সকলকে পিছনে ফেলে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের পরবর্তী সভাপতি হলেন মিঠুন মনহাস। জম্মু ও কাশ্মীরের এই ক্রিকেটার কোনও আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেননি। জম্মুতে জন্ম হলেও তিনি যে ১৫৭টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলেছেন, তার অধিকাংশই দিল্লির হয়ে।
রবিবার মুম্বইয়ে মনহাস সভাপতি পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। তাঁর মনোনয়ন জমা দেওয়ার কথা জানিয়েছেন রাজীব শুক্ল। ভারতীয় বোর্ডের সহ-সভাপতি শুক্ল সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘পরের টার্মের জন্য নতুন কমিটি তৈরি হয়েছে। প্রাক্তন ক্রিকেটার মিঠুন মনহাস সভাপতি হচ্ছেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’’
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রজার বিন্নীর পর মনহাসের ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের মসনদে বসাটা নিঃসন্দেহে অবাক করার মতো ব্যাপার। সৌরভ-বিন্নীর গোটা ক্রিকেটবিশ্বে যে পরিচিতি রয়েছে, মনহাস তার ১০০ মিটারের মধ্যেও আসবেন না। শুধু ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দিল্লি ডেয়ারডেভিলস, পুণে ওয়ারিয়র্স এবং চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে আইপিএল খেলার ফলে যেটুকু পরিচিতি তাঁর।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যে তাদের ‘রবার স্ট্যাম্প’ কাউকেই বোর্ডের শীর্ষ পদে বসাবে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। বিন্নীকে তিন বছর আগে ২০২২ সালে যখন বোর্ডের সভাপতি করা হয়েছিল, তখনই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। শোনা যায়, বিন্নী ক্রিকেটীয় বিষয়ে টুকটাক মতামত দিতেন, এই পর্যন্তই। বাকিটা তৎকালীন বোর্ড সচিব জয় শাহই করতেন। সেই ধারা বজায় রেখে ফুটবল-সহ বাকি অধিকাংশ খেলাতেই বিজেপি ‘রবার স্ট্যাম্প’ লোক বসিয়েছে বলেই মনে করা হয়। মনহাসও যে সেই পথেই হাঁটবেন, বা তাঁকে সেই পথেই চালিত করা হবে, তা এক রকম স্পষ্ট।
ঘটনাচক্রে, শনিবার নাকি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাড়িতে একটি বৈঠক হয়। সেখানে সভাপতি এবং বোর্ডের অন্য পদের দৌড়ে থাকা সকলকেই আসতে বলা হয়। জানা যাচ্ছে, সেখানেই মনহাসের নাম চূড়ান্ত হয়েছে। সচিব পদে থাকছেন দেবজিৎ শইকীয়া। সহ-সভাপতি এবং যুগ্ম সচিব যথাক্রমে রাজীব শুক্ল এবং প্রভতেজ সিংহ ভাটিয়া। সভাপতির দৌড়ে যাঁর নাম সকলের আগে ছিল, সেই কর্নাটকের রঘুরাম ভাট বোর্ডের কোষাধ্যক্ষ হচ্ছেন। আইপিএলের চেয়ারম্যান থাকছেন অরুণ ধুমল। অ্যাপেক্স কাউন্সিলে থাকছেন জয়দেব শাহ। আইপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলে জায়গা পেয়েছেন মামন মজুমদার। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে জম্মুর মনহাসের বোর্ড সভাপতি হওয়াটাই সবচেয়ে বড় চমক।
৪৫ বছরের মনহাসের ক্রিকেটে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা যে একেবারে শূন্য, তা নয়। তিনি জম্মু ও কাশ্মীর ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (জেকেসিএ) প্রশাসনিক পদে ছিলেন এবং বিসিসিআইয়ের বার্ষিক সাধারণ সভাতেও রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
১৯৯৭/৯৮ মরসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় মনহাসের। ১৭ বছর ধরে তিনি দিল্লির মিডল অর্ডারে নির্ভরযোগ্য ব্যাটার ছিলেন। রাহুল দ্রাবিড়, সচিন তেন্ডুলকর, ভিভিএস লক্ষ্মণ এবং সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের যুগে তাঁর পক্ষে ভারতীয় দলে জায়গা করা কঠিন ছিল। শিকে ছেঁড়েওনি। তিনি অধিনায়ক হিসাবে দিল্লিকে ২০০৭-০৮ মরসুমে রঞ্জি ট্রফি চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। সেই বছর ৫৭.৫৬ গড়ে ৯২১ রান করেছিলেন। বিরাট কোহলিও তাঁর নেতৃত্বে রঞ্জি খেলেছেন।
ডানহাতি ব্যাটার মনহাস অফ-স্পিন বোলিংও করতেন। ১৫৭টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ২৭টি শতরান, ৪৯টি অর্ধশতরান-সহ ৪৫.৮২ গড়ে ৯,৭১৪ রান করেছেন। পাশাপাশি ৪০টি উইকেটও রয়েছে। তিনি দিল্লি ডেয়ারডেভিলস, পুণে ওয়ারিয়র্স এবং চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে আইপিএলে খেলেছেন। ২০০৮ সালে প্রথম আইপিএলে দিল্লি তাঁকে নিলামে কেনে। ২০১১ সালে তাঁকে নেয় পুণে। ২০১৪ সালে মহেন্দ্র সিংহ ধোনির চেন্নাই তাঁকে কিনে নেয়। আইপিএলে ৫৫টি ম্যাচে ২২.৩৪ গড়ে ৫১৪ রান করেন।
২০১৭ সালে মনহাস পঞ্জাব কিংসের সহকারী কোচ হন। এর পর বাংলাদেশের অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ব্যাটিং পরামর্শদাতা হন। দু’বছর সেই পদে থাকার পর তিনি রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর সহকারী কোচ হন। এখন তিনি গুজরাত টাইটান্সের সহকারী কোচের পদে রয়েছেন।
ভারতীয় বোর্ডের নতুন সভাপতি হয়ে প্রশাসক মানহাস ১০ গোল দিয়ে দিলেন ক্রিকেটার মনহাসকে। কী ভাবে চাকা তাঁর দিকে ঘুরল, সে ব্যাপারে কিছু জানা না গেলেও মনে করা হচ্ছে, মনহাসকেই ‘রবার স্ট্যাম্প’ প্রেসিডেন্ট হিসাবে সবচেয়ে ‘যোগ্য’ বলে মনে করেছেন শাহেরা। তিনি কাশ্মীরের মতো একটি রাজ্যের প্রতিনিধিত্ব করছেন, এটিও তাঁর পক্ষে গিয়েছে। শনিবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে উপস্থিত ছিলেন বোর্ড সচিব দেবজিৎ শইকীয়া, যুগ্ম সচিব রোহন দেশাই, কোষাধ্যক্ষ প্রভতেজ সিংহ ভাটিয়া, সহ-সভাপতি রাজীব শুক্ল এবং আইপিএল কমিশনার অরুণ সিংহ ধুমল।
এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন বোর্ড সচিব সৌরাষ্ট্রের নিরঞ্জন শাহ এবং তামিলনাড়ুর কাশী বিশ্বনাথনের মতো সিনিয়র কর্তারা। আইপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং কর্নাটকের ব্রিজেশ পটেলকেও বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। জানা যাচ্ছে সৌরভও শনিবার নাকি দিল্লিতে ছিলেন। কিন্তু তিনি এই বৈঠকে ছিলেন, এমন খবর নেই।