বিজয়াদশমীর দিনে মণ্ডপে মণ্ডপে দর্পণ বিসর্জন হয়ে গিয়েছে। তা সত্ত্বেও আগামী দু’-এক দিন বড় বারোয়ারির পুজো মণ্ডপগুলিতে থাকবেন দুর্গা। সেই আবহেই আগামী বছরের পুজোর প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে কলকাতার সব বড় পুজো কমিটি। দেবীপক্ষের শুরুতেই কলকাতার কোন পুজোয় কোন শিল্পী নজরকাড়া কাজ করেছেন, তা জানতে নজরদারি চালিয়েছিলেন পুজো কমিটির কর্তারা। আর এ বার সেই সব পুজো কমিটিই নিজেদের ২০২৬ সালের শিল্পী চূড়ান্ত করতে চাইছে। তবে সব কিছু গোপন রাখতে চাইছে তারা। মোক্ষম সময়েই নিজেদের শিল্পীর নাম প্রকাশ্যে এনে চমক দিতে চাইছেন পুজো উদ্যোক্তারা। এই প্রতিযোগিতা মনে করাচ্ছে, সাত-আট-নয়ের দশকের কলকাতার ফুটবল ময়দানে দলবদলের কথা।
তবে এমন কিছু পুজো কমিটি রয়েছে, যারা নিজেদের এ বছরের শিল্পীদের উপরেই আস্থা রাখছে। অনেক বছর পর স্বনামধন্য শিল্পী সনাতন দিন্দা ফিরেছিলেন নলিন সরকার স্ট্রিটের দুর্গোৎসবে। তাঁর কাজে সন্তুষ্ট পুজো কমিটি আগামী বছর তাঁকেই আবার থিম শিল্পী হিসেবে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ বারই প্রথম চালতাবাগান সর্বজনীনের পুজো সাজিয়েছিলেন শিল্পী প্রদীপ্ত কর্মকার। ‘আমি বাংলায় বলছি’ থিম ভাবনায় সাজিয়ে পুজো কমিটিকে খুশি করেছেন তিনি। এমনকি নবমীর দিন বাংলার শাসকদল তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পুজো দেখে প্রশংসা করে গিয়েছেন। আর তার পরেই চালতাবাগান সর্বজনীনের পুজো কর্তারা প্রদীপ্তকে ২০২৬ সালের পুজোর জন্য চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। শিল্পী প্রদীপ্ত বলেন, “আমাকে আগামী বছরের জন্যও নিজেদের পুজোয় শিল্পী হিসাবে রাখতে চান চালতাবাগানের কর্মকর্তারা। তাই এই পুজোর সঙ্গে আমি যুক্ত থাকব। অনেক পুজো কমিটিই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে, আর একটি পুজোর কাজ হয়তো আমি হাতে নিতে পারব। তবে এখনই কোনও সিদ্ধান্ত নিইনি।’’
একই ভাবনায় চলতে চাইছেন ঠাকুরপুকুর স্টেট ব্যাঙ্ক পার্ক সর্বজনীনের কর্মকর্তারা। এ বার শিল্পী রাজু সরকারকে নিজেদের পুজো সাজানোর দায়িত্ব দিয়ে বড় সাফল্য পেয়েছেন তাঁরা। তাই রাজুকেই আগামী বছরের জন্য ধরে রাখতে চাইছেন বলেই জানিয়েছেন ওই পুজো কমিটির অন্যতম কর্তা অজয় মজুমদার। টালা বারোয়ারি প্রশান্ত পালকে এবং কাশী বোস লেন পুজো কমিটি অনির্বাণ দাসকে ফের শিল্পী হিসাবে দায়িত্ব দেওয়ার কথা ঘোষণা করে দিয়েছে।
কলকাতার শারদোৎসবের বাজারে অন্যতম নামকরা শিল্পী রিন্টু দাস এ বার নাকতলা উদয়ন সঙ্ঘ, চক্রবেড়িয়া সর্বজনীনের সঙ্গে নিউটাউনের একটি পুজোর কাজ করেছিলেন। একঝাঁক পুজো কমিটি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করলেও, এখনও তিনি কোনও সিদ্ধান্ত নেননি বলেই জানিয়েছেন। দুর্ঘটনার জন্য এ বছর কোনও পুজোয় অংশ নিতে পারেননি শিল্পী অনিমেষ দাস। তাঁর সঙ্গেও কলকাতার বেশ কয়েকটি পুজো কমিটির কথাবার্তা হয়েছে। তিনি অবশ্য কোনও পুজো কমিটির নাম জানাতে চাননি। নিজের ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারণে এ বছর কোনও পুজো কমিটির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেননি পার্থ জোয়ারদার। তবে এই এক বছরে একটি মনের মতো থিম তৈরি করেছেন বলেই জানিয়েছেন এই শিল্পী। আগামী বছর নিজের এই থিমেই প্রাণদান করতে কয়েকটি পুজো কমিটির সঙ্গে কথা হয়েছে তাঁর।
বেহালা নূতন দলের কৌশল আবার অন্যদের চেয়ে ভিন্ন। তাদের পুজোর বর্ষীয়ান কর্তা দেবব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা বিসর্জনের আগে বোধনের চিন্তা করি না। তাই এ বছরের প্রতিমা বিসর্জন হলে, তার পর আমরা আগামী বছরের ভাবনা ভাবব।’’
বড়িশা ক্লাবের সভাপতি তথা ১২৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সুদীপ পোল্লে আবার যুব অবস্থা থেকেই পুজোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ‘শূন্য পৃথিবী’ থিমে তাঁদের শারদোৎসব সাজিয়েছিলেন শিল্পী মানস। প্রতি বছর বিজয়া দশমীর দিনেই তাঁরা নিজেদের আগামী বছরের শিল্পীর নাম চূড়ান্ত করে ফেলেন। কিন্তু এ বার রহস্যজনক হাসি হেসে সেই সুদীপ বলছেন, “এখনও কিছু ঠিক হয়নি। হলেই আপনাদের জানাব।’’ খিদিরপুর ২৫ পল্লীর এ বারের পুজো সাজিয়ে তোলার দায়িত্বে ছিলেন শিল্পী জুটি মলয়-শুভময়। সেই পুজো কমিটির প্রচার সচিব কালী সাহা বলছেন, ‘‘এখন তো পুজো আর পুজোয় সীমাবদ্ধ নেই। এখন শিল্প, কৃষ্টি, সংস্কৃতি প্রতিযোগিতার মঞ্চ হয়ে উঠেছে। তাই সব পুজো কমিটিই চায় নিজেদের পুজোকে শ্রেষ্ঠ জায়গায় পৌঁছে দিতে। তাই ভাল শিল্পীদের নিজেদের পুজোয় ঘরে তুলতে চায় সকলেই। এ ক্ষেত্রে যে যত তাড়াতাড়ি ভাল শিল্পীকে নিজেদের ঘরে তুলতে পারবে, সাফল্য তাদের কাছেই ধরা দেবে। আগে যেমনটা ইস্টবেঙ্গল এবং মোহনবাগানের মধ্যে ফুটবলার নিয়ে টানাটানি হত, প্রতিযোগিতাটাও ঠিক তেমনই হয়ে গিয়েছে।’’