রামভক্তি দেখিয়ে বহু নৃত্যশিল্পী দিল্লি গিয়ে সরকারি আনুকূল্য লাভ করতে চান: মল্লিকা

তাঁর ঘুঙুরের ছন্দ বলছে তিনি কলকাতায় মেয়েদের শরীরে আগুন ধরিয়ে দিতে এসেছেন। নীল রেশমি ধুতি আর কালো চোলি টপের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসছে সেই পরিচিত প্রতিবাদের ঐতিহ্য। তিনি মল্লিকা সারাভাই, বিক্রম সারাভাই-মৃণালিনী সারাভাইয়ের সন্তান। ভরতনাট্যম তাঁর কাছে শুধু নাচ নয়, মন খুলে বলা কথার ভাষা। ভারতীয় বিদ্যাভবন এবং জেএল মেহতা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ভারতীয় ধ্রুপদী নৃত্য উৎসব ‘নৃত্যগাথা’-য় যোগ দিতে তিনি কলকাতায়। এক ঐতিহ্যের মুখোমুখি হল আনন্দবাজার অনলাইন।

প্রশ্ন: কী চমৎকার উপস্থাপনার সাক্ষী থাকলাম। মঞ্চে আপনার মা মৃণালিনী স্বামীনাথনের কথা বলছিলেন। তাঁর অন্তঃকরণে তো ছিল রবীন্দ্রনাথের ধারা?

মল্লিকা: একেবারেই। আমার মা রবীন্দ্রনাথকেই কিন্তু গুরু মানতেন। আবার আমার বাবার পরিবারের সঙ্গে ঠাকুরবাড়ির নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। ওঁরা আসতেন আমাদের বাড়িতে, থাকতেন। সারাভাই আর স্বামীনাথনের পরিবার ঠাকুর পরিবারের খুব কাছাকাছি ছিল। (গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথের গান)

প্রশ্নগুনগুনিয়ে গাইছেনআপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত জানেন?

মল্লিকা: আমার প্রথম শেখা গান তো রবীন্দ্রনাথের লেখা। ‘মধু গন্ধে ভরা’ (গেয়ে উঠলেন)।

প্রশ্ন: আপনার নৃত্যধারা ভরতনাট্যমকিন্তু পরবর্তী কালে রবীন্দ্রনাথের নৃত্য ঘরানার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিলেন

মল্লিকা: অবশ্যই। আমি রবীন্দ্রনাথের মুক্তচিন্তার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলাম। শিল্পের মধ্যে প্রশ্ন রাখা প্রয়োজন। রাজনীতি আর জীবন থেকে শিল্পকে দূরে রাখা যায় না। আমার উপস্থাপনায় এ বারও সে কারণেই আমি ‘স্ত্রীর পত্র’-এর উল্লেখ করলাম। আজও যা প্রাসঙ্গিক।

Image of Bharatanatyam dancer Mallika Sarabhai

প্রশ্ন: ধ্রুপদী নৃত্যের প্রাচীন ছক ভেঙে আপনি মঞ্চে উপস্থাপন করলেন আধুনিক সমাজের প্রেক্ষাপট। এ-ও কি সেই সমাজকে সচেতন করার প্রয়াস?

মল্লিকা: ভরতনাট্যম আমার কাছে কোনও নাচ নয়, মনের ভাব প্রকাশের ভাষা। এটা আমার ভাষা। নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করার ভাষা। এই যে এখন যেমন আপনি আর আমি ইংরেজিতে পরস্পর ভাব প্রকাশ করছি। এখানে একটা ‘এফ’ শব্দ উচ্চারণ করতে পারি আমি। আবার তার বদলে কবিতা বলতেও পারি। ভাব প্রকাশ করা বা বোঝানোর দায়িত্ব আমার। কিন্তু মাধ্যম বেছে নেওয়ার শিক্ষা আর স্বাধীনতা তো আমার আছে। নাচের ক্ষেত্রেও তা-ই। যেমন এই মুহূর্তে আর গণেশ বন্দনা করতে পারছি না। যদিও আমি তাঁর আশীর্বাদ চাই। কিন্তু এই মুহূর্তে চারপাশে যা ঘটছে আমি তাকেই সামনে আনতে চাইছি আমার উপস্থাপনায়। শিল্পের মধ্যে অনেক শক্তি রয়েছে। আর ভরতনাট্যম এমন এক ভাষা, যে কোনও আধুনিক ভাবনাকে সে অনায়াসে প্রকাশ করতে পারে। আমি এটা ভরতনাট্যমের ক্ষেত্রে বলছি, কুচিপুরির ক্ষেত্রে নয়। ‘মায়া আঞ্জেলো’ বা ‘চুপ’-এর মতো প্রযোজনার ক্ষেত্রেও আমি কিন্তু সেই ভরতনাট্যমই ব্যবহার করছি। সেখানে আমি অন্য কোনও ধারা মিশিয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেও পারছি না।

