ফুটবলার নেই, বিপণন নেই, সম্প্রচার নেই, সমন্বয় নেই, সময়সূচি নেই! কলকাতা লিগ আছে কেন? সেটাই প্রশ্ন

প্রশ্ন কঠিন। বিশ্বের কোন ফুটবল লিগে গত বারের চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হওয়ার আগেই নতুন মরসুম শুরু হয়ে যায়? উত্তর সহজ। কলকাতা লিগ।

গত বছরের লিগে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে। ভবানীপুর এবং ডায়মন্ড হারবার ওয়াকওভার দেওয়ায় ৪৭ পয়েন্টে শেষ করেছিল লাল-হলুদ। কিন্তু আইএফএ-র সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা করে ডায়মন্ড হারবার। আদালত জানায়, এখনই ইস্টবেঙ্গলকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা যাবে না! তার পর থেকে বেশ কয়েক বার শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও হয়নি। আইএফএ, ডায়মন্ড হারবার বা ইস্টবেঙ্গল— কেউই বাড়তি উদ্যোগ দেখায়নি, যাতে বিজয়ীর নামটা ঘোষণা করা হয়। সময় গড়িয়েছে। নতুন মরসুম শুরু হয়ে গ্রুপ পর্বও শেষ। এখনও গত বারের বিজয়ী নির্ধারিত হয়নি। কবে হবে তা-ও অজানা।

আরও হাজারো প্রশ্ন আছে কলকাতা লিগ নিয়ে, যার জবাব খুঁজতে হিমসিম বাংলার ফুটবল নিয়ামক সংস্থা আইএফএ। মূল প্রশ্ন, কলকাতা লিগকে আদৌ আর কোনও দল গুরুত্ব দেয়? না কি এই লিগ স্রেফ একটি ‘প্রহসন’? খেলতে হয় বলে খেলা?

ময়দানের একাংশ বলছে, সমস্যার মূলে নাকি ডায়মন্ড হারবার। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্লাব বলে ডায়মন্ড হারবার নাকি ময়দানে ‘দাদাগিরি’ করছে! সেই মনোভাব থেকেই নাকি তাদের আদালতে যাওয়া। কিন্তু পাল্টা যুক্তি বলছে, ডায়মন্ড হারবার তো হালে কলকাতা লিগে খেলছে। তার অনেক আগেই তো প্রতিযোগিতার বারোটা বেজে গিয়েছে!

কলকাতা? নাকি উত্তর ২৪ পরগনা লিগ?

কলকাতা লিগের বেশির ভাগ ম্যাচ হয়েছে ব্যারাকপুর, কল্যাণী, নৈহাটিতে। জেলায় জেলায় ফুটবল ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানের ম্যাচও ওই সব মাঠে দেওয়া হয়েছে। মোহনবাগানের সভাপতি দেবাশিস দত্তের প্রশ্ন, ‘‘কেন কলকাতা ময়দান থেকে লিগ সরে যাবে? ওখানে স্থানীয় সমর্থকেরা ছাড়া হাতেগোনা কয়েক জন খেলা দেখতে যান। লিগের আকর্যণ ফেরাতে কলকাতায় সব ম্যাচ করা উচিত।’’ কিন্তু কলকাতায় লিগের ম্যাচ হবে কী করে? মোহনবাগান ক্লাবই তো মাঠ দেয় না! দেবাশিসের জবাব, ‘‘আমাদের মাঠে ক্রিকেট হয়। সেই সময়ে অন্য খেলা হলে পিচের ক্ষতি হবে। মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত হকি চলে। হকির মাঠ আর ফুটবলের মাঠ আলাদা। হকি শেষ হলে সেই মাঠকে ফুটবলের উপযুক্ত করে তোলার জন্য আড়াই-তিন মাস সময় লাগে।’’ তবে মজার ব্যাপার হল, মাঠ না-পেয়ে আইএফএ সচিব অনির্বাণ দত্ত কিন্তু ক্ষুব্ধ নন। তিনি বললেন, ‘‘মাঠ ঠিক করতে গেলে যে সময় দরকার, সেটা ক্লাবগুলো সত্যিই পায় না। এই বছর বৃষ্টির জন্য আরও দেরি হয়েছে। তা ছাড়া মোহনবাগান এএফসি-তে (আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা) খেলার জন্য নিজেদের মাঠে যদি অনুশীলন করতে চায়, রাজ্য সংস্থা হিসাবে সেটা দেখা আমাদের কর্তব্য। আর জেলাতেও তো খেলা ছড়িয়ে দেওয়া দরকার।’’

