ভাঙা পায়ে পন্থের ৫৫ মিনিট! ২৭ বলে ১৭ রান, গড়লেন নজিরও, হার না মানা লড়াইয়ে ছড়ালেন মুগ্ধতা

অনিল কুম্বলে ভাঙা চোয়াল নিয়ে খেলেছিলেন। ঋষভ পন্থ খেললেন ভাঙা পা নিয়ে।

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মাঠে নামলেন পন্থ। ভাঙা পা নিয়েই নেমে পড়লেন ব্যাট করতে! বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল ক্রিকেট বিশ্ব। তাঁকে ঘিরে তৈরি হওয়া নানা জল্পনা, আশঙ্কায় সাময়িক জল ঢেলে দিলেন ভারতীয় দলের সহ-অধিনায়ক।

ডান পায়ের পাতায় এতটাই আঘাত পেয়েছিলেন যে মাঠকর্মীদের গাড়িতে মাঠ ছাড়তে হয়েছিল বুধবার। ১৯ ঘণ্টার ব্যবধানে বৃহস্পতিবার সেই পায়েই হেঁটে মাঠে নামলেন পন্থ! মাঠে নামলেন গোটা স্টেডিয়ামকে দাঁড় করিয়ে। তাঁর জন্য দাঁড়িয়েছিলেন সদ্য আউট হওয়া শার্দূল ঠাকুরও।

ম্যাঞ্চেস্টারে পন্থ আবার ব্যাট করতে পারবেন, এতটা ভাবা যায়নি। যিনি দাঁড়াতেই পারছেন না, তিনি খেলবেন কী করে! ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডও জানিয়ে দিয়েছিল, পন্থের পক্ষে ম্যাঞ্চেস্টারে উইকেট রক্ষা করা সম্ভব নয়। শুভমন গিলদের কি তবে ১০ জনে খেলতে হবে? সিরিজ়ে পিছিয়ে থাকা দল অসম লড়াইয়ের মুখে পড়ে গেল? এমন নানা প্রশ্নের আড়ালে পন্থ ছিলেন অকুতোভয়। বিকাল ৫টা ০৩ মিনিটে শার্দূল আউট হওয়ার পর টেলিভিশনের ক্যামেরা ঘুরে যায় ভারতীয় সাজঘরের দিকে। সকলকে অবাক করে নামলেন পন্থ। দলের জন্য। দেশের জন্য। প্রায় অসম হয়ে যাওয়া লড়াইয়ে জান ফেরালেন।

নিজের ‘জান’ একরকম কবুল করেই নামলেন পন্থ। দোতলার সাজঘর থেকে সিঁড়ি ভেঙে নামতে কষ্ট হচ্ছিল বেশ। মুখে কষ্টের ছাপ ছিল স্পষ্ট। রেলিং ধরে সাবধানে নামলেন সময় নিয়ে। সেই পর্যন্ত মাঠেই অপেক্ষা করেছেন শার্দূল। বাউন্ডারি লাইনে পন্থের দিকে হাত বাড়িয়ে দেন শার্দূল। সতীর্থের হাত এড়িয়ে যান পন্থ! মাঠ ছুঁয়ে প্রণাম করে বাউন্ডারি লাইনের ভিতরে পা রাখলেন। তার পর আবার সাজঘরের দিকে ঘুরে আকাশের দিকে তাকালেন। মেঘলা আকাশের মধ্যে সূর্যকে খুঁজলেন। নমস্কার সেরে এগিয়ে গেলেন পিচের দিকে। এই পুরো সময়টা উঠে দাঁড়িয়ে পন্থকে স্বাগত জানিয়েছেন দর্শকেরা। ক্রিকেটীয় ভদ্রতা দেখিয়ে অপেক্ষা করেছেন বেন স্টোকসেরাও। শার্দূল আউট হওয়ার পর থেকে পন্থের গার্ড নেওয়া পর্যন্ত ২ মিনিটের বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। চাইলে ‘টাইমড আউট’র আবেদন করতে পারতেন স্টোকস। করেননি। প্রতিপক্ষ পন্থের সাহসিকতাকে সম্মান জানিয়েছেন ইংল্যান্ডের ক্রিকেটারেরা।

ব্যাট করতে নামার সময় ঋষভ পন্থ।

সিঁড়ি ভাঙতে বেশ কষ্ট হচ্ছে পন্থের। ডান পায়ের উপর ভর দিতে পারছেন না। মধ্যাহ্নভোজের সময় সাজঘরে পন্থকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বেরিয়ে আসেন আকাশদীপ-সহ কয়েক জন ক্রিকেটার। এই অবস্থাতেও যে ব্যাট করা সম্ভব, তা সম্ভবত তিনিই ভেবেছিলেন। ভারতীয় দলের মেডিক্যাল স্টাফেরা তাঁকে তৈরি করে দিয়েছেন কাজ চালানোর মতো। কিছুটা কৃতিত্ব তাঁদেরও প্রাপ্য। সিঁড়ি ভাঙতে পন্থের যতটা সমস্যা হচ্ছে, সমান মাঠে হাঁটতে ততটা নয়। দৌড়োনোর মতো পরিস্থিতি নেই। ‘জগিং’ করে খুচরো রান নিয়েছেন। আলগা বলের জন্য অপেক্ষা করেছেন। ব্যাট করার সময় পায়ের নড়াচড়াতেও আড়ষ্টতা স্পষ্ট। তবু ইংল্যান্ডকে বাড়তি সুবিধা দিলেন না পন্থ।

