রাজ্য জুড়ে রামনবমীর মিছিল সকাল থেকে রাত, শুধু বিজেপি নয়, শামিল তৃণমূল নেতৃত্বও! দেখা গেল ধর্মীয় ঐক্যের ছবিও

বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের তরফে শক্তি প্রদর্শনের পরিকল্পনা ছিল। বেনজির প্রস্তুতিও ছিল এ বারের রামনবমী ঘিরে। আরও কঠিন কাজ ছিল তৃণমূলের। রামনবমী উদ্‌যাপনের বিরোধিতা করা যাবে না, আবার বিজেপিকে খোলা ময়দানও ছেড়ে দেওয়া যাবে না। পুলিশ-প্রশাসনের মাথায় ছিল পাহাড়প্রমাণ চাপ। রামনবমীর যাবতীয় কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ ভাবে মেটানো যাবে কী ভাবে, তা নিয়ে চিন্তা ছিল। কিন্তু রবিবার রাত ১২টা পর্যন্ত কোথাও অশান্তির খবর নেই। রাজ্য বিজেপির প্রায় সব পরিচিত মুখই বিভিন্ন এলাকায় নির্বিঘ্নে একের পর এক শোভাযাত্রা করলেন। কলকাতা থেকে জেলা, তৃণমূল নেতৃত্বকেও রামনবমীর মিছিলে দেখা গেল। রাজনীতির রং পেরিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিরও ছবি দেখা গেল বেশ কয়েকটি জেলায়। এমনকি একাধিক জেলায় রামনবমী উদ্‌যাপনে তৃণমূল এবং বিজেপিকে একসঙ্গেও দেখা গিয়েছে।

বিজেপির সামনের সারির নেতাদের মধ্যে রবিবার সবচেয়ে বেশি সংখ্যক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছেন দিলীপ ঘোষ। তিনি সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন নিজের সাবেক নির্বাচনী কেন্দ্র খড়্গপুর সদরে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একের পর এক শোভাযাত্রায় দিলীপ অংশ নেন। বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতির লাঠিখেলার দক্ষতা সুবিদিত। তাই অনুগামীদের আবদারে বিভিন্ন শোভাযাত্রায় লাঠি হাতে কসরত দেখালেন দিলীপ। তবে শুধু লাঠি নয়, অস্ত্র হাতে মিছিল করার পক্ষেও খোলাখুলি সওয়াল করলেন। দিলীপের কথায়, ‘‘রামনবমীর মিছিলে অস্ত্র থাকাটাই রীতি। বরাবর অস্ত্র নিয়েই মিছিল হয়।’’ রাজ্যের পুলিশকে তোপ দেগে দিলীপের মন্তব্য, ‘‘রাজ্যে যখনতখন বোমা-গুলি চলে যাচ্ছে, মানুষ মারা যাচ্ছে। তখন পুলিশ অস্ত্র খুঁজে পায় না। কিন্তু রামনবমীর মিছিল হলেই পুলিশ অস্ত্র দেখতে পায়।’’

উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুরে রামনবমীর মিছিলে মুখোমুখি তৃণমূল নেতা তথা স্থানীয় পুরপ্রধান কানাইয়ালাল আগরওয়াল এবং রায়গঞ্জের বিজেপি সাংসদ কার্তিক পাল। হল সৌজন্য বিনিময়ও। — নিজস্ব চিত্র।

রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুকান্ত মজুমদারও একাধিক মিছিলে অংশ নেন। সকালে দলের রাজ্য দফতরে বিজেপির প্রতিষ্ঠা দিবসের অনুষ্ঠান সেরেই পৌঁছে যান হাওড়া। সেখান ‘অঞ্জনীপুত্র সেনা’ নামে একটি সংগঠনের আয়োজনে রামনবমীর শোভাযাত্রায় অংশ নেন। বিকেলে ফের সুকান্তকে দেখা যায় বারসতের রামনবমী শোভাযাত্রায়। কলকাতা, উত্তর শহরতলি, দক্ষিণ শহরতলি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলির মধ্যে বারাসতের এই শোভাযাত্রাই গত কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বড় আকার নিচ্ছে। এ বারও একই ছবি। সুকান্তের সঙ্গে বারাসতের শোভাযাত্রায় ছিলেন অভিনেতা তথা বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির সদস্য মিঠুন চক্রবর্তী। ময়না চেক পোস্ট থেকে বারাসত কাছারি ময়দান পর্যন্ত এই মিছিলে মতুয়া সমাজের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। ডঙ্কা-কাঁসি-লাল নিশান নিয়ে মতুয়া ভক্তেরা শামিল হয়েছিলেন সুকান্ত-মিঠুনের মিছিলে।

রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী রবিবার সকালে নিজের নির্বাচনী এলাকা নন্দীগ্রাম থেকেই রামনবমী উদ্‌যাপন শুরু করেন। নন্দীগ্রামে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ঘোষণা তিনি আগেই করেছিলেন। রবিবার সকালে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুভেন্দু সেই নির্মাণকাজের শিলান্যাস করেন। শোভাযাত্রাতেও অংশ নেন। সন্ধ্যায় পূর্ব মেদিনীপুর জেলারই মেচেদায় তিনি শোভাযাত্রায় অংশ নেন। মেচেদার মিছিল সেরে সরাসরি কলকাতায় পৌঁছন শুভেন্দু। প্রথমে এন্টালি এলাকার শোভাযাত্রায় অংশ নেন। তার পরে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী কেন্দ্র ভবানীপুরে রামনবমী উদ্‌যাপন করতে। ভবানীপুরের কর্মসূচি সেরে পৌঁছন কলকাতা বন্দর এলাকায়। সেখানেও শোভাযাত্রা করেন শুভেন্দু। শুভেন্দুকে ঘিরে প্রত্যাশিত ভাবেই বিজেপি কর্মী-সমর্থকদের বড় জমায়েত দেখা গিয়েছে সবক’টি মিছিলেই। সন্ধ্যার পর কলকাতায় ফিরেও একাধিক কর্মসূচিতে অংশ নেন তিনি।