প্রশ্ন: উদাহরণ দেবেন?

মল্লিকা: আজও পুরুষেরা ঠিক করে দেয় মেয়েদের চালচলন কেমন হবে। মেয়েরা চিৎকার করবে না। তর্ক করবে না। তর্ক করলে লড়াই হবে। লড়াই হলে সম্পর্ক ভাঙবে। চুপ থাকুক মেয়েরা। এই ভাবনার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি আমার উপস্থাপনায় বার বার মানুষকে এই প্রথা ভাঙতে বলি। এটাই আমার কাজ।

প্রশ্ন: আপনি চণ্ডালিকায় ভরতনাট্যমের ব্যবহার করে নাচের ক্ষেত্রেও প্রথা ভেঙেছেন

মল্লিকা: হ্যাঁ, ওটা আমার মায়ের ভাবনা। মায়ের মনে হয়েছিল, ‘চণ্ডালিকা’য় উচ্চবর্গের মানুষ দলিতদের বিকৃত করে দেখিয়েছে। সেই বিকৃতকরণের ভঙ্গি আম্মা ভরতনাট্যমের মুদ্রায় নিয়ে এলেন। মা বোঝাতে চেয়েছিলেন আমরা সবাই মানুষ হয়েই জন্মেছি, কিন্তু কে কোন পথে যাব, কে সুন্দর ফুল হব, কে কাকে বিকৃত করব, কে কুৎসিত হবে বা কুৎসিত মনোভাব ছড়াবে সেটা তার বিষয়।

প্রশ্ন: আপনি কি নিজেকে নারীবাদী বলে মনে করেন?

মল্লিকা: অবশ্যই। ‘নারীবাদী’ বললেই লোকে কেন খারাপ ভাবে জানি না! নারীবাদ তো মানবতাবাদের কথাই বলে। মানুষের সম-অধিকারের কথা বলে। আমি ৫ বছর বয়স থেকেই নারীবাদ নিয়ে চর্চা করেছি।

প্রশ্ন: ৫ বছর! এত ছোটবেলায় এ সব বুঝলেন কী করে?

মল্লিকা: আমি, আমার চারপাশে লড়াকু মেয়েদের দেখেছি। লড়াই দেখে দেখে বড় হয়েছি। এক দিকে দেখেছি লক্ষ্মী সায়গলকে, অন্য দিকে অনসূয়া সারাভাই আর মৃদুলা সারাভাই। আমি আমার চারপাশে লড়াকু মেয়ে ছাড়া অন্য কাউকে দেখিনি। তবে ওঁরা মানুষের ন্যায়ের জন্য, মানবতার জন্য লড়াই করেছেন। নিজেদের জন্য নয়।

Bharatanatyam dancer Mallika Sarabhai Exclusive Interview after her recent Kolkata performance

প্রশ্ন: আজকের ভারতে মহাকাব্য রামায়ণ’–এর রাজনীতিকরণ হয়েছে। বহু নৃত্যশিল্পী তাঁদের পরিবেশনায় আবার তুলে আনছেন রামায়ণ’-এর কাহিনি। এ কি শুধুই ধ্রুপদী ধারা অনুসরণনা কি এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারি আনুকূল্য লাভের কোনও সম্পর্ক রয়েছেআপনার কী মনে হয়?