জুজুর নাম আইএসএল

২০১৪ সালে আইএসএল চালু হওয়া কলকাতা লিগের কাছে প্রথম ধাক্কা। আইএসএলে জৌলুস যত বেড়েছে, তত সমস্যায় পড়েছে কলকাতা লিগ। গুরুত্ব রয়েছে আই লিগেরও। সেখানে কলকাতা লিগের না আছে জৌলুস, না আছে গুরুত্ব। প্রায় সব ক্লাব এই বিষয়ে একমত— আইএফএ-কে লিগ বিপণন করতে হবে। প্যাকেজিংটা ঠিক না হলে আকর্ষণ বাড়বে না। মোহনবাগান সভাপতি দেবাশিসের কথায়, ‘‘সত্তর দশকে পড়ে থাকলে হবে না। এখন ছেলে-মেয়েরা মোবাইলে খেলছে। তারা বিদেশের লিগ দেখছে। তাদের চাকচিক্য চাই। সেটা আইএসএল দিতে পারছে। আইএসএলে আমাদের ম্যাচে যে পরিমাণ দর্শক হয়, তার ৮০ শতাংশের বয়সই পঁয়ত্রিশের নীচে। তারা কেন লিগের খেলা দেখতে যাবে?’’ ইস্টবেঙ্গলের কর্তা দেবব্রত সরকার আবার ‘গঠনমূলক সমালোচনা’র পক্ষে। তাঁর বক্তব্য, ‘‘কে যোগ্য, কে অযোগ্য, সেই বিতর্কে যাচ্ছি না। আমরা অহেতুক সমালোচনা করি না। গঠনমূলক সমালোচনা করি। আইএফএ আরও পেশাদার হোক। লিগের বাণিজ্যিকরণ করুক।’’

মোহন-ইস্টের আইএসএল গমন

মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের আনুষ্ঠানিক ভাবে আইএসএলে যোগদানের দিনই কলকাতা লিগের কফিনে শেষ পেরেক পোঁতা হয়ে গিয়েছিল। তত দিনে সর্বভারতীয় ফেডারেশন ঘোষণা করে দিয়েছে, আইএসএলই দেশের এক নম্বর লিগ। ফলে বাকি প্রতিযোগিতা নিয়ে ক্লাবগুলিরও আগ্রহ কমে গিয়েছিল। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল কয়েক বছর আগে থেকে কলকাতা লিগকে দেখতে শুরু করেছে জুনিয়র দলের প্রতিযোগিতা হিসাবে। কোভিডের পর থেকে সিনিয়র ফুটবলারদের কলকাতা লিগে খেলার প্রবণতা একেবারেই কমে যায়। দুই প্রধানই কলকাতা লিগে খেলার জন্য প্রথম দলের কোনও ফুটবলার ছাড়তে রাজি হয় না। তাই শুভাশিস বসু, শৌভিক চক্রবর্তী, প্রীতম কোটালদের আর কলকাতা লিগে খেলতে দেখা যায় না। অনেকে বলছেন, ইচ্ছা থাকলেও উপায় থাকে না। আইএসএলের ক্লাবগুলি ফুটবলারদের সঙ্গে এমন ভাবে চুক্তি করে, যাতে তাঁরা অন্য কোনও লিগে খেলতে না পারেন। ফুটবলাররা আইএসএল থেকে অর্থও পান বেশি। তাই কলকাতা লিগে খেলতে প্রথম সারির কোনও ফুটবলারের আগ্রহ থাকে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ময়দানের ছোট একটি ক্লাবের কর্তার কথায়, “আগে বড় খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে খেলতে গিয়ে আমাদের ছেলেরাও কিছু শিখতে পারত। এখন তিন প্রধানই জুনিয়রদের খেলায়। শেখার কিছু নেই! উল্টে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে আমাদের খেলোয়াড় পুষতে হয়। কেন ভাল খেলোয়াড় কিনতে অর্থ ঢালব?”

