নাম থেকেই বোঝা যায়, এই ধরনের স্পিকার ব্যবহার করলে বাইরের শব্দ কানে ঢোকে না খুব একটা। সে কারণেই ‘নয়েজ় ক্যানসেলিং’ হেডফোন বা ইয়ারফোনের চাহিদা বাড়ছে। বিশেষ করে কমবয়সিরা এখন এই ধরনের হেডফোনই বেশি ব্যবহার করছেন। অনেকেরই ধারণা, সাধারণ হেডফোনের তুলনায় নয়েজ় ক্যানসেলিং’ হেডফোন বা ইয়ারফোন অনেক বেশি সুরক্ষিত। তা কি আদৌ ঠিক? চিকিৎসকেরা কিন্তু অন্য কথা বলছেন।
‘নয়েজ় ক্যানসেলিং’ হেডফোনের স্পিকার এমন ভাবে তৈরি, যাতে বাইরের শব্দ ভিতরে না ঢোকে। অর্থাৎ এই হেডফোন কানে দিলে আপনি বাইরের কোলাহল বা শব্দ শুনতে পাবেন না। ট্রেনে বা বিমানে যাঁরা লম্বা সফর করেন, তাঁরা এমন হেডফোন বা ইয়ারফোনই বেশি ব্যবহার করেন। অনেককেই বলতে শুনবেন, ‘নয়েজ় ক্যানসেলিং’ ইয়ারফোন বা হেডফোন ব্যবহার করলে ক্লান্তি কেটে যায়, ঘুমও নাকি ভাল হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গিয়েছে, এমন হেডফোনও কিন্তু কানের জন্য ক্ষতিকর।
তা কী রকম?
দেশের ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেল্থ’-এর গবেষণা অনুযায়ী, হেডফোন বা ইয়ারফোনে ‘অ্যাকটিভ নয়েজ় কন্ট্রোল’ প্রযুক্তি ব্যবহার করার কথা বলা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তা আদৌ বিজ্ঞানসম্মত নয়। বাইরের শব্দ না ঢুকলেও, এমন হেডফোনে উচ্চস্বরে কেউ যদি গান চালিয়ে শোনেন, তা হলে কানের ক্ষতি হতে বাধ্য। একটানা এমন হেডফোন ব্যবহার করলে মস্তিষ্কের উপরে চাপ পড়বে। ক্ষতি হবে স্নায়ুরও।
কোনও রকম হেডফোন বা ইয়ারফোনকেই সুরক্ষিত বা নিরাপদ বলতে চান না নাক-কান-গলার (ইএনটি) রোগের চিকিৎসক অমিতাভ ভট্টাচার্য। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “সবটাই বিজ্ঞাপনী চমক। কমবয়সিদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা মাত্র। নয়েজ় ক্যানসেলিং হেডফোন বা ইয়ারফোন বলে যা বিক্রি হয়, তার সবগুলি বিজ্ঞানসম্মত ভাবে তৈরি হয় না। ফলে শব্দমাত্রা যদি ৮০ ডেসিবেল ছাড়িয়ে যায়, তা হলে কানের ক্ষতি হবেই।”
কতটা ক্ষতি হয় কানের?
সারা ক্ষণ হেডফোন কানে গুঁজে রাখলে একটানা শব্দে অন্তঃকর্ণের ককলিয়া অংশটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কানের কোষগুলি নষ্ট হতে থাকে। শুকিয়ে যেতে থাকে কানের ফ্লুইড। কান যে হেতু সারা শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে, তাই কানের ক্ষতি হওয়া মানে তার প্রভাব পড়বে মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতেও। চিকিৎসক অমিতাভবাবুর কথায়, “নয়েজ় ক্যানসেলিং হেডফোন একটা গালভরা নাম। মানে আমি বিয়েবাড়িতেও খাব, আবার হজম করতে অ্যান্টাসিডও খাব। তাতে আর কী লাভ? যে কোনও হেডফোনই যদি ১৫ মিনিটের বেশি কানে গুঁজে রাখা হয়, তা হলে অন্তঃকর্ণের যে পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা সহজে সারানো সম্ভব হবে না।”
এ বিষয়ে একমত নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ইএনটি এবং হেড-নেক সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক প্রণবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তিনি বলেন, “হেডফোন বা ইয়ারফোন যত উন্নত প্রযুক্তিরই হোক না কেন, তাতে একটানা গান শুনলে বা কথা বললে, কানের সূক্ষ্ম কোষ নষ্ট হয়ে যায়। প্রচণ্ড কম্পাঙ্কের শব্দকে কানের কোষগুলি ইলেকট্রিকাল ইমপালসে বদলে দেয়। তখন কানের কোষগুলি হয় আচমকাই কাজ করা কমিয়ে দেয়, না হলে একেবারেই বন্ধ করে দেয়। এর নানা রকম প্রভাব পড়ে শরীরে।”
এ ক্ষেত্রে কানের ক্ষতি হতে পারে দু’রকম ভাবে। চিকিৎসকের কথায়,
এক, ‘টেম্পোরারি থ্রেশহোল্ড শিফ্ট’ অর্থাৎ, কম সময়ের জন্য কানে শুনতে না পাওয়া অথবা কান ভোঁ-ভোঁ করা। এই সমস্যা তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যায়।
দুই, ‘পার্মানেন্ট থ্রেশহোল্ড শিফ্ট’, যাতে পাকাপাকি ভাবে কানের ক্ষতি হয়। বধিরতা চিরস্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
তা হলে সমাধান কিসে?
হেডফোন বা ইয়ারফোনের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব নয়। কর্মক্ষেত্রেও অনেককেই তা ব্যবহার করতে হয়। বিশেষ করে কলসেন্টারে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের সর্ব ক্ষণ হেডফোন ব্যবহার করতে হয়। সে ক্ষেত্রে সমাধানের উপায় হিসেবে চিকিৎসকেরা পরামর্শ দিলেন, হেডফোন বা ইয়ারফোনের ব্যবহার কমাতে হবে। কাজের জায়গায় ব্যবহার করতে হলে একটানা করবেন না। ২০ মিনিট অন্তর কানকে বিশ্রাম দিন। অন্তত ১৫-২০ মিনিটের জন্য হেডফোন খুলে রাখুন বা ইয়ারফোনে কিছু শোনা বন্ধ করুন।
কাজের জায়গা থেকে ফিরে আর হেডফোন, ইয়ারফোন বা ব্লু-টুথ স্পিকার কানে লাগিয়ে রাখবেন না। ফোনে কথা বলতে হলে এমনিই বলুন। তাতেও ক্ষতি কম হবে।
দরকার যখন নেই, তখন এ সবের ব্যবহার না-ই বা করলেন। খুব প্রয়োজন ছাড়া কানে উচ্চস্বরের শব্দ সব সময়ে ঢুকতে থাকলে, ভবিষ্যতে বড়সড় শারীরিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। শ্রবণশক্তি নষ্টও হয়ে যেতে পারে।