বাঙ্গালী জাতির শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ রবীন্দ্র চর্চায় শ্রী রাম

আমি পাঁচ-ছয়টি ছেলে নিয়ে জামগাছতলায় তাদের পড়াতাম। আমার নিজের বেশি বিদ্যে ছিল না। কিন্তু আমি যা পারি তা করেছি। সেই ছেলে-কয়টিকে নিয়ে রস দিয়ে ভাব দিয়ে রামায়ণ মহাভারত পড়িয়েছি– তাদের কাঁদিয়েছি হাসিয়েছি, ঘনিষ্ঠভাবে তাদের সঙ্গে যুক্ত থেকে তাদের মানুষ করেছি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (প্রবন্ধ : বিশ্বভারতী)

কহ মোরে বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম,
কাহার চরিত্র ঘেরি সুকঠিন ধর্মের নিয়ম
ধরেছে সুন্দর কান্তি মাণিক্যের অঙ্গদের মতো,
মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয় নি নত,
সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক,
কে পেয়েছে সব চেয়ে, কে দিয়েছে তাহার অধিক,
কে লয়েছে নিজশিরে রাজভালে মুকুটের সম
সবিনয়ে সগৌরবে ধরামাঝে দুঃখ মহত্তম–
কহ মোরে, সর্বদর্শী হে দেবর্ষি, তাঁর পুণ্য নাম।”
নারদ কহিলা ধীরে, “অযোধ্যায় রঘুপতি রাম।”

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর(ভাষা এবং ছন্দ)

“রামের জীবনের সকল কার্যেই উদার বীর্যবান সহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়। একথা ভারতবর্ষ ভুলিতে পারে নাই যে তিনি চন্ডালের মিতা, বানরের দেবতা, বিভীষণের বন্ধু ছিলেন। তিনি শত্রুকে ক্ষয় করিয়াছিলেন, এ তাহার গৌরব নহে। তিনি শত্রুকে আপন করিয়াছিলেন। তিনি আচারের নিষেধকে , সামাজিক বিদ্বেষের বাধাকে অতিক্রম করিয়াছিলেন,..

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ( প্রবন্ধ : ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা)

“আমি হিন্দু , এ-কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে, তাতে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতেই হইবে। কারণ, বিধাতার বিরুদ্ধে নালিশ করিতে হইলে সেই আপিল – আদালতের জজ পাইব কোথায়?”

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (আত্মপরিচয়)

"আজকের বাংলা ভাষা যদি বাঙালী মুস লমানদের ভাব সুস্পষ্টরূপে ও সহজভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়, তবে তাঁরা বাংলা পরিত্যাগ করে উর্দ্দু গ্রহণ করতে পারেন। সেটা বাঙালী জাতির পক্ষে যতই দুঃখকর হোক না কেন, বাংলা ভাষার মূল স্বরূপকে দুর্ব্যবহারের দ্বারা নিপীড়িত করলে সেটা আরও বেশি শোচনীয় হবে। ... 

বাংলা ভাষার মধ্যে সহজেই হাজার হাজার পার্সি আরবি শব্দ চলে গেছে। তারমধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোনো লক্ষণ নেই। যে সব পার্সি আরবি শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত, অথবা হয়ত কোনো এক শ্রেণীর মধ্যে বদ্ধ, তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে।”

~রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মক্তব-মাদ্রাসার বাংলা’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪১, পৃষ্ঠা ১০৩

“ হিন্দুরা যেভাবে ধর্মবিরোধ মীমাংসা করবার চেষ্টা করেছে, তাই বর্তমান যুগে ধ্রুব বলে মনে হয়। গণতান্ত্রিক মনোভাব, লক্ষ্য স্থির করার ও লক্ষ্যে পৌঁছবার চেষ্টা করার স্বাধীনতায় যে বিশ্বাস, তাই হিন্দুত্ব। ”

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (আত্মশক্তি)

“ রামকে পেলুম, সে তো একটি মাত্র মানুষের রূপে নয়। অনেক কাল থেকে, অনেক মানুষের মধ্যে যে সকল বিশেষ গুণের ক্ষণে ক্ষণে কিছু কিছু স্বাদ পাওয়া গেছে কবির মনে; সে সমস্ত দানা বেঁধে উঠল রামচন্দ্রের মূর্তিতে। রামচন্দ্র হয়ে উঠলেন আমাদের মনের মানুষ। ”

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (সাহিত্যের পথে)

“ বাংলাদেশের মাটিতে সেই রামায়ণ কথা হরগৌরী ও রাধাকৃষ্ণের কথার উপরে যে মাথা তুলিয়া উঠিতে পারে না, তাহা আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য। রামকে যাহারা যুদ্ধক্ষেত্র ও কর্মক্ষেত্রে নরদেবতার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে, তাহাদের পৌরুষ , কর্তব্যনিষ্ঠা ও ধর্মপরতার আদর্শ আমাদের অপেক্ষা উচ্চতর। ”

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (লোকসাহিত্য, পৃষ্ঠা ১২০)

“ রামের জীবনের সকল কার্যেই উদার বীর্যবান সহিষ্ণুতার পরিচয় পাওয়া যায়। একথা ভারতবর্ষ ভুলিতে পারে নাই যে তিনি চন্ডালের মিতা, বানরের দেবতা ও বিভীষণের বন্ধু ছিলেন। তিনি শত্রুকে ক্ষয় করিয়াছিলেন, এ তাহার গৌরব নহে। তিনি শত্রুকে আপন করিয়াছিলেন। তিনি আচারের নিষেধকে , সামাজিক বিদ্বেষের বাধাকে অতিক্রম করিয়াছিলেন। তিনি আর্য-অনার্যের মধ্যে প্রীতির সেতু বন্ধন করিয়া দিয়াছিলেন। ”