রাজ্য বিজেপির আর এক প্রাক্তন সভাপতি রাহুল সিংহ অংশ নেন উত্তর কলকাতার রামনবমী শোভাযাত্রায়। প্রাক্তন সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায় সকালে নিউটাউনের হনুমান মন্দির থেকে শুরু হওয়া শোভাযাত্রায় শামিল হন। মিছিলের রুট ঘুরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে তাঁর কিছুটা বচসাও হয়। বিকেলে তিনি অংশ নেন হাওড়া জেলার গঙ্গারামপুরের আয়োজিত শোভাযাত্রায়। রাজ্য বিজেপির আর এক সাধারণ সম্পাদক তথা বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল আসানসোলের শোভাযাত্রায় হেঁটেছেন। গেরুয়া শাড়ি, গেরুয়া পাগড়ি, হাতে ত্রিশূল নিয়ে নজর কেড়েছেন অগ্নিমিত্রা। সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য সল্টলেক, দমদম, হাওড়া, বরানগর-সহ বিভিন্ন এলাকায় মিছিলে পা মিলিয়েছেন।

বরানগরে রামনবমীর শোভাযাত্রায় দমদমের তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় এবং বরাহনগরের তৃণমূল বিধায়ক সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: ফেসবুক।

এ ছাড়া নিজের নিজের নির্বাচনী ক্ষেত্রে রামনবমীর শোভাযাত্রায় অংশ নিয়েছেন জ্যোতির্ময় মাহাতো, জগন্নাথ সরকার, সৌমিত্র খাঁয়েরাও। বাঁকুড়ায় মিছিল করেছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুভাষ সরকার। টালিগঞ্জে মিছিল করেছেন যুব মোর্চার রাজ্য সভাপতি ইন্দ্রনীল খাঁ।

তৃণমূল নেতৃত্বও রামনবমীর মিছিলে শামিল হয়েছেন রাজ্য জুড়েই। উত্তর কলকাতার ঠনঠনিয়া থেকে শ্যামবাজার পাঁচমাথা পর্যন্ত মিছিলে হাঁটেন দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক কুণাল ঘোষ। সেই পদযাত্রায় মুসলিম সম্প্রদায়েরও অনেকে অংশ নেন। মালদহ জেলার ইংরেজবাজারে শোভাযাত্রায় পা মেলান রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা ইংরেজবাজার পুরসভার চেয়ারম্যান কৃষ্ণেন্দুনারায়ণ চৌধুরী। তবে বীরভূম জেলায় তৃণমূল নেতৃত্বের রামনবমী উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি দেখা গিয়েছে। জেলা তৃণমূলের সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল জীবনে প্রথম বার রামনবমীর মিছিল করেছেন। সঙ্গে ছিলেন বোলপুরের সাংসদ অসিত মাল, স্থানীয় বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। জেলার সদর শহর সিউড়িতে রামনবমীর শোভাযাত্রা করেছেন বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় এবং সিউড়ির তৃণমূল বিধায়ক বিকাশ রায়চৌধুরী। সিউড়ির কড়িধ্যা এলাকায় অবশ্য সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন সংগঠন আলাদা মিছিলও করেছে। রামপুরহাটের তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্য বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ও রামনবমীর মিছিলে রবিবার হেঁটেছেন।

বীরভূম জেলার দুবরাজপুরের ছবি আরও নজরকাড়া। সেখানে তৃণমূল এবং বিজেপি নেতৃত্ব একই সঙ্গে মিছিলে হেঁটেছেন। দুবরাজপুরের বিজেপি বিধায়ক অনুপ সাহা এবং দুবরাজপুরের তৃণমূল পুরপ্রধান পীযূষ পাণ্ডে একই মিছিলে পা মিলিয়েছেন। মিছিলে ছিলেন জেলা তৃণমূলের সহ-সভাপতি মলয় মুখোপাধ্যায়, জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক টুটুন নন্দী এবং দুই দলেরই শহর সভাপতি। বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখও রামনবমী উদ্‌যাপন করেছেন। কসবা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় পালিত রামনবমী কর্মসূচিতে যোগ দেন কাজল। তাঁকে স্থানীয় মন্দির কমিটি ত্রিশূল দিয়ে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।

রবিবার বীরভূমের রামপুরহাটে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা লাড্ডু খাওয়াচ্ছেন রামনবমীর শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের। —নিজস্ব চিত্র।

সন্ধ্যায় বরাহনগর এলাকায় রামনবমীর মিছিলে অংশ নেন তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় এবং দলের বিধায়ক সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতা, মালদহ এবং বীরভূমে রামনবমী ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবিও দেখা গিয়েছে রবিবার। মালদহে মুসলিম সম্প্রদায়ের তরফ থেকে রামনবমীর মিছিলে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। বীরভূমের রামপুরহাটে বগটুই মোড়ের কাছে মুসলিম যুবকরা জল এবং মিষ্টি দিয়ে স্বাগত জানিয়েছে রামনবমীর মিছিলকে। হাঁটতে হাঁটতে মিষ্টিমুখ করেছেন ডেপুটি স্পিকার আশিসও।

তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিতরে রামনবমীর উদ্‌যাপন এ বার সঙ্ঘ পরিবারের ‘বড়’ সাফল্য। অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি) গত কয়েক বছর ধরেই ‘বামদুর্গ’ যাদবপুরে রামনবমীর কর্মসূচি করার চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু পেরে ওঠেনি। এ বার সফল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.