হ্যামস্ট্রিংয়ে খুঁত নিয়েও নিখুঁত টেনিস সিনারের! ধরে রাখলেন অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, বিপর্যস্ত জ়েরেভ

‘রিসিভ’!

প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ট্রফির খোঁজে থাকা তরুণের মুখে ফাইনালে টস জেতার পর এমন শব্দ অপ্রত্যাশিত। সেই যুবকের নাম আলেকজান্ডার জ়েরেভ হলে আরও বেশি অপ্রত্যাশিত। তিনি আবার জার্মান। তাই আরও আরও বেশি অপ্রত্যাশিত। শুরুতেই যেন আত্মসমর্পণ করে নিলেন। শেষ পর্যন্ত হেরেও গেলেন। টানা দু’বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতলেন ইয়ানিক সিনার। ফাইনালের ফল তাঁর পক্ষে ৬-৩, ৭-৬ (৭-৪), ৬-৩।

আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি নিয়েই বোধহয় সিনারের মহড়া নিয়ে রড লেভার এরিনায় এসেছিলেন জ়েরেভ। দু’জনেই নেমেছিলেন টেনিসজীবনের তৃতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল খেলতে। আগের দু’টি ফাইনালই জিতেছেন সিনার। দু’টিই হেরেছিলেন জ়েরেভ। অথচ মুখোমুখি লড়াইয়ে ৪-২ ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন ২৭ বছরের জার্মান। ইটালির সিনারের সঙ্গে ছিল একাধিক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার অভিজ্ঞতা। ক্রমতালিকায় শীর্ষ স্থান। খুব পিছিয়ে ছিলেন না জ়েরেভও। এটিপি ক্রমতালিকায় তিনি দ্বিতীয়। ২২ বছরের প্রতিপক্ষের থেকে পিছিয়ে। তবে ততটাও নন, যাতে টস জিতে ‘সার্ভিস’ বা নিদেন পক্ষে ‘সাইড’ শব্দ শোনা যাবে না তাঁর মুখ থেকে। ম্যাচটা কোন খাতে বইতে পারে, তখনই আঁচ করে নিয়েছিলেন সিনার। ঠোঁটের কোণের হালকা হাসিতে বুঝিয়েও দেন।

হতে পারে নিজেকে গুটিয়ে রাখার কৌশল। নিজের দুর্বলতা বুঝতে দিতে চাননি প্রতিপক্ষকে। কিন্তু কোর্টের লড়াই শুরু হলে, দুর্বলতা ঢেকে রাখার সুযোগ নেই। বরং প্রতিপক্ষের দুর্বল জায়গায় বার বার আঘাত করে জয় ছিনিয়ে আনতে হয়। তবু জার্মানদের পরিচিত লড়াকু মেজাজ দেখা গেল না তাঁর খেলায়। সিনারের তৃতীয় সার্ভিস গেমে প্রথম তাঁকে কিছুটা লড়াইয়ের সামনে ফলতে পারলেন। তার আগে সিনার কোনও পয়েন্ট না দিয়ে প্রথম এবং দ্বিতীয় সার্ভিস গেম জেতার পর হতাশায় র‌্যাকেট ছুড়ে দেন জ়েরেভ। খেলার বয়স তখন ৭ মিনিট। এত অল্পেই হতাশা!

Jannik Sinner

শক্তিশালী সার্ভিসগুলি সম্ভবত লকার রুম থেকে আনতে ভুলে গিয়েছিলেন জ়েরেভ। সেই সুযোগ প্রথম থেকেই সম্পূর্ণ কাজে লাগালেন সিনার। জ়েরেভের সার্ভিস ভেঙে ৫-৩ ব্যবধানে এগিয়ে যাওয়ার পর প্রথম সেট জিততে বেশি বেগ পেতে হয়নি শীর্ষবাছাইকে। ৪৬ মিনিটে ৬-৩ ব্যবধানে প্রথম সেট জিতে নেন গত বারের অস্ট্রেলিয়ান ওপেন চ্যাম্পিয়ন। প্রথম সেট থেকেই চ্যাম্পিয়ন হওয়ার প্রয়োজনীয় ছন্দ পেয়ে যাওয়া সিনার এর পর শুধু এগিয়েছেন। বাড়তি কিছু চেষ্টা করেননি। নিজের স্বাভাবিক খেলার চেষ্টা করেছেন।

জ়েরেভ ফাইনালে নিজেকে ঠিক গুছিয়ে উঠতে পারলেন না। বার বার খারাপ ভুল করলেন। সহজ সুযোগ নষ্ট করলেন। হতাশা প্রকাশ করে ফেললেন। কোর্টের এক কোণে রাখা ট্রফিটাও তাতাতে পারছিল না তাঁকে! খেলা শুরুর আগেই রড লেভার এডিনার জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে ওঠে সিনারের জয়ের সম্ভাবনা ৭৭ শতাংশ। জ়েরেভের ২৩ শতাংশ। ম্যাচের বয়স যত এগিয়েছে সেই পূর্বাভাসকে তত সঠিক বলে মনে হয়েছে। ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে সিনারের দাপট। ম্যাচে আড়াই কিলোমিটারের বেশি দৌড়েছেন। ফিটনেস ফিট জ়েরেভের থেকে ৩০০ মিটার বেশি। কোর্টের প্রতিটি কোণে সঠিক সময়ে পৌঁছে গিয়েছেন। প্রতিপক্ষকে চমকে দেওয়া শট নিয়েছেন। নিজের সেরাটা মেলে ধরেছেন স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরতে। সিনার বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন তিনি বিশ্বের এক নম্বর। দেখিয়ে দিয়েছেন দু’নম্বরের সঙ্গে পার্থক্য কতটা।