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা)

“ হিন্দুসভ্যতা যে এক অত্যাশ্চর্য প্রকান্ড সমাজ বাঁধিয়াছে, তাহার মধ্যে স্থান পায় নাই এমন জাতি নাই। প্রাচীন শকজাতীয় জাঠ ও রাজপুত; মিশ্রজাতীয় নেপালি, আসামী, রাজবংশী, দ্রাবিড়, তৈলঙ্গী , নায়ার – সকলে আপন আপন ভাষা, বৃহৎ সামঞ্জস্য রক্ষা করিয়া একত্রে বাস করিতেছে। হিন্দুসভ্যতা এত বিচিত্র লোককে পরিত্যাগ করে নাই। উচ্চ-নীচ, সবর্ণ-অসবর্ণ সকলকে ঘনিষ্ঠ করিয়া বাঁধিয়াছে। সকলকে ধর্মের আশ্রয় দিয়াছে। সকলকে কর্তব্যপথে সংযত করিয়া শৈথিল্য ও অধঃপতন হইতে টানিয়া রাখিয়াছে। ”

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (হিন্দুত্ব)

“ভাষার ঐক্যে ন্যাশনাল ঐক্যবন্ধনের সহায়তা করে, সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহাতে এক করিবেই, এমন কোনো জবরদস্তি নাই। য়ুনাইটেড স্টেটস ও ইংলণ্ডের ভাষা এক, স্পেন ও ম্পানীয় আমেরিকার ভাষা এক, কিন্তু তাহারা এক নেশন নহে। …
তাহা ছাড়া, ভাষায় জাতির পরিচয় পাওয়া যায়, এ-কথাও ঠিক নয়। প্রুসিয়া আজ জর্মান বলে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে স্লাভোনিক বলিত, ওয়েল্‌স্‌ ইংরেজি ব্যবহার করে, ইজিপ্ট আরবি ভাষায় কথা কহিয়া থাকে।”

~ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘নেশন কী’, রবীন্দ্র-রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৫০, পৃ. ৫১৭

“…শতাব্দীর পর শতাব্দী যাইতেছে কিন্তু রামায়ণ-মহাভারতের স্রোত ভারতবর্ষে আর লেশমাত্র শুষ্ক হইতেছে না। প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঘরে ঘরে তাহা পঠিত হইতেছে, মুদির দোকান হইতে রাজার প্রাসাদ পর্যন্ত সর্বত্রই তাহার সমান সমাদর। ধন্য সেই কবিযুগলকে, কালের মহাপ্রান্তরের মধ্যে যাঁহাদের নাম হারাইয়া গেছে, কিন্তু যাঁহাদের বাণী বহুকোটি নরনারীরর দ্বারে দ্বারে আজিও অজস্রধারায় শক্তি ও শান্তি বহন করিতেছে, শত শত প্রাচীন শতাব্দীর পলিমৃত্তিকা অহরহ আনয়ন করিয়া ভারতবর্ষের চিত্তভূমিকে আজিও উর্বরা করিয়া রাখিতেছে।
এমন অবস্থায় রামায়ণ-মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য বলিলে চলিবে না, তাহা ইতিহাসও বটে; ঘটনাবলীর ইতিহাস নহে, কারণ সেরূপ ইতিহাস সময়বিশেষকে অবলম্বন করিয়া থাকে—রামায়ণ-মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালের ইতিহাস। অন্য ইতিহাস কালে কালে কতই পরিবর্তিত হইল, কিন্তু এ ইতিহাসের পরিবর্তন হয় নাই। ভারতবর্ষের যাহা সাধনা, যাহা আরাধনা, যাহা সংকল্প, তাহারই ইতিহাস এই দুই বিপুল কাব্যহর্ম্যের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান।
এই কারণে, রামায়ণ-মহাভারতের যে সমালোচনা তাহা অন্য কাব্যসমালোচনার আদর্শ হইতে স্বতন্ত্র। রামের চরিত্র উচ্চ কি নীচ, লক্ষ্মণের চরিত্র আমার ভালো লাগে কি মন্দ লাগে, এই আলোচনাই যথেষ্ট নহে। স্তব্ধ হইয়া শ্রদ্ধার সহিত বিচার করিতে হইবে, সমস্ত ভারতবর্ষ অনেক সহস্র বৎসর ইহাদিগকে কিরূপভাবে গ্রহণ করিয়াছে। আমি যতবড়ো সমালোচকই হই-না কেন, একটি সমগ্র প্রাচীন দেশের ইতিহাস-প্রবাহিত সমস্ত কালের বিচারের নিকট যদি আমার শির নত না হয় তবে সেই ঔদ্ধত্য লজ্জারই বিষয়।
রামায়ণে ভারতবর্ষ কী বলিতেছে, রামায়ণে ভারতবর্ষ কোন্‌ আদর্শকে মহৎ বলিয়া স্বীকার করিয়াছে, ইহাই বর্তমান ক্ষেত্রে আমাদের সবিনয়ে বিচার করিবার বিষয়।
…ভারতবাসীর ঘরের লোক এত সত্য নহে, রাম লক্ষ্মণ সীতা তাহার পক্ষে যত সত্য…”

  ~ রামায়ণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.