এয়ার ইন্ডিয়া বিমানের লেজও আতশকাচের নীচে! বৈদ্যুতিক গোলযোগের জেরেই কি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জ্বালানি সুইচ?

বিমানের লেজেই কি রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে রয়েছে?

রানওয়ে ছেড়ে আকাশে উড়তে শুরু করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জ্বালানি সুইচ। তাতে বিকল হয়ে গিয়েছিল অহমদাবাদের এয়ার ইন্ডিয়া ১৭১ বিমানের দু’টি ইঞ্জিন। এর জেরেই দুর্ঘটনা বলে প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে জানা গিয়েছে। কিন্তু জ্বালানি সুইচ বন্ধ হল কী করে, তা নিয়ে এখনও ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে। উত্তর খুঁজতে বিমানের লেজকে আতশকাচের তলায় রেখেছেন তদন্তকারীরা। বিমানের লেজে বৈদ্যুতিক গোলযোগের জেরেই কি কোনও ভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল জ্বালানি সুইচ? তার থেকেই ওই দুর্ঘটনা? এই প্রশ্নের উত্তরেরই খোঁজ চলছে।

এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি ভেঙে পড়ার পর বিস্ফোরণে সামনের এবং মাঝের অংশ পুড়ে গেলেও তাতে লেজের অংশটি অক্ষতই ছিল। তবে একেবারেই যে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, তা নয়। অহমদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত করছে এয়ারক্রাফট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি)। সংবাদপত্র ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, তদন্ত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল আধিকারিকদের একাংশ জানিয়েছেন, বিমানের লেজেও আগুন লেগেছিল। তাতে পুড়েও গিয়েছিল কিছু জিনিস। কিন্তু ওই আগুন বিশেষ ছড়ায়নি। নিজে থেকেই তা নিবে গিয়েছিল। লেজে যে সব যন্ত্রপাতি থাকে, সে সবই উদ্ধার করা হয়েছে। এখন তা খতিয়েও দেখা হচ্ছে। এক আধিকারিক বলেন, ‘‘ওড়ার সময় কোনও গোলযোগের কারণে বিমানে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল কি না, তা লেজে থাকা যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে।’’

বিমানে দু’টি ব্ল্যাক বক্স থাকে। একটিতে চালকদের কথোপকথন রেকর্ড হয়। অন্যটিতে উড়ান সম্পর্কিত তথ্য। এই দ্বিতীয় ব্ল্যাক বক্সটি বিমানের লেজে থাকে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানটি যে বহুতলে ভেঙে পড়েছিল, তার ছাদ থেকে দ্বিতীয় ব্ল্যাক বক্সটি উদ্ধার করেছিলেন তদন্তকারীরা। প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, তা থেকে সেই ভাবে তথ্য উদ্ধার সম্ভব হয়নি। কারণ, সেটি পুড়ে গিয়েছিল।

লেজে ওই ব্ল্যাক বক্স ছাড়াও বিমানের ‘এপিইউ’ (অগজ়িলিয়ারি পাওয়ার ইউনিট) থাকে। ‘এপিইউ’ হল এক ধরনের ইঞ্জিন, যেখান থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়। কোনও ভাবে বিদ্যুৎসংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে, এপিইউ-ই তা জোগান দেয়। সরকারি আধিকারিকেরা সংবাদপত্রকে জানিয়েছেন, ওই এপিইউ অক্ষত অবস্থাতেই পাওয়া গিয়েছে। এ ছাড়াও বিমানের ‘ট্রান্সডিউসার্স’ (এক ধরনের সেন্সর— কোনও গোলযোগ হয়েছে কি না, তা এতে ধরা পড়ে) এবং ‘রাডার্স’ (বিমানের নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থায় গন্ডগোল রয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করে এই যন্ত্র) থাকে। তদন্তকারীরা এ সব যন্ত্রই পরীক্ষা করছেন। তাঁরা বোঝার চেষ্টা করছেন, উড়ানের সময়েই কোনও ভাবে শর্ট সার্কিট হয়ে লেজে আগুন লেগেছিল, না কি বিমানটি ভেঙে পড়ার পর বিস্ফোরণের সময়ে যা ঘটার ঘটেছে।

যদি প্রথম সম্ভাবনাই সত্যি হয়, সে ক্ষেত্রে জ্বালানি সুইচ বন্ধ হয়ে যাওয়ার উত্তরও মিলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। প্রসঙ্গত, এএআইবি ১৫ পাতার যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল, তাতে দুর্ঘটনার মুহূর্তে ককপিটে দুই পাইলটের মধ্যে কী কথা হয়েছে, তার উল্লেখ রয়েছে। সেখানে এক পাইলট বলছেন, ‘‘কেন তুমি বন্ধ (জ্বালানি সুইচ) করে দিলে?’’ জবাবে আর এক জন বলছেন, ‘‘আমি কিছু বন্ধ করিনি।’’ বিমান বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, কোনও সুস্থ, স্বাভাবিক চালক ওড়ার সময় কখনওই ওই জ্বালানি সুইচ বন্ধ করে দেবেন না। এটা সম্ভব নয়। তা ছাড়া ভুল করেও জ্বালানি সুইচের অবস্থান বদল সম্ভব নয়। তার একটা পদ্ধতি রয়েছে। এক সেকেন্ডের মধ্যে দু’টি সুইচ বন্ধ করা অসম্ভব। ফলে বিমানের লেজে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই তা ঘটেছে কি না, তা-ই বোঝার চেষ্টা করছেন তদন্তকারীরা।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে এক সরকারি আধিকারিক জানান, আকাশে ওড়ার আগেই যদি বিমানের বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় কোনও গোলযোগ হয়, তা হলে বিমানের সব ক’টি সেন্সরেই তার প্রভাব পড়তে পারে। আর সেন্সর সঠিক ভাবে কাজ না করলে, তা ভুলভাল তথ্য দেবে বিমানের ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা (ইসিইউ)-কে। সহজ ভাবে বললে, ইসিইউ হল ইঞ্জিন ব্যবস্থার মস্তিষ্ক। এর কাজই হল বিভিন্ন সেন্সর থেকে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তার ভিত্তিতে ইঞ্জিনের কার্যকারিতা এবং জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখা।

বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় গোলযোগ দেখা দিলে বিমানের সেন্সর কখনওই সঠিক তথ্য দিতে পারবে না। ফলে ইসিইউ মনে করবে, নিশ্চয়ই কোনও সমস্যা দেখা দিয়েছে। তখনই ইঞ্জিনে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেবে ইসিইউ। ফলে ইঞ্জিনও বন্ধ হয়ে যাবে এবং দুর্ঘটনা অবশ্যম্ভাবী।

ঘটনাচক্রে, অহমদাবাদের দুর্ঘটনায় বিমানের একমাত্র জীবিত আরোহী বিশ্বকুমার রমেশ তাঁর বয়ানে জানিয়েছিলেন যে, তিনি বিমানের ‘কেবিন লাইট’ বার বার জ্বলতে-নিবতে দেখেছিলেন, যা বিমানটি ওড়ার সময়ে বৈদ্যুতিক গোলযোগের সম্ভাবনার তত্ত্বকেই জোরালো করে তুলেছে। এ বার লেজের বাকি যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চাইছেন তদন্তকারীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.