মালগাড়ির গতিবেগই দায়ী! ইঙ্গিত রেলের, ফোন করে রাঙাপানির গেটম্যান ‘সতর্ক’ করেছিলেন বলে দাবি

লালমোহনবাবুর মতো শুরুতেই ‘অপরাধী’ কার্যত চিহ্নিত করে ফেলেছিল রেলের একাংশ। সিগন্যাল অমান্য করা হয়েছে বলে দাবি করে মালগাড়ির মৃত চালকের গাফিলতির দিকেই ইঙ্গিত করা হচ্ছিল। কিন্তু পরে সিগন্যাল না-মানার তত্ত্ব খারিজ হয়ে গিয়েছে। এ বার প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে রেলের দাবি, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী মালগাড়ির গতিবেগ! মালগাড়িটিকে দ্রুত গতিতে যেতে দেখে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাঙাপানির গেটম্যান ‘সতর্ক’ করেছিলেন বলে বুধবার দাবি করেছেন কাটিহার ডিভিশনের ডিআরএম সুরেন্দ্র কুমার।

ঘটনার পর তদন্ত শুরু করেছে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের মুখ্য সুরক্ষা কমিশনার (সিসিআরএস)। তাঁর প্রতিনিধি হিসাবেই বুধবার শিলিগুড়ির এডিআরএম অফিসে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন সুরেন্দ্র। তাঁর বক্তব্য, প্রাথমিক তদন্তে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে জানা যাচ্ছে, কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ‘কশন অর্ডার’ (এ ক্ষেত্রে ট্রেনচালককে রাঙাপানির স্টেশনমাস্টারের দেওয়া টি/এ ৩১২ ফর্ম) মেনেই চলছিল। পরবর্তী সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করছিল। অন্য দিকে, মালগাড়ির গতিবেগ বেশি ছিল। এখনও পর্যন্ত যা নথি জমা পড়েছে এবং ঘটনাস্থল থেকে রাঙাপানি স্টেশন পর্যন্ত যা তথ্য পাওয়া গিয়েছে, তাতে প্রাথমিক ভাবে এটাই মনে করা হচ্ছে, মালগাড়ির গতিবেগ কশন অর্ডারের তুলনায় যথেষ্ট বেশি ছিল। তবে ডিআরএম বলেন, ‘‘এখনই কোনও তথ্যে সিলমোহর বসাচ্ছে না রেল। সবটাই প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে অনুমান। বুধবার সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত ১০ জনের বয়ান লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। অন্তত ৩০ জনকে তলব করা হয়েছে। তাঁদেরও বয়ান লিপিবদ্ধ করা হবে এবং একের সঙ্গে অন্যের বয়ান মিলিয়ে দেখা হবে।’’

বস্তুত দুর্ঘটনায় মালগাড়ির গতিবেগ কত ছিল, তা নিয়ে শুরু থেকেই মতভেদ রয়েছে। একটি সূত্রের মতে, দুর্ঘটনার এক কিলোমিটার আগে এক গেটম্যানের বয়ান অনুযায়ী, মালগাড়িটির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৪০-৫০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। আর একটি সূত্র দাবি করে, দুর্ঘটনার সময় মালগাড়ির গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার। যদি তা-ই হয়, তা হলে তার চালককে গতি নিয়ে কেন সতর্ক করা হয়নি, সেই প্রশ্ন শুরু থেকেই উঠেছে। গেটম্যানের ভূমিকাও প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। কিছু ক্ষণ আগেই ওই লাইন দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা গিয়েছে। ঠিক তার পরেই দ্রুত গতিতে মালগাড়ির যাওয়ার কথা কি গেটম্যান আদৌ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলেন, সেই প্রশ্ন তুলেছিলেন অনেকেই। ডিআরএম দাবি করলেন, গেটম্যান বয়ান দিয়েছেন, রেলের টেলিফোন লাইন ব্যবহার করে মালগাড়ির গতিবেগের কথা তিনি জানিয়েছিলেন। তাঁর সেই বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে। তবে গেটম্যান যা দাবি করেছেন, তা যাচাই করা হবে। পরীক্ষা করা হবে টেলিফোনটি। সুরেন্দ্র বলেন, ‘‘এটা নিয়ে এর বেশি কিছু বলতে পারব না। সেই নির্দেশ নেই। তা হলে তদন্তে বিঘ্ন ঘটতে পারে।’’

