এ সব কী হচ্ছে!
লর্ডসের তৃতীয় দিনের অন্তিম ওভার এখন মুচমুচে আলোচনার কেন্দ্রে। সৌজন্য শুভমন গিল। সময় নষ্ট করা ইংল্যান্ড ব্যাটারকে যে ভাবে বিদ্রুপে, কটূক্তিতে বিদ্ধ করে, এমনকি অপশব্দও ব্যবহার করে ‘শাসন’ করলেন ভারত অধিনায়ক, তাতে দুই ‘রংবাজ’ প্রাক্তনের ছায়া দেখা যাচ্ছে।
ন্যাটওয়েস্ট ট্রফি জেতার পর লর্ডসের ব্যালকনিতে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের জার্সি ওড়ানোর দৃশ্য ভারতীয় ক্রিকেটে আগ্রাসনের প্রতীক হয়ে গিয়েছে। ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়ার মতো দলগুলির চোখে চোখ রেখে ‘খেলার বাইরের খেলা’র বীজ বপন করেছিলেন অধিনায়ক সৌরভ। সেই আগ্রাসন ফিরে এসেছিল বিরাট কোহলির যুগে। অধিনায়ক কোহলির ব্যাট সচল থাকত। মুখেও সরব থাকতেন। প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়াতেন। দরকার বা সুযোগমতো স্লেজিং করতেন। আম্পায়ারদের সঙ্গে তর্ক করতেন। ইংল্যান্ডের মাটিতে কোহলিও আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে গিয়েছিলেন জো রুটের দিকে। সে সব অতীত। চলতি সিরিজ়ে পর পর কয়েকটি ঘটনা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিচ্ছে— আবার ফিরছে সেই সময়, শুভমন গিলের হাত ধরে।
শুভমনের আন্তর্জাতিক অধিনায়কত্বের এখনও শৈশব। সবে তৃতীয় টেস্টে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সাদা বলের ক্রিকেটে ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা এখনও হয়নি। একদিনের খেলায় তিনি রোহিত শর্মার সহকারী। ২৫ বছরের ব্যাটার আপাত ভাবে শান্ত। মুখে একটা সারল্যের ছাপ। হাসলে দু’গালে টোল পড়ে। পরিমিত কথা বলেন। চেহারা বা হাবভাবও সেই অর্থে ‘স্পোর্টসম্যান-সুলভ’ নয়। এক নজরেই দারুণ সমীহ জাগানো ব্যাপার নেই। সেই শুভমনই ইংল্যান্ডের মাটিতে আম্পায়ারদের সঙ্গে তর্ক জুড়ছেন। বেশ একরোখা দেখাচ্ছে—এতটুকু বাড়তি সুবিধা প্রতিপক্ষকে দেব না।
অন্য দিকে, ব্যাটার শুভমন কিন্তু বড় ইনিংস খেলেও শান্ত। এজবাস্টনে দু’ইনিংসেই শতরান করেছেন। প্রথম ইনিংসে ২৬৯। দ্বিতীয় ইনিংসে ১৬১। মাথা ঠান্ডা রেখে ব্যাট করেছেন। প্রতিটি শটে নিখুঁত থাকতে চেয়েছেন। চাপের মুখেও সংযত। শরীরী ভাষা নয়, দাপট দেখিয়েছে তাঁর ব্যাট। ব্যাটিংয়ের সময়কার শুভমনকে মেলানো যাচ্ছে না ফিল্ডিংয়ের সময়কার শুভমনের সঙ্গে। আইপিএল চলাকালীন এক সাক্ষাৎকারে শুভমন বলছিলেন, ব্যাট করার সময় এখন তিনি মাথাতেই রাখেন না যে তিনি অধিনায়ক। সাধারণ ব্যাটার হিসাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেন। নেতৃত্বের বর্ম এবং চাপ সাজঘরে ফেলে রেখে ব্যাট করতে নামেন। নিজেকে দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছেন। একটা ব্যাটার। আর একটা অধিনায়ক।
শুভমনের আগে টেস্ট দলের অধিনায়ক ছিলেন রোহিত। প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারদের সঙ্গে সরাসরি বাদানুবাদে খুব একটা জড়াতেন না। রোহিত মূলত সতীর্থদেরই বকাবকি করতেন। তাঁরা ভুল করলে মাথা গরম করতেন। আম্পায়ারদের সঙ্গে তর্ক করতেন কখনও কখনও। লড়াইটা মূলত ক্রিকেট দিয়েই করার চেষ্টা করতেন। শুভমন সেটা তো করছেনই। সঙ্গে প্রতিপক্ষ বা আম্পায়ারদের সঙ্গেও লড়ে যাচ্ছেন। বল পরিবর্তন নিয়েও প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করছেন। দলের স্বার্থে তর্ক করছেন। তেড়ে যাচ্ছেন। বিদ্রুপ করছেন। আঙুল উঁচিয়ে কথা বলছেন। মুখ খারাপও করছেন। শাস্তির পরোয়া করছেন না।