কলকাতা লিগের দুরবস্থার দৃশ্য। চোট পাওয়া ফুটবলারের পায়ে ছাতা দিয়ে ব্যান্ডেজ়‌!

দেবব্রতের অবশ্য দাবি, ‘‘লিগ থেকেই বিষ্ণু, সায়ন, তন্ময়রা উঠে এসেছে। লিগ সাপ্লাই লাইন হতে পারে। তাই লিগের গুরুত্ব কমেনি।’’ পাশাপাশিই তাঁর স্বীকারোক্তি, ‘‘এটা ঘটনা, আগে সব প্রতিযোগিতায় একটাই দল খেলত। কিন্তু এখন ভাগ হয়ে গিয়েছে। মোহনবাগানকে অনুরোধ করব, তারাও প্রথম দল খেলাক।’’ নিরুপায় অনির্বাণ বললেন, ‘‘বড় দুটো দলই লিগে রিজার্ভ টিম খেলায়। জৌলুস তো কমবেই। কিন্তু কারা কাদের খেলাবে, সেখানে তো আইএফএ নাক গলাতে পারে না।’’

আইএফএ-র অপেশাদারিত্ব

এত বছরের প্রাচীন লিগের কোনও নিজস্ব ওয়েবসাইট নেই। লিগের পয়েন্ট তালিকা, কে ক’টি ম্যাচ খেলেছে, কার ক’টি গোল, জানতে গেলে বেসরকারি ওয়েবসাইটের দ্বারস্থ হতে হয়। সেখানেও সঠিক তথ্য পাওয়ার কোনও নিশ্চয়তা নেই। আইএফএ সচিব অবশ্য বলছেন, ‘‘ওয়েব সাইটের সংস্কারের কাজ চলছে। তবে আমাদের ফেসবুক পেজে সব তথ্য পাওয়া যায়।’’ সূচি নিয়েও ডামাডোল। লিগ নিয়ে কোনও পরিকল্পনা নেই। সূচি প্রকাশ করা হয় মাত্র কয়েক দিনের। সেই সূচিও বার বার বদল করা হয় বিভিন্ন ক্লাবের চাপে। হঠাৎ খেলতে রাজি না-হওয়া, ম্যাচের আগের দিন নাম তুলে নেওয়া, অন্য ক্লাবকে ‘সুবিধা’ করে দেওয়া— সবই রয়েছে।

উদাহরণ ১

২০২১ সালের কলকাতা লিগে প্রথম ম্যাচে জর্জ টেলিগ্রাফের বিরুদ্ধে দলই নামায়নি মোহনবাগান। তৎকালীন মোহনবাগান সিইও দাবি করেছিলেন, আগেই চিঠি দিয়ে আইএফএ-কে অসুবিধার কথা জানিয়েছিলেন। আবার আইএফএ জানিয়েছিল, তারা ম্যাচের আগের দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত চিঠি পায়নি। কড়া পদক্ষেপ করারও হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। ওই পর্যন্তই।

উদাহরণ ২

কাহিনি ২০২২ সালের। আইএফএ-র থেকে তখন মোহনবাগানের বকেয়া ছিল ৬০ লক্ষ টাকা। তৎকালীন সচিব দেবাশিস দত্ত স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, বকেয়া না মেটালে কলকাতা লিগে খেলবেন না। আইএফএ জানিয়েছিল, মোহনবাগানের সঙ্গে তারা আলোচনায় বসতে ইচ্ছুক। পরে বকেয়া টাকাও মিটিয়েছিল। লিগে খেলেছিল মোহনবাগান।

উদাহরণ ৩

২০২৩ সালে হঠাৎ কলকাতা লিগের ডার্বির দিন ঘোষণা করায় প্রতিবাদ জানিয়েছিল মোহনবাগান। দিন পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করার পাশাপাশি ম্যাচটি নৈহাটি থেকে যুবভারতীতে আনার আবেদন করা হয়। কোনওটিই শোনা হয়নি। ফলে ম্যাচের দিন মোহনবাগান দল নামায়নি। ইস্টবেঙ্গল মাঠে ছিল। এক ঘণ্টা অপেক্ষার পর ইস্টবেঙ্গলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়।

