মণ্ডীই ‘কাঁটা’! কংগ্রেসের জেতা আসন ছিনিয়ে নিলেন কঙ্গনা, হিমাচলে বিজেপি আবার চারে চার

দেশের ফলে চমক দিলেও হিমাচল প্রদেশের চারটি আসনে দাগ কাটতে পারল না কংগ্রেস। জেতা আসনও হাত থেকে বেরিয়ে গেল! নেপথ্যে বিজেপির বহু চর্চিত তারকা প্রার্থী তথা বলিউড অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত। মণ্ডী আসনটিতে ৭৪ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন তিনি। যা পাল্টে দিয়েছে হিমাচলের অঙ্ক। আবার বিজেপি সেখানে ফিরে পেয়েছে ‘চারে চার’ তকমা।

