অগ্নিগর্ভ মণিপুর। তবে সেই আগুন নেভানোরও নানা চেষ্টা চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল মণিপুর যাচ্ছে, সংসদে এ নিয়ে আলোচনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে এবার চলে এল সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ। সুপ্রিম কোর্ট আজ, সোমবার একটি কমিটি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই দলে থাকবেন হাইকোর্টের তিন প্রাক্তন বিচারপতি, তিন জনই মহিলা। এ ছাড়াও মণিপুরে পাঠানো হবে ৪২টি স্পেশ্যাল ইনভেস্টেগেশন টিম তথা ‘সিট’।
হাইকোর্টের তিন প্রাক্তন মহিলা বিচারপতি হলেন গীতা মিত্তল (জম্মু কাশ্মীর হাইকোর্ট), শালিনী যোশী (বম্বে হাইকোর্ট), আশা মেনন (দিল্লি হাইকোর্ট)। সিবিআই তদন্ত চলবে, তবে সিবিআইয়ের টিম ছাড়াও থাকবে ৪২টি স্পেশ্যাল ইনভেস্টেগেশন টিম তথা ‘সিট’। এই ‘সিট’-এর কাজ দেখবেন ডিআইজি পদমর্যাদার অফিসার। একজন ডিআইজি পদমর্যাদার অফিসারের তত্ত্বাবধানে থাকবে ৬টি করে ‘সিট’।
নগ্ন করিয়ে দুই মহিলাকে হাঁটানোর খবরে শিরোনামে চলে গিয়েছিল মণিপুর। এর পর কুকি সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির কাটা মুণ্ড রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল। এর একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়েছিল। মহিলাদের নগ্ন করিয়ে হাঁটানোর ঘটনায় প্রবল সমালোচনা দেশের সর্বত্র। এর পর মুণ্ডু কাটার ঘটনায় আরও একবার মুখ পুড়েছিল গোটা দেশের।
কুকি সম্প্রদায়-ভুক্ত যে-ব্যক্তির কাটা মুণ্ড পাওয়া গিয়েছিল, তাঁকে শনাক্তও করা গিয়েছিল। তাঁর নাম ডেভিড থিক। বিষ্ণুপুর জেলার এক লোকালয়ে একটি বাড়ির বাঁশের বেড়ার মাথায় তাঁর মুণ্ড টাঙানো থাকতে দেখা গিয়েছিল। যা নিয়ে আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল।
এর কিছুদিন আগে দুই মহিলাকে নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছিল মণিপুরে। হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভিডিয়োও তোলা হয়েছিল। সেই মহিলাদের গণধর্ষণ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ। অভিযোগের আঙুল মণিপুরের মেইতেই সম্প্রদায়ের দিকে। মণিপুর পুলিসের সুপার কে. মেগাচন্দ্র সিংয়ের তরফে একটি বিবৃতিও দেওয়া হয়েছে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস-সহ গোটা দেশের বিজেপিবিরোধী দলগুলি।
সংশ্লিষ্ট ভিডিয়ো থেকে জানা যায়, দুই নির্যাতিতা কুকি সম্প্রদায়ভুক্ত। রাজ্যের জনজাতি সংগঠন আইটিএলএফ-এর তরফে বলা হয়েছে, কুকি-জো সম্প্রদায়ের দুই মহিলার উপরে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে মেইতেইরা। গত ৪ মে কাংপোকপি জেলায় এই ঘটনা ঘটে। ওই দুই মহিলা কেঁদে কেঁদে কার্যত প্রাণভিক্ষা করেন। এর পরেও তাঁদের কথায় কান দেওয়া হয়নি। বরং দুই মহিলার উপর অকথ্য অত্যাচার করা হয়।
বিজেপিশাসিত মণিপুরের অশান্তি নিয়ে বহুদিন থেকেই তপ্ত জাতীয় রাজনীতি। মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি তুলেছে বেশ কয়েকটি বিরোধীদল। মণিপুর-পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা নিয়েও সমালোচনা হয়েছে। মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের সঙ্গে বৈঠক হয় অমিত শাহের। মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে শাহের সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। বিরোধীদের একের পর এক আক্রমণের মুখে পড়ে অমিত শাহ সর্বদলীয় বৈঠক ডাকতেও বাধ্য হয়েছিলেন। মণিপুরে যান কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। কিন্তু কোনও কিছুর ফলেই শান্তি ফেরেনি অশান্ত এই রাজ্যে। এবার বিরোধীদের চাপেই সংসদে মণিপুর হিংসা নিয়ে আলোচনা করতে রাজি হয়েছে সরকার। যদিও বিরোধীরা সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আনে। তার জেরে হবে ওই আলোচনা। আগামীকাল ৮ অগস্ট শুরু হচ্ছে তা, শেষ হবে পরদিন ৯ অগস্ট। ইতিমধ্যে মণিপুর নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
বহুদিন ধরে গোষ্ঠীহিংসায় জর্জরিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্য। চূড়াচাঁদপুরের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। কয়েকমাস ধরে জ্বলছে মণিপুর। হিংসা থামার লক্ষণই নেই। মণিপুরের সমতলের বাসিন্দা মেইতেই সম্প্রদায়ের সঙ্গে কুকি এবং নাগা জনগোষ্ঠীর বিরোধ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। তফসিলি উপজাতিদের তালিকাভুক্ত হওয়াই মেইতেই সম্প্রদায়ের দাবি। মেইতেইরা মণিপুরের জনগোষ্ঠীর প্রায় ৫৩ শতাংশ। এঁরা মূলত ইম্ফল উপত্যকাতেই থাকেন। নাগা আর কুকি’রা মণিপুরের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৪০ শতাংশ। এঁরাও মণিপুরের পাহাড়ি উপত্যকা অঞ্চলে থাকেন। মেইতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতিভুক্তর তালিকায় আনা যায় কি না, তা খতিয়ে দেখতে কিছুদিন আগে রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল মণিপুর হাইকোর্ট। এর পরেই নতুন করে উত্তপ্ত হয় এই রাজ্য। হাইকোর্টের নির্দেশের প্রতিবাদে চূড়াচাঁদপুর জেলার তোরবাঙে ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন মণিপুর’ (এটিএসইউএম) ‘আদিবাসী সংহতি পদযাত্রা’র ডাক দিয়েছিল। সেখান থেকেই হিংসার সূত্রপাত হয়। সেই সূত্রপাত-মুহূর্ত থেকেই মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।