রেলকর্মীদের একাংশের দাবি, গেটম্যান যদি সত্যিই মালগাড়ির গতিবেগ নিয়ে কাউকে সতর্ক করে থাকেন, তা হলে সেই ব্যক্তিটি স্টেশনমাস্টারই হওয়ার কথা। যদি তা-ই হয়, তিনি কি মালগাড়ির গার্ডকে গতিবেগ কমানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন? আপাতত যা উঠে এসেছে, তা থেকে কার্যত স্পষ্ট, সিগন্যাল বিভাগ, অপারেটিং বিভাগ ও রাঙাপানি স্টেশনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। রেল মনে করছে, মালগাড়িটির সহকারী চালক ও গার্ডকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই গোটা রহস্যের জট কাটবে। বুধবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সহকারী চালক মনু কুমারকে দেখেও এসেছেন সুরেন্দ্র। তিনি বলেন, ‘‘আমি নিজে গিয়েছিলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানান, উনি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। খুব প্রয়োজনে বাড়ির লোক বা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলছেন। বাকিদের সঙ্গে বলছেন না।’’

রেল কর্তৃপক্ষ মালগাড়ির গতিবেগকে প্রাথমিক ভাবে দায়ী করলেও রেলকর্মীদের একাংশের বক্তব্য, রাঙাপানির স্টেশনমাস্টার সিগন্যাল সংক্রান্ত যে ‘অনুমতিপত্র’ দিয়েছিলেন, সেই ‘টি/এ ৯১২’ ফর্মে ট্রেনের গতিবেগ নিয়ে কোনও নির্দেশ লেখা ছিল না। আরও এক ধাপ এগিয়ে তাঁদের মত, এ ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ ছিল। তাই ‘টি/এ ৯১২’ ফর্ম দেওয়াই ঠিক হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে দিতে হত ‘টি/ডি ৯১২’ ফর্ম। ওই ফর্মে লেখা থাকে, কোন কোন সিগন্যাল খারাপ, কোন কোন সিগন্যাল লাল থাকা সত্ত্বেও চালক তা উপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতে পারেন। একই সঙ্গে ওই ফর্মে লেখা থাকে, ‘অ্যাবসলিউট ব্লক সিস্টেম’-এর কথা। যখন স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল ব্যবস্থা খারাপ থাকে এবং সেই ব্যবস্থা সাময়িক ভাবে বাতিল করে কাগুজে সিগন্যালের মাধ্যমে ট্রেন চালানো হয়, শুধু তাই নয়, দুই স্টেশনমাস্টারের মধ্যে একটি ‘প্রাইভেট নম্বর’ বিনিময় করে একটি লাইনে একই সময়ে দু’টি স্টেশনের মধ্যে কেবলমাত্র একটি ট্রেনই চালানো হয়, তাকেই বলা হয় ‘অ্যাবসলিউট ব্লক সিস্টেম’। এ ক্ষেত্রে ট্রেন সর্বাধিক ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার বেগে চালানো যায়। সেটাও নিশ্চিত করা হয় ওই ‘টি/ডি ৯১২’ ফর্মের মাধ্যমে। ওই রেলকর্মীদের আরও বক্তব্য, শুধুমাত্র ‘টি/এ ৯১২’ কোনও ভাবেই ‘অথরিটি টু প্রসিড’, অর্থাৎ ট্রেন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতিপত্র হতে পারে না। একমাত্র ‘টি/ডি ৯১২’ই সেই অনুমতিপত্র হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্টেশনমাস্টারের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সুরেন্দ্র বলেন, ‘‘আমাদের তদন্ত চলছে। সিআরএস সাহেব তদন্ত করছেন। প্রত্যেকের বয়ান রেকর্ড করা হচ্ছে। প্রত্যেকের বক্তব্যই যাচাই করা হবে। তার পরেই দুর্ঘটনার আসল কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে।’’

তবে তদন্ত শেষ হতে কত দিন সময় লাগবে, তা নিয়ে এখনই আগাম বার্তা দিতে চাননি ডিআরএম। তিনি বলেন, ‘‘আদৌ কত দিন সময় লাগবে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে, তা আগে থেকে বলা সম্ভব নয়। এর আগেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, মাসের পর মাস কেটে গিয়েছে তদন্তে। তবে যে সমস্ত প্রশ্ন উঠে আসছে প্রশিক্ষণ না-দেওয়া বা মালগাড়ির চালকের পর পর তিন দিন নাইট ডিউটি দেওয়া নিয়ে, তা সবটাই তদন্তসাপেক্ষ। চালকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণই দেওয়া হয়। যখনই কোনও দুর্ঘটনা ঘটে, তখনই প্রশিক্ষণের কথা উঠে আসে। শুধুমাত্র বয়ান নয়, স্পিডোমিটারে মালগাড়ির গতিবেগ কত ছিল, সেটাও দেখা হবে। অন্য দিকে, মালগাড়ির যে ইঞ্জিন রয়েছে, সেটাতেও টেকনিক্যাল ফরেনসিক তদন্ত হবে।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.