মল্লিকা: অবশ্যই রয়েছে। মানুষ সরকারি ভাতার জন্যই তো সব করে। হঠাৎ এক সরকার রামের ভক্ত হয়ে উঠল, আবার আর এক সরকার অন্য কারও ভক্ত হল। মানুষও সেই অনুযায়ী নিজের মনোভাব বদলাবে। দিল্লি যাওয়ার অর্থই তো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার জন্য আবেদন নিবেদনের প্রয়াস।

১৯৯০ সালে আমি সীতা নিয়ে কাজ করেছি। রামায়ণ দিয়েই শুরু। কিন্তু সেখানে ফুটে উঠেছিল সীতার দৃষ্টিভঙ্গি। সীতা সেখানে বলছেন, রাম যদি ঈশ্বর হন তা হলে তাঁর তো বোঝা উচিত ছিল রাবণ আসলে কে? সোনার হরিণ আসলে মারীচ। তেমন হলে রাম সেখানেই সব কিছু থামিয়ে দিলেন না কেন? তাঁকে কি যুদ্ধ করে নিজের শৌর্য, বীর্য, নেতা হওয়ার ক্ষমতা বোঝাতে হল? পুরুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্যই কি এত কিছু? কিছু মানুষ রামনাম করে ভক্তি দেখান, আসলে তাঁরা সুবিধাবাদী।

প্রশ্ন: কত সহজে এত কথা বলে ফেললেনআপনার ভয় করে না?

মল্লিকা: আপনার মনে আছে কি না জানি না। ২০০২ সালে গুজরাতের ঘটনায় আমি তীব্র নিন্দা করেছিলাম। আসলে আমি এমন এক পরিবার থেকে এসেছি, যেখানে সদস্যেরা যা করার, ঠিক সেটাই করবে। অর্থ কিন্তু আমার জীবনে কোনও অতিরিক্ত সুবিধা নিয়ে আসেনি। আমার সুবিধা এটাই যে, আমি এমন মানুষের জন্য সরব হতে পারি, যাঁরা কথা বলতে পারেন না। সত্যের জন্য সোজা কথা বলতে পারি। আমার লুকোনোর কিছু নেই। তাই ভয় পাই না। আমার বই পড়ে সবাই বলেছে আমাকে, আমি নাকি সাহসী। কী করে আমি সব সত্যি লিখলাম? আসলে মানুষ এখন জনপরিসরে খুব মিথ্যে বলতে পারে। আর জনসংযোগ মাধ্যমে তো সত্যি কথা কিনে রাখা যায়! মানুষ তা-ই করে। আমি অনেক ছোটবেলা থেকেই ঠিক করেছিলাম আমার ব্যর্থতা, সাফল্য, সোজা কথা বলা— সব নিয়ে মানুষ যদি আমাকে সম্মান করেন, করবেন। কিন্তু মানুষ যদি মুখোশ পরা মল্লিকাকে শ্রদ্ধা করেন, তাতে কোনও সম্মান নেই। তবে রোজ ভয়ের সঙ্গে দেখা হবে, এটা মেনে নিতেই হবে।

প্রশ্ন: পিটার ব্রুকের দ্রৌপদী’ সম্পর্কে আপনার মনোভাব কী?

মল্লিকা: পিটার ব্রুকের ‘দ্রৌপদী’ অবশ্যই মল্লিকারও ‘দ্রৌপদী’ । প্রথমে কাজ যখন শুরু হচ্ছে দ্রৌপদী কিন্তু অন্য রকম ছিল। আমি ৮ মাস ধরে পিটারের সঙ্গে কথা বলে দ্রৌপদীকে বদলে ফেলি। বলতে পারেন আমাদের যৌথ উদ্যোগে দ্রৌপদী বদলায়। আর এই দ্রৌপদী কিন্তু বিশ্বের সমস্ত নারীর সঙ্গে যুক্ত। এর পরেই আমি ঠিক করি শুধু ভরতনাট্যম শিল্পী হয়ে নয়, আমার ভাবনাকে নৃত্যের চেহারা দেব। ১৯৯০ থেকে তাই করে আসছি।

প্রশ্ন: আরজি কর-কাণ্ডের কথা জানেন?

মল্লিকা: ভয়াবহ!

প্রশ্ন: ন্যায়বিচারের লড়াই আজও চলছে

মল্লিকা: এখন যা সময় আমাদের রোজ ন্যায়ের জন্য লড়াই করতে হবে। আমরা এক পা এগোব তো সতেরো পা পিছিয়ে যাব। ভাষা, পোশাক, সংস্কৃতিতে আমরা একশো বছর পিছিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের তৈরি করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.