শনিবারের ঘটনাটা ঘটল এক্কেবারে শেষ লগ্নে। অযথা সময় নষ্ট করছিলেন ইংল্যান্ডের দুই ওপেনার জ্যাক ক্রলি এবং বেন ডাকেট। জসপ্রীত বুমরাহ তৃতীয় বল করার জন্য দৌড়োনো শুরু করতেই হঠাৎ সরে যান ক্রলি। সাইট স্ক্রিনের সামনে কেউ নাকি ন়ড়াচড়া করছিলেন। অথচ সেখানে তখন কেউ ছিলেন না। শুভমন এগিয়ে এসে কিছু একটা বলে চলে যান। আসল নাটক শুরু হয় চতুর্থ বলের পর। বুমরাহের পঞ্চম বলের আগে নিজেদের মধ্যে খানিক ক্ষণ কথা বলেন দুই ইংরেজ ব্যাটার। তাতে পরিস্থিতি খানিকটা উত্তপ্ত হয়। এর পর বুমরাহের বল ক্রলি ব্যাট দিয়ে খেলেও আঙুলে চোট পাওয়ার অভিনয় করেন। হাঁটতে হাঁটতে লেগ আম্পায়ারের দিকে সরে গিয়ে ফিজিয়োকে ডাকেন। কাণ্ড দেখে শুভমন সতীর্থদের নিয়ে ক্রলিকে প্রায় ঘিরে ধরে হাততালি দেন হাসতে হাসতেই। ভাবটা এমন, সাহসের সঙ্গে বুমরাহের বল খেলার জন্য ক্রলিকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। তখন ক্রলি কিছু বলার চেষ্টা করতেই তাঁর দিকে তেড়ে যান শুভমন। তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ‘ইমপ্যাক্ট সাব’ চাওয়ার ইঙ্গিত করেন। তার পর আঙুল উঁচিয়ে কিছু বলেন। তত ক্ষণে কাছে চলে আসেন ডাকেট। তাঁর সঙ্গেও বিবাদে জড়ান শুভমন। এ সময় ভারত অধিনায়ককে গালাগালি করতেও শোনা গিয়েছে। শুভমনের এই রূপ দেখার পরই শুরু হয়েছে আলোচনা, সমালোচনাও।
ব্যাপারটা বেশ গায়ে লেগেছে ইংরেজদের। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন ক্রিকেটার জোনাথন ট্রট যেমন বলেছেন, ‘‘এ সব (ইংল্যান্ডের সময় নষ্ট করা) খেলারই অংশ। জানি না ইংল্যান্ড ফিল্ডিং করার সময় কী হয়েছিল। ওরা বিষয়টাকে হয়তো তেমন গুরুত্ব দেয়নি। শুভমনের এই (কোহলিকে নকল করার) অভিনয়টা ভাল নয়।’’ সিরিজ়ের সম্প্রচারকারী সংস্থার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি আরও বলেছেন, ‘‘এক জন অধিনায়ক দলের মনোভাব স্থির করে দেয়। শুভমন আঙুল উঁচিয়ে তর্ক করছে। এক জন প্রাক্তন অধিনায়কের (কোহলি?) মতো দেখতে লাগছে ওকে। এই ধরনের ঘটনায় পরিবেশ খারাপ হয়। আমি সব সময় প্রতিযোগিতার পক্ষে। মাঠে কঠোর লড়াইয়ের পক্ষে। আমার মতে, শুভমনের এ সবের ঊর্ধ্বে ওঠা উচিত।’’
ক্রিকেটার শুভমনের গড়ে ওঠার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে যুবরাজ সিংহের। যুবরাজের অ্যাকাডেমির ছাত্র তিনি। সেই যুবরাজ, যিনি অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফের স্লেজিংয়ের জবাব দিয়েছিলেন স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছ’বলে ছয় ছক্কা মেরে। সেই যুবরাজ, যিনি অস্ট্রেলিয়াকে পেলেই জ্বলে উঠতেন। ব্রেট লির মতো বোলারের বল ফ্লিক করে গ্যালারিতে পাঠিয়ে দিতেন। অধিনায়ক শুভমনের মধ্যে মহারাজ আর বিরাটরাজের যে ছায়া দেখা যাচ্ছে, গুরু যুবরাজই হয়তো তার নেপথ্যে। আইপিএলেও গুজরাত টাইটান্সের অধিনায়ক হিসাবে শুভমন বেশ আগ্রাসী। প্রতিপক্ষের ক্রিকেটারদের সঙ্গে তর্ক করেন। তর্ক করেন আম্পায়ারদের সঙ্গেও।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অধিনায়ক হিসাবে ভালই শুরু করেছেন শুভমন। প্রথম টেস্টে হারলেও টানটান ম্যাচ হয়েছে। দ্বিতীয় টেস্টে ভারত শোধ তো নিয়েইছে, ৩৩৬ রানে হারিয়েছে ইংল্যান্ডকে। দুই টেস্টেই ব্যাটে সফল ক্যাপ্টেন। অনেকেই বলছেন, এই সাফল্যটা ধরে রাখতে হবে শুভমনকে। ব্যাটে রান না-থাকলে, দল জিততে না-থাকলে কিন্তু ‘বাইরের’ আগ্রাসনটা চুপসে যাবে অচিরেই।