‘রামায়ণ’-এর মতো ‘নির্মাণ/নির্মিতি’ না রচিত হলে, মধুসূদনের ‘বিনির্মাণ’ মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১) কখনোই রচিত হতো না। সৃজনশীল মানুষ সবসময় ‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ই হন। মাইকেলও তাই হয়েছেন। তাঁর সূত্র ইয়োরোপীয় নবজাগরণ, যা অনেক ‘পন্থা’ বা ‘মতবাদ’-এরও জনক। আর তাছাড়া মেকলে সাহেবের অপচেষ্টা (১৮৩৫) তো ছিলই। কিন্তু সব ছাপিয়ে বাংলার নবজাগরণ যতই ঘনীভূত হতে থাকলো, ততই দেখা গেল, তা রূপে-রসে-বৈশিষ্ট্যে হিন্দু-নবজাগরণ। রামমোহন-বিদ্যাসাগর-শ্রীরামকৃষ্ণ-বঙ্কিম-বিবেকানন্দ-শ্রীঅরবিন্দ-রবীন্দ্রনাথ কেউই বাদ ছিলেন না সেই পর্বে। তা আলাদা করে আলোচনার বিষয়। সে এক চৈতন্যের পর্ব। ‘ইয়ং-বেঙ্গল’-এর বিগড়ানো সদস্যরা গরুর মাংস খেয়ে এককালে হিন্দুদের উঠোনে হাড় ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিলেও, শেষকালে মত পরিবর্তন করেছিলেন অনেকে। কারণ, সেটাও চলতি হাওয়ার পন্থী। ‘রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ ম্যাজিক’। মাইকেলের ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতি অসম্ভব ঘৃণা আর ইউরোপীয় সংস্কৃতির প্রতি অতি আদিখ্যেতার আকাঙ্ক্ষা — তাকে না করেছে ঘরের লোক, না বাইরের! শেষ পর্যায়ে তিনি নিজের হাতে সমাধি-লিপি লিখেও ‘মাইকেল মধুসূদন’ থেকে ‘শ্রীমধুসূদন’ হয়ে উঠে বাঙালি হিন্দুদের বিশ্বাস করাতে পারেন নি। পরিবর্তন করতে যে আত্মবিশ্বাস লাগে, তা তখন তাঁর অবশিষ্ট ছিল না। ‘মহীর পদে মহানিদ্রাবৃত দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন’ — এটা এপিটাফেই থেকে গেল শেষ পর্যন্ত, কবরেই রয়ে গেলেন৷ তিনি ‘শ্রীমধুসূদন’ হয়ে পঞ্চভূতে বিলীন হতে পারেন নি। যদিও এ কথা বলাবাহুল্য তাঁর নায়ক মেঘনাদও কিন্তু হিন্দু মতে পঞ্চভূতে বিলীন হয়েছিলেন। খ্রীস্টানরা নিজের দেশকে ‘পিতৃভূমি’ বলেন, ‘মাতৃভূমি’ নয়। এই সমাধিলিপিতে মাইকেল যতই মাতৃভূমির কথা লিখুন, ‘জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম’, ‘নবজাগরণ’-এর বাঙালি বিশ্বাস করবে কেন! আমি নিজে কী, আমি নিজেই কী জানি! যারা ‘মাইকেলকে ব্যবহার’ করে এসেছেন, তাদের প্রচারের দৌলতে এই ‘সুন্দর বিনির্মাণ’, বিশ্বাস করি, চাই না করি, সাহিত্য সৌন্দর্যের তারিফ না করে পারি না। পাশাপাশি এটাও মনে রাখি, ‘হিন্দু’ নয় তিনি ‘খ্রিস্টান’ হয়ে লিখেছিলেন। জানি না, শেষ জীবনে কতটা অশ্রুপাত করেছিলেন তিনি।
@কচ
![](https://ritambangla.com/wp-content/uploads/2025/02/WhatsApp-Image-2025-02-08-at-9.26.33-PM-682x1024.jpeg)