ইউক্রেন যুদ্ধের আবহে রাশিয়ার থেকে তেল কেনার ‘শাস্তি’ হিসাবে ভারতীয় পণ্যের উপর জরিমানা-সহ মোট ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা চাপিয়েছে আমেরিকা। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এমন পদক্ষেপের পরেও ভ্লাদিমির পুতিনের দেশ থেকে থেকে তেল কেনা বন্ধ করেনি নরেন্দ্র মোদীর সরকার। অদূর ভবিষ্যতে তার কোনও সম্ভাবনাও নেই বলে মনে করছেন কূটনীতি এবং বণিকমহলের অনেকেই।
কারণ, তথ্য-পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট গত সাড়ে তিন বছরে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়ার থেকে তেল আমদানি করায় বিপুল আর্থিক সাশ্রয় হয়েছে ভারতের। সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে গত ৩৯ মাসে রাশিয়া থেকে অশোধিত তেল আমদানি করে অন্তত ১২৬০ কোটি ডলার (১ কোটি ১১ লক্ষ টাকারও বেশি) মুনাফা করেছে ভারত! প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের কথা ঘোষণা করেছিলেন পুতিন। তার পরেই আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলির রাশিয়ার বিরুদ্ধে আর্থিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করেছিল।
যদিও তাতে গুরুত্ব না দিয়ে গত সাড়ে তিন বছর ধরে নয়াদিল্লি-মস্কো বাণিজ্যিক লেনদেন চলেছে সমানতালে। গত অর্থবর্ষের (২০২৪-২৫) ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার সার্বিক বাণিজ্যের পরিমাণ বেড়ে পৌঁছেছে ৬৮০০ কোটি ডলার (প্রায় ৬ লক্ষ কোটি টাকা)। তার মধ্যে ভারত থেকে রাশিয়ায় রফতানি করা হয়েছে ৪৯০ কোটি ডলারের (৪২ হাজার কোটি টাকা) পণ্য। আর রাশিয়া থেকে ভারত আমদানি করেছে ৬৩০০ কোটি ডলারের (প্রায় ৫ লক্ষ ৫০ হাজার কোটি টাকা) পণ্য। যার বড় অংশই সামরিক সরঞ্জাম এবং অশোধিত তেল। বস্তুত ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই রুশ অশোধিত তেলের ক্রেতা ভারত। তবে আগে রাশিয়া থেকে তারা কম তেল আমদানি করত। ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পরে আমদানির পরিমাণ বেড়েছে। তেল আমদানিকারী দেশ হিসাবে সারা বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। এই মোট আমদানির ৩৫ শতাংশই এখন আসে রাশিয়া থেকে।
আগে খনিজ তেলের জন্য ভারত মূলত নির্ভর করে থাকত সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির উপর। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্বের দেশগুলি একাধিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল রাশিয়ার উপর। বিক্রি বাড়াতে রাশিয়া সস্তায় এবং অধিক ছাড়ে তেল বিক্রি শুরু করেছিল। ভারত তখন থেকেই রাশিয়ার তেল আমদানি বাড়িয়ে দেয়। এক ধাক্কায় ২ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে পৌঁছে যায় ভারতের আমদানির পরিমাণ। এতে নয়াদিল্লির অনেক সাশ্রয় হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমি দুনিয়া এই পদক্ষেপকে ভাল চোখে দেখেনি। কিন্তু রুশ তেলে ভারতের শোধনাগারগুলির লক্ষ্মীলাভ হয়েছে।
প্রকাশিত রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০২২-২৩ অর্থবর্ষে ভারত ১৬২২ কোটি ডলারের তেল আমদানি করেছিল। রাশিয়ার তেল না কিনে অন্য দেশ থেকে কিনলে এই খরচ আরও ৪৮৭ কোটি ডলার বেশি পড়ত। ২০২৩-২৪ অর্থবর্যে রাশিয়ার তেলের দাম কিছুটা বাড়লেও আমদানি বাড়ায় সাশ্রয় দাঁড়ায় ৫৪১ কোটি ডলার। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ছাড় নেমে আসে মাত্র ২.৮ শতাংশে। এতে সাশ্রয় হয় মাত্র ১৪৫ কোটি ডলার। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষএ ছাড় কিছুটা বাড়ার ফলে প্রায় ৮৪ কোটি ডলার সাশ্রয় হয়েছে। প্রথম ত্রৈমাসিকের শেষপর্বে রুশ তেল আমদানি কিছুটা কমলেও অগস্ট থেকে তা বাড়তে শুরু করেছে আবার। তবে ব্রোকারেজ় সংস্থা সিএলএসএ-র গত মাসের রিপোর্ট বলছে, রুশ তেলে বর্তমান ছাড় নয়াদিল্লির কাছে ততটা লাভজনক নয়। এমনকি, রাশিয়ান তেলের দাম প্রতি ব্যারেলে ৬০ ডলারে নেমে গেলেও, বিমা থেকে শুরু করে শিপিং এবং রিস্ক প্রিমিয়ামের মতো একাধিক খরচের কারণে, ভারত কম সুবিধা পায়। ২০২৩-২৪ সালে গড় ছাড় ছিল প্রতি ব্যারেল প্রায় ৮.৫ ডলার। যা এখন কমে প্রতি ব্যারেলে মাত্র ৩ ডলারে এসেছে।