স্পিকার নির্বাচনে শাসক ও বিরোধী ঐকমত্য অধরাই, সংঘাতে শুরু সংসদ, চার যুগ পরে ভোট বুধবার

দেশ চালাতে ঐকমত্য জরুরি। তাই তিনি সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলতে চান। সোমবার নতুন লোকসভার প্রথম অধিবেশনের প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এমনটাই দাবি করেছিলেন। কিন্তু আজ তাঁর সরকার লোকসভার স্পিকার পদ নিয়ে বিরোধীদের সঙ্গে ঐকমত্য তৈরি করতে পারল না। ঐকমত্যের বদলে তৃতীয় মোদী সরকারের শুরুতেই সংসদে শাসক বনাম বিরোধী শিবিরের সংঘাতের নান্দীমুখ হয়ে গেল।

সাধারণত ঐকমত্যের ভিত্তিতেই লোকসভার স্পিকার নির্বাচন হয়ে থাকে। কংগ্রেস-সহ বিরোধী শিবিরের শর্ত ছিল, তাঁরা বিজেপির স্পিকার প্রার্থীকে সমর্থন করতে তৈরি। তবে প্রথা মেনে ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধীদের ছেড়ে দিতে হবে। সংবিধানে বলা থাকলেও গত পাঁচ বছরে লোকসভায় ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ করা হয়নি। এবার ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ করা হবে এবং সেই পদটি বিরোধীদের ছেড়ে দেওয়া হবে— মোদী সরকার এমন কোনও আশ্বাস দিতেও রাজি হয়নি। ফলে বিরোধী শিবির পাল্টা প্রার্থী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

ফলে প্রায় ৪৮ বছর বাদে বুধবার লোকসভার স্পিকার পদে শাসক বনাম বিরোধী জোটের লড়াই হতে চলেছে। এনডিএ-র প্রার্থী প্রত্যাশিত ভাবেই ওম বিড়লা। যিনি গত লোকসভাতেও স্পিকার ছিলেন। গত বছর শীতকালীন অধিবেশনে একই সঙ্গে ১০০ জনের বেশি সাংসদকে সাসপেন্ড করে রেকর্ড করেছিলেন বিড়লা। তাঁর বিরুদ্ধে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া-র প্রার্থী হচ্ছেন কংগ্রেসের আট বারের সাংসদ, কেরলের দলিত নেতা কে সুরেশ। বুধবার বেলা ১১টায় লোকসভায় স্পিকার পদের নির্বাচন শুরু হবে। এই ভোটের জন্য কংগ্রেস ও বিজেপি হুইপ জারি করেছে।

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে মাত্র তিন বার স্পিকার পদে ভোটাভুটি হয়েছে। প্রথমবার ১৯৫২ সালে। দ্বিতীয়বার ১৯৬৭ সালে। তৃতীয়বার জরুরি অবস্থার পরে, ১৯৭৬ সালে। বিরোধীদের যুক্তি, নরেন্দ্র মোদীর জমানাতেও ‘অঘোষিত জরুরি অবস্থা’ ফিরে এসেছে। লোকসভার স্পিকার নির্বাচনেও ভোটাভুটির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদী মুখে ঐকমত্যের কথা বললেও নিজের ইচ্ছেই চাপিয়ে দিতে চাইছেন। কিন্তু বিরোধীরা এ বার বিনা যুদ্ধে সূচ্যগ্র মেদিনী ছাড়বে না। সংখ্যার জোরে ওম বিড়লার জয় নিশ্চিত। এমনিতেই ইন্ডিয়া জোটের ২৩৪ জন সাংসদের থেকে এনডিএ-র ২৯৩ জনের সাংসদ সংখ্যা অনেক বেশি। জগন্মোহন রেড্ডির ওয়াইএসআর কংগ্রেসের চার সাংসদও এনডিএ প্রার্থীকে সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু স্পিকার পদের নির্বাচনে ভোটাভুটি হতে চলায় মোদী সরকার অস্বস্তির মুখে পড়েছে। সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী কিরেণ রিজিজু বিরোধীদের ভোটাভুটির পথে না যাওয়ার আবেদন করেছেন। কিন্তু সরকার কেন বিরোধীদের ডেপুটি স্পিকারের পদ ছাড়তে চাইছে না, তার জবাব দেননি। এ জন্য নরেন্দ্র মোদীকে দায়ী করে রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রীর কথার কোনও অর্থ নেই। উনি বলেন যে ঐকমত্য হওয়া প্রয়োজন। বাইরে বলেন, সবাই মিলে কাজ করতে হবে। ভিতরে অন্য কিছু করেন।’’