উদাহরণ ৪

এ বছরেই ডুরান্ডের খেলা থাকায় মেসারার্সের বিরুদ্ধে দল নামায়নি মোহনবাগান। চিঠি দিয়ে আপত্তির কথা জানালেও আইএফএ ম্যাচের দিন বদল করতে রাজি হয়নি। মোহনবাগানের ফুটবলারেরাও ম্যাচের দিন আসেননি।

সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল ভবানীপুর বনাম ইউনাইটেড এসসি ম্যাচ। যে ম্যাচের সঙ্গে পাকেচক্রে ভাগ্য জড়িয়েছিল ডায়মন্ড হারবারের। ঘটনাপ্রবাহে খানিক বিরক্ত এক বড় ক্লাবের কর্তা বলছিলেন, ‘‘বছরে এক বার সূচি তৈরি হোক। তার পর কোনও পরিস্থিতিতে কোনও দাদার কথা শোনা হবে না! এক মাত্র দেশের খেলা থাকলে সূচি বদলাতে পারে।’’ তবে আইএফএ আবার মানতেই রাজি নয যে, বার বার সূচি বদলায়! সচিবের কথায়, ‘‘বিরাট বদল তো এ বার কিছু হয়নি? কোনও ম্যাচে পুলিশ পাওয়া না গেলে আমাদের কিছু করার নেই। ডুরান্ডের জন্য সূচি বদলাতে হয়েছে।’’

লিগের মাঝখানে ডুরান্ড হওয়া নিয়েও অনুযোগ রয়েছে। বড় ক্লাবের এক কর্তার কথায়, ‘‘ডুরান্ডের জায়গা দিল্লি। ওটা লিগের মধ্যে কলকাতায় করলে লিগের সঙ্গে তুলনা হবেই। আর যেহেতু সময়ের হিসাবে ডুরান্ড লিগের চেয়ে কম সময়ের, তাই আকর্ষণও থাকবে। ডুরান্ড আবার দিল্লিতে ফেরানো হোক।’’ যা শুনে হাঁ-হাঁ করে উঠে আইএফএ সচিব বলে দিলেন, ‘‘ডুরান্ড এখানেই হবে। রাজ্য সরকার এই প্রতিযোগিতার পৃষ্ঠপোষক। সেনার সঙ্গে আমাদের এটুকু মানিয়ে তো নিতেই হবে! কলকাতার মতো ফুটবল-উন্মাদনা আর কোথাও নেই। তাই ডুরান্ড এখানেই হওয়া ভাল।’’

সম্প্রচারও হয় না আর

কলকাতা লিগে কোনও স্পনসর নেই। বছর কয়েক আগেও সম্প্রচারের জন্য বিনোদন চ্যানেল বা সংবাদ চ্যানেল, কেউ না কেউ অন্তত দুই বা তিন প্রধানের ম্যাচগুলোর সম্প্রচার করত। এখন হাল এতই খারাপ, যে কাউকে পাওয়া যায় না। এ বছরে একটি বেসরকারি অ্যাপ সম্প্রচার করছে বটে। কিন্তু সেখানে খেলা দেখা নিয়ে বিস্তর সমস্যা। ক্যামেরার গুণমান থেকে ধারাভাষ্য, সবেতেই যত্নের অভাব। কলকাতা লিগের খেলা দেখার জন্য অ্যাপের দক্ষিণাও খুব কম নয়। প্রায় নামী এবং প্রতিষ্ঠিত অ্যাপগুলির মতোই। সচিব অনির্বাণ অবশ্য অনড়, ‘‘এখন অ্যাপের যুগ। টাকা দিয়েই তো খেলা দেখতে হবে। মাঠে গিয়ে খেলা দেখতেও তো টাকা লাগে। সাপোর্টাররা ফুটবলের জন্য, তাঁদের প্রিয় দলের জন্য টাকা খরচ করবেন না? টিভি চ্যানেলগুলো আইএফএ-কে টাকা দিয়ে খ‌েলা দেখাবে না। আর ওই অর্থ জোগাড় করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।’’

তা হলে কী দাঁড়াল? রেকর্ড অক্ষুন্ন রইল কলকাতা লিগের। কারণ, কলকাতা ফুটবল লিগ হল বিশ্বের একমাত্র ফুটবল লিগ, যেখানে গত বারের চ্যাম্পিয়ন নির্ধারিত হওয়ার আগেই নতুন মরসুম শুরু হয়ে যায়!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.