১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছিলেন বরিস বেকার। জার্মানির কোনও পুরুষ টেনিস খেলোয়াড়ের সেই শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়। তার পর থেকে জার্মানদের সব চেষ্টাই বেকার! জ়েরেভ জিততে পারেন। তাঁর শক্তিশালী লড়াকু টেনিসে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জেতার ক্ষমতা রয়েছে। সিনার পাওয়ার টেনিসের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পের ছোঁয়া মিশিয়ে দিয়েছেন বুদ্ধি করে। র‌্যাকেটের আলগা ছোঁয়ায় বল পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষের কোর্টে। জ়েরেভকে উত্তরহীন থাকতে হয়েছে বেশ কয়েক বার। সিনারের একাধিক উইনার চলে গিয়েছে জ়েরেভের দু’তিন হাত পাশ দিয়ে। নড়তে পারেননি জার্মান তরুণ! গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে এমন দুরবস্থা?

ভুল। জ়েরেভ আসলে একটু দেরিতে ছন্দ পান। অস্ট্রেলিয়ান ওপেনের প্রধান স্পনসর সংস্থার গাড়ির মতো দ্রুত ‘পিকআপ’ নিতে পারেন না। একটু পিছিয়ে শুরু করেন। হয়তো প্রতিপক্ষকে কিছুটা মেপে নিতে চান। কিন্তু সিনারের মতো প্রতিপক্ষেরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেকে সুবিধাজনক জায়গায় নিয়ে চলে যেতে পারেন। দ্বিতীয় সেটে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হল বিশ্বের প্রথম এবং দ্বিতীয় বাছাই খেলোয়াড়ের। দু’জনের র‌্যাকেট থেকেই ছিটকে বেরোল চোখ ধাঁধানো, মন ভাল করে দেওয়া কিছু শট। দু’জনেই চাইলেন প্রতিপক্ষকে কোর্টের এক পাশে ঠেলে দিয়ে জায়গা তৈরি করতে। কখনও সাফল্য এল, কখনও এল না। নিখুঁত ডিপ সার্ভ, ‘এস’ সার্ভিস, ফোরহ্যান্ড, ব্যাকহ্যান্ড, ভলি, ড্রপ শট, টপ স্পিন, নেট প্লে— টেনিসের সব উপাদানে সাজল দ্বিতীয় সেট। টান টান লড়াই হল দুই প্রতিপক্ষের। প্রথম সেটে সার্ভিস খোয়ানোর পর র‌্যাকেট বদলে নেন জ়েরেভ। সেটাই হয়তো তাঁকে লড়াইয়ে ফেরায়। দ্বিতীয় সেটের নিষ্পত্তি হল টাইব্রেকারে। সিনার টাইব্রেকার জিতলেন ৭-৪ ব্যবধানে। ৭২ মিনিটের লড়াইয়ের পর দ্বিতীয় সেট সিনারের পক্ষে ৭-৬। ০-২ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়ে জ়েরেভ সব রাগ, হতাশা উগড়ে দিলেন র‌্যাকেটের উপর।

জ়েরেভ ‘এস’ সার্ভিস করলেন অনেক বেশি। প্রথম সার্ভিসও তুলনায় বেশি ঠিকঠাক করলেন। কিন্তু নিজের সার্ভিসের পয়েন্ট জেতার ক্ষেত্রে অনেকটা পিছিয়ে থাকলেন। আর সেটাই বছরের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালের আসল পার্থক্য গড়ে দিল। তৃতীয় সেটেও সমানে সমানে শুরু করেছিলেন দুই খেলোয়াড়। কিন্তু ষষ্ঠ গেমে জ়েরেভের সার্ভিস ভেঙে দিলেন সিনার। বোধহয় প্রতিপক্ষের অবশিষ্ট আত্মবিশ্বাসটাও। বাকিটা ম্যাচটা হল এক রকম নিয়মরক্ষার। ট্রফির গন্ধ পেয়ে যাওয়া সিনার যেন আরও বিপজ্জনক। জ়েরেভের ম্যাচ বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টাও ফিকে লাগছিল। বাঁ পায়ের হ্যামস্ট্রিংয়ের নাকি সমস্যা নিয়ে ফাইনাল খেলেছেন ইটালীয়! খেলায় অবশ্য তার বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি। প্রভাব পড়তে দেননি। চ্যাম্পিয়নেরা বোধহয় এমনই হন। চোট-আঘাত তুচ্ছ করে লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারেন। শরীরে ব্যথাকে মনের জেদে পরিণত করে এগিয়ে যান। সিনার ৪৪ মিনিটে ৬-৩ ব্যবধানে জিতলেন তৃতীয় সেটও। শুধু ঠান্ডা মাথায় নিজের সার্ভিস ধরে রেখে সেট, ম্যাচ, ট্রফি জিতে নিলেন সিনার।

তৃতীয় গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতলেন ইটালীয়। টানা দু’বার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন। পর পর দু’টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম। রিসিভিং এন্ডে অপেক্ষা আরও বাড়ল জ়েরেভের। ম্যাচ শেষে তাঁর শূন্য দৃষ্টিতেও সেই অপেক্ষার ইঙ্গিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.