মঙ্গলবার সকালেই রাহুল গান্ধী জানিয়ে দিয়েছিলেন, বিরোধী শিবিরের সবাই বিজেপির স্পিকার পদের প্রার্থীকে সমর্থন করতে তৈরি। তবে প্রথা মেনে ডেপুটি স্পিকারের পদ বিরোধীদের ছেড়ে দিতে হবে। মোদী সরকারের দূত হিসেবে রাজনাথ সিংহ বিরোধীদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনিই সোমবার রাতে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এম কে স্ট্যালিন, অখিলেশ যাদবের মতো বিরোধী দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। রাজনাথকে বিরোধীদের শর্তের কথা জানিয়ে দেন খড়্গে। রাজনাথ বলেন, তিনি আবার ফোন করে সরকারের অবস্থান জানাবেন। রাহুলের অভিযোগ, ‘‘সেই ফোন আর আসেনি।’’ এতে খড়্গেকে অপমান করা হয়েছে বলেও রাহুলের অভিযোগ।

এ দিন সংসদ ভবনে রাজনাথ সিংহ প্রথমে ডিএমকে-র টি আর বালুর সঙ্গে কথা বলে স্পিকার পদে সমর্থন চান। বালু কথা বলে বেরিয়ে আসার পরে ফের তাঁকে সঙ্গে নিয়ে কংগ্রেসের কে সি বেণুগোপাল রাজনাথের সঙ্গে কথা বলতে যান। বেণুগোপাল জানিয়ে দেন, বিরোধীদের ডেপুটি স্পিকারের পদ ছাড়ার আশ্বাস দিতে হবে। রাজনাথ কথা দিতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ডেপুটি স্পিকার পদ নিয়ে আলোচনা পরে হবে। বেণুগোপাল বেরিয়ে এসে বলেন, সরকার বিরোধীদের বোকা বানানোর চেষ্টা করছে। তত ক্ষণে এনডিএ-র প্রার্থী হিসেবে ওম বিড়লার মনোনয়ন জমা পড়ে গিয়েছে। তিনি নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গেও দেখা করেছেন। দেরি না করে কংগ্রেসের কে সুরেশের মনোনয়ন জমা দেওয়া হয়।

সংসদীয় বিষয়ক মন্ত্রী রিজিজু প্রশ্ন তোলেন, ‘‘বিরোধীরা কেন স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার পদের নির্বাচনকে এক করছে? দু’টি আলাদা বিষয়। ডেপুটি স্পিকারের প্রসঙ্গ পরে আসবে।’’ যদিও বিজেপি শিবিরের খবর, চলতি অধিবেশন দূরের কথা, জুলাই মাসে বাজেট অধিবেশনেও মোদী সরকারের ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ নিয়ে কোনও চিন্তাভাবনা নেই। মোদী সরকারের প্রথম পাঁচ বছরে এডিএমকে-র এম থাম্বিদুরাইকে ডেপুটি স্পিকার হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছর ডেপুটি স্পিকারের পদ খালি ছিল। এ বারের লোকসভাতে ডেপুটি স্পিকার নিয়োগ করা হবে, এমন কোনও নিশ্চয়তা নেই।

সংখ্যা বেশি থাকলেও স্পিকার পদে যত বেশি সম্ভব ভোটে জয় নিশ্চিত করতে অমিত শাহ শরিক দলগুলির সঙ্গে আলোচনা করে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছেন। বুধবার সকালেও ভোটাভুটিতে যাওয়ার আগে আবার বৈঠক হবে। উল্টো দিকে, রাহুল গান্ধীকে পাশে নিয়ে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.