আহত পন্থকে ২২ গজের লড়াইয়ে কোনও রকম দয়ামায়া করেননি স্টোকস। নাগাড়ে পন্থের ডান পায়ের জুতো লক্ষ্য করে ইয়র্কার দিয়েছেন। ইংল্যান্ড অধিনায়ক জানতেন, পন্থ দ্রুত পা সরাতে পারবেন না। ইংল্যান্ডের অন্য বোলারেরাও শরীর লক্ষ্য করে বল করেছেন। তবু লড়ে গিয়েছেন পন্থ। ২২ গজের এক প্রান্তে আউট হয়েছেন ওয়াশিংটন সুন্দর, অংশুল কম্বোজেরা। পন্থ অন্য প্রান্ত আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন। পেশাদারিত্বের নিষ্ঠুরতাকে ঠেকিয়ে লড়াই করেছেন।

বুধবার চোট পাওয়ার আগে পর্যন্ত ৪৮ বল খেলে ৩৭ রান করেছিলেন পন্থ। এ দিন মধ্যাহ্নভোজের আগে ১৫ মিনিটে খেলেন ৭ বল। করেন ২ রান। বিরতির পর আরও ৪০ মিনিটে ২০ বল খেলে ১৫ রান করলেন। ভাঙা পা নিয়ে সব মিলিয়ে ৫৫ মিনিট ব্যাট করলেন। ২৭ বলে ১৭ রান করলেন। চার মারলেন। ছয়ও মারলেন। ভারতীয়দের মধ্যে টেস্টে সবচেয়ে বেশি ছয় মারার রেকর্ড গড়লেন। অর্ধশতরান করলেন! আর্চারের বলে বোল্ড হলেন বলের লাইন ‘মিস’ করে। ঠিক যে ভাবে আউট হয়েছিলেন লর্ডসে। তবু সাজঘরে ফেরার সময় কোচ-সতীর্থেরা তাঁকে স্বাগত জানিয়েছেন উঠে দাঁড়িয়ে। কেনই বা জানাবেন না? প্রায় এক ঘণ্টা ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে অবিশ্বাস্য মুগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছিলেন যে।

ভাঙা পা নিয়েও আগ্রাসী মেজাজে ব্যাট করলেন ঋষভ পন্থ।

পন্থের লড়াইয়ে শারীরিক সক্ষমতায় ঘাটতি থাকলেও আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল না। সাবলীল থাকার চেষ্টা করেছেন প্রতিটি বলে। বলের লাইনে গিয়ে খেলার চেষ্টা করেছেন। ভারতীয় সাজঘরে তাঁর এই লড়াই হয়তো অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। ভারতীয় ক্রিকেটেও লোকগাথা হয়ে থাকতে পারে ভাঙা পা নিয়ে তাঁর লড়াই। এমন নজির আগে নেই, তা নয়। কুম্বলে ছাড়াও অনেকে আছেন। নরি কনট্রাক্টর ভাঙা পাঁজর নিয়ে খেলেছেন। দিলীপ দোশী পায়ের ভাঙা পাতা নিয়ে খেলেছেন। গুরুতর চোট নিয়ে খেলার নজির রয়েছে কপিল দেব, বিজয় মঞ্জরেকরেরও। প্রতিটি ঘটনা সতীর্থদের এবং পরবর্তী প্রজন্মকে অনুপ্রণিত করেছে। সেই তালিকায় উজ্জ্বল উপস্থিতি থাকল পন্থেরও।

‘লগান’ সিনেমায় সাহেবদের বিরুদ্ধে পায়ের আঘাত পেয়েও ব্যাট হাতে লড়ে গিয়েছিল ‘ইসমাইল’। সেই ইংরেজদের বিরুদ্ধেই মরিয়া লড়াই করলেন আহত পন্থ। ওয়াশিংটন আউট হওয়ার পর ধরে খেলার সুযোগ ছিল না। চালিয়ে খেলে যতটা সম্ভব রান তুললেন। টেলএন্ডারদের আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন। পন্থ হয়তো ব্যাট হাতে দলকে অনেকটা এগিয়ে দিতে পারলেন না। তবে শুভমনদের সাজঘর আত্মবিশ্বাসে ভরে দিলেন। সিরিজ়ে সমতা ফেরানোর জেদ বাড়িয়ে দিলেন। যে আত্মবিশ্বাস, জেদের প্রতিফলন দেখা গিয়েছে দশম উইকেটে জসপ্রীত বুমরাহ-মহম্মদ সিরাজের জুটিতে।

বৃহস্পতিবার পন্থের ১৭ রান ভারতকে খুব বেশি স্বস্তি হয়তো দেবে না। তবে সাহস দেবে। পন্থ দেখিয়ে দিলেন এ ভাবেও লড়া যায়। এ ভাবেও পারা যায়। ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে আসা পন্থ আরও একবার প্রমাণ করলেন নিজেকে। প্রমাণ করলেন তিনি আসলে সাহসী। হার না মানা এক যোদ্ধা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.