শুভমন যা খেললেন, যে মানসিকতা দেখালেন, তাতে বোঝা গেল সঠিক লোকের হাতে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এই শুভমন নেতৃত্বের ভারে নুইয়ে পড়ার মতো ক্রিকেটার নন। বরং দায়িত্ববোধ তাঁকে আরও ক্ষুধার্ত, পরিণত করে তুলেছে। গুজরাত টাইটান্সের হয়ে আইপিএলে সেটা দেখা গিয়েছে। এ বার ভারতীয় দলের হয়েও সেটা দেখা গেল।

ইংল্যান্ডে এর আগে চারটি টেস্টে মোট ৮৮ রান করেছিলেন শুভমন। শুক্রবার প্রথম ইনিংসেই শতরান করলেন। তুলনা করা যেতে পারে কোহলির সঙ্গেই। ২০১৪ সালে এই ইংল্যান্ড সফরে এসেই পাঁচটি টেস্টে কোহলির রান ছিল ১৩৪। ২০১৮ সালের সফরে প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেই করেছিলেন ১৪৯। মাঝের চারটে বছর ক্রিকেটার হিসাবে অনেকটা পরিণত করেছিল কোহলিকে। সেই সিরিজ়‌ের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও হয়েছিলেন কোহলি। পরামর্শ নিয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকরের। শুভমনকে অবশ্য সচিনের কাছে যেতে হয়নি। কিন্তু সচিনের প্রশংসা পেয়েছিলেন টেস্ট শুরুর আগে। নিজের মানসিকতা বদলে নেওয়ারই ফল পেলেন শুভমন।

যশস্বী, শুভমনদের দাপটে আড়ালে চলে যেতে পারে ঋষভ পন্থের কথা। তবে আইপিএলে ব্যর্থ পন্থ বোঝালেন, লাল বলের ক্রিকেটে তিনি আলাদা জাতের ব্যাটার। স্টোকসকে এগিয়ে এসে মাথার উপর দিয়ে যে চারটা মারলেন তা দেখে তাজ্জব হয়ে গেল গোটা স্টেডিয়াম। পরিচিত কায়দায় স্টোকস চাইছিলেন পন্থকে স্লেজিং করতে। পাত্তাই দিলেন না ভারতের উইকেটকিপার। অর্ধশতরান করলেন। এই সিরিজ়ে তাঁরও যে অনেক কিছু প্রমাণ করার রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.