নিজের মত করে পুজোয় খুশিতে থাকার চেষ্টা করছেন বৃদ্ধাবাসের আবাসিকরা

 কামারপুকুরের রবীন ভট্টাচার্য’র সঙ্গে এবার পুজোয় কলকাতার বৌবাজারের বকুল সরকারের একটা মিল রয়েছে। ক’মাস আগে দুজনেরই ঠিকানা বদলে গিয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে। তবে তাঁদের আক্ষেপ নেই এতে। ‘এই তো ভাল আছি’ গোছের মনোভাব।

কেবল কলকাতা নয়, গোটা রাজ্যে বাড়ছে বৃদ্ধাশ্রমের সংখ্যা। অনেকে এ নিয়ে অভিযোগ তুলে বলছেন, বাবা-মায়ের প্রতি আবশ্যিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হচ্ছে ছেলে-মেয়েরা। এর মূলে রয়েছে ভোগবাদী জীবন। অন্যদিকে ‘নবজীবন বৃদ্ধাশ্রম’-এর কর্তা সুকুমার রক্ষিতের দাবি, “অভিযোগটা মোটেই ঠিক নয়। বাড়িতে বয়স্কদের দেখাশোনার সমস্যাই এর মূল কারণ। অনেক পরিবারেই স্বামীর মত স্ত্রীরাও চাকরিসূত্রে অথবা উপার্জনের চেষ্টায় প্রতিদিন বার হন। দেখাশোনার জন্য বিশ্বস্ত লোক পাওয়া মুস্কিল। তাই বাড়ির বদলে বৃদ্ধাশ্রমে অনেক নিরাপদে থাকেন বয়স্করা।”

৭৭ বছরের রবীন ভট্টাচার্য কাজ করতেন বেসরকারি একটি সংস্থায়। তাঁকে ২৬ বাগবাজার স্ট্রিটের ‘নবজীবন বৃদ্ধাশ্রমে’-এ রেখে গিয়েছেন স্ত্রী ও কন্যা। বিবাহিতা কন্যা থাকেন বাগুইআটিতে। স্ত্রী আছেন ওখানেই। আবার স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হওয়ার পর অবিবাহিতা বকুল সরকারকে (৫৯) এই বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছেন শশীভূষণ দে স্ট্রিট নিবাসী দিদি-জামাইবাবু। বৃদ্ধাশ্রমের এই আবাসিকরা পুজোর প্রতিমা এবং খবর দেখছেন সংবাদপত্রে অথবা টিভি-তে।

কলকাতা এবং জেলায় ছড়িয়ে রয়েছে অনেক বৃদ্ধাশ্রম। কোথাও কোথাও পুজোয় আবাসিকদের দল বেঁধে ঠাকুর দেখানো হয়। যেমন ‘নবনীড়’। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম সেখানে গিয়ে পুজোয় নতুন কাপড় দেন। আশীর্বাদ নেন। বীরভূমের স্বপ্ননীড়, ঠাকুরপুকুর রোডে শান্তিনিকেতন হোম, ১৯৭৯-তে ধর্মচাঁদ দাস প্রতিষ্ঠিত আনন্দাশ্রম, মা কালি ওল্ড এজ হোম, ১৯৯৭-তে প্রতিষ্ঠিত সিস্টার্স অফ চ্যারিটি, ২০০৫-এ প্রতিষ্ঠিত ‘শিবাশ্রম’ প্রভৃতি অনেক বৃদ্ধাশ্রম রয়েছে এখানে ওখানে। এগুলোয় আসনসংখ্যা নানা ধরণের। যেমন ‘শিবাশ্রম’-এ ৫০, ২০০৮-এ প্রতিষ্ঠিত ‘আলোর দিশা’য় ৮০-র ওপর।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি মাকে রেখেছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আগে নাতিকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহান্তে আসতেন। এখন ছেলে আর নাতি— দুজনেরই ব্যস্ততা বেড়েছে। কম দেখা হয়। যদিও ফোনে কথা হয় প্রায়শই। “নিজে হাতে ভাত খেতে পারতো নাকো খোকা,
বলতাম, আমি না থাকলে রে কি করবি বোকা”? মনে পড়ে এককালে ছেলেকে বলা এধরণের কথা? বৃদ্ধার জবাব, “নাঃ, এরপর অনেক যুগ কেটে গিয়েছে। “পুজোর সময়ে কতটা নিঃসঙ্গ বোধ করেন? বৃদ্ধার জবাব, “করি না। এখানে পরিবেশের সঙ্গে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। ওঁদের (পুত্র) সুবিধা-অসুবিধা, প্রাইভেসির ব্যাপারটাও তো দেখতে হবে!“

এর মধ্যেই পুজো মণ্ডপের গানে ছড়িয়ে পড়ে নচিকেতা চক্রবর্তীর সেই বিখ্যাত গান— “নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামি দামি, সব চেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।” কথাটা সত্যি না মিথ্যে, যে যাঁর মত বিচার করবেন। তবে, বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকরাও পুজোয় নিজেদের সুখ খুঁজে নিচ্ছেন নিজেদের মত করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.