ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের ছায়া কলকাতায়! অনির্দিষ্ট কালের জন্য তালাবন্ধ তিন সিনাগগ

ঢুকে যে এলেন, জানেন এটা কী! সিঁড়ি দিয়ে উঠেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হল। কেন, কী এমন ভুল হল?

সেকেলে সাবেক ধাঁচের কাঠের চৌকিতে শুয়েছিলেন। এ বার উঠে বসলেন মধ্যবয়স্ক রক্ষী। খানিক ভার বাড়ল গলার স্বরে। আগন্তুকের দিকে ছুটে এল প্রশ্ন, ‘‘জানেন না কোথায় এসেছেন? এ তো ইহুদিদের জায়গা! ইহুদিদের দেশ কোথায়? সেখানে কী হচ্ছে জানেন তো?’’

যুদ্ধ হচ্ছে সুদূর ইজ়রায়েলে। তার কম্পন সামলাচ্ছে কলকাতার ধর্মস্থানও। এ শহরের সিনাগগ-পাড়া রীতিমতো তটস্থ।

Synagogues is Kolkata are closed for indefinite period as Israel-Palestine crisis is at peak

ব্যস্ত বড়বাজারের ব্যস্ততার মাঝেই শান্ত ধর্মস্থান। প্রায় শ্মশানের মতোই স্তব্ধ। আছেন বলতে শুধু এক জন দ্বাররক্ষী। বাকি সব সিসি ক্যামেরা। দরজা বন্ধ ‘নেভেহ্‌ শালোম’ সিনাগগের। সোমবার যে বন্ধ থাকে, এমন নয়। তবে এখন এমনই চলছে। চলবেও অনির্দিষ্ট কালের জন্য। অন্তত ২০ দিন হয়ে গেল সাধারণের জন্য দরজা খোলেনি ইহুদিদের এই ধর্মস্থান। সিনাগগের ভিতরে ঢুকতে চাইতেই ইজ়রায়েলের যুদ্ধের কথা বললেন রক্ষী। গলায় খানিক উৎকণ্ঠা। তবে যুদ্ধের জন্য নয়। প্রশাসনের ভয়ে। অচেনা কারও সঙ্গে বিশেষ কথা বলা বারণ। সংবাদমাধ্যম হলে তো নৈব নৈব চ! নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক সেই ব্যক্তি বললেন, ‘‘এখানে রোজ পুলিশ আসে। শুনেছি, লালবাজার নির্দেশ দিয়েছে, এই চার্চ এখন খোলা যাবে না। ওরা বললে তবেই খোলা যাবে।’’

প্রার্থনাও করা যাবে না? প্রৌঢ় এ বার পাল্টা প্রশ্ন করেন, ‘‘আপনি কি প্রার্থনা করবেন নাকি! প্রার্থনা যাঁদের করার, তাঁরা ঠিক সময়ে আসেন। কিছু ক্ষণের জন্য খোলা হয়। তার পর আবার দরজা বন্ধ।’’ ইহুদিদের ধর্মের সঙ্গে রক্ষীর কোনও সম্পর্ক নেই। নিজের ধর্ম তিনি বলতেও চান না। শুধু জানান, এখানে সাধারণত মুসলমান কর্মীরাই সিনাগগ দেখভালের দায়িত্ব সামলান।

Synagogues is Kolkata are closed for indefinite period as Israel-Palestine crisis is at peak

পাশাপাশি দু’টি সিনাগগ। অনেকটা বড় চত্বর। একটি গলিতে মূল প্রবেশদ্বার। সে চত্বরে ঢুকে পড়লেই দু’টি সিনাগগে ঢোকা যায়। কিন্তু বিবাদী বাগের ব্যস্ত অফিসপাড়া পেরিয়ে, ব্যবসায় গমগমে বড়বাজারের মাঝখানে লোহার গেটটির সামনে পৌঁছলেই পরিস্থিতি পুরো আলাদা। ব্যস্ততার লেশমাত্র নে‌ই। গেটের কাছে গিয়ে দেখা গেল, লোহার মোটা শিকল সাপের মতো আষ্টেপৃষ্টে আটকে রেখেছে কলকাতার ইহুদিদের প্রাচীন ধর্মস্থান ‘মেগন ডেভিড’ সিনাগগের প্রবেশদ্বার।

লাল-হলুদ রঙের প্রকাণ্ড স্থাপত্যের দিকে এগিয়ে যেতে গিয়েই বাধা হয়ে দাঁড়াল গেট। উর্দি পরিহিতা মহিলা দ্বাররক্ষী এগিয়ে এসে ইশারায় জানালেন, বন্ধ! বন্ধ কেন? কখন খুলবে? ছোট্ট বাক্যে মহিলার উত্তর, ‘‘জানি না কবে খুলবে। বন্ধ আছে। এখন বন্ধই থাকবে।’’

Synagogues is Kolkata are closed for indefinite period as Israel-Palestine crisis is at peak

কেন বন্ধ, সে উত্তর দেওয়ার জন্যও অপেক্ষা করেন না মহিলা। বড়বাজারের অলিগলি ধরে বাসনের স্টল, ঝুটো গয়নার পাইকারি দোকানির সম্ভার টপকে আর একটি সিঁড়ি। সেখান দিয়েই আলাদা করে ঢোকা যায় নভেহ্ শলোমে। দুপুরের বড়বাজার চত্বরে বিক্রিবাটার ভিড়। তাই সিঁড়ির নীচের সেই কোলাপসিব্‌ল গেট বন্ধ করা যায়নি। ফল অবশ্য সব ক্ষেত্রেই এক। সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেই গম্ভীর কাঠের দরজা। সেখানে ঝুলছে বড় তালা। রক্ষীর কড়া উত্তর, ‘‘একমাত্র বিদেশ থেকে কোনও ইহুদি পর্যটক এলে তালা খুলে দেখানোর নিয়ম। না হলে বন্ধ রাখতে হবে।’’ তাঁরা শুনেছেন, ইজ়রায়েলে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দিল্লি থেকে এমনই নির্দেশ এসেছে। ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধের প্রভাবে ইহুদি আর মুসলিমদের পারস্পরিক সম্পর্কে তাপ বাড়তেই প্রশাসন সতর্ক হয়েছে বলে মনে করছেন সিনাগগের আর এক কর্মী। ইজ়রায়েলের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে যথেষ্ট সতর্ক তাঁরা। এক জন বললেন, ‘‘এখানে অধিকাংশ কর্মীই মুসলিম। সিনাগগের ভিতরের কোয়ার্টার্সে থাকেন। তবে এখানে কাজ করা নিয়ে কারও কোনও সমস্যা নেই। সকলেরই বাড়ি ওড়িশায়। তাঁদের বাড়ির লোকজন এসেও মাঝেমধ্যে এখানে থাকেন।’’

তবে ধর্মস্থানে কর্ম যখন, ‘ধর্মযুদ্ধের’ প্রভাব তো পড়তেই পারে কাজে। তা নিয়ে তাঁরা বিস্মিত নন একটুও।

কলকাতা শহরে ইহুদিদের বাস বহুকালের। কয়েক শতকের। সেই কোম্পানির আমলেরও আগের কথা। ১৯৪৮ সালে ইজ়রায়েল তৈরির পরে একাংশ সে দেশে পাড়ি দেয়। কেউ কেউ আমেরিকা, কানাডাতেও পরে চলে যান। তবে বেশ কিছু ইহুদি পরিবার থেকেও যায়। কখনও বাকি শহরের সঙ্গে বিশেষ মিলে যায়নি এই জনগোষ্ঠী। তবে কলকাতার জনপ্রিয়তম কেকের দোকানটি এক ইহুদি পরিবারের হাতেই তৈরি হয়। ঠিক যেমন আর্মেনিয়ান, চিনারা নিজেদের নানা রকম ধর্ম ও জীবনধারায় বিশ্বাস ধরে রেখেছেন, তেমন ইহুদিরাও থেকেছেন নিজেদের স্বজন নিয়ে, নিজের মতো করে। তাঁদের সব ক’টি সিনাগগই কয়েক শতক পুরনো।

এখন অবশ্য কলকাতা শহরে ইহুদিদের সংখ্যা হাতেগোনা। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারের নবপ্রজন্ম কলকাতা শহর ছেড়ে কাজের তাগিদে রওনা দিয়েছে অন্য কোথাও। যাঁরা এ শহরে আছেন, সকলেরই বয়স গড়পড়তা ৭০। বড়বাজার চত্বরে এই দুই সিনাগগ ছাড়াও শহরে আছে ‘বেথ এল’ সিনাগগ। গত কয়েক দিন ধরে সেখানেও তালা পড়েছে। একটি সিনাগগের রক্ষী বললেন, ‘‘এ পাড়ায় অন্য ধর্মের চার্চ সব খোলা। আমাদের এই তিনটে জায়গা শুধু বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কে জানে কবে খুলবে!’’

তবে প্রতি শুক্রবার এখনও বিকেল ৪টের পর দরজা খোলে, মোমবাতি জ্বলে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা আসেন ভগবানের ঘরে। কিছু ক্ষণের জন্য প্রাণ পায় সব সিনাগগ। বাকি ক’দিন চলে যুদ্ধ থামার অপেক্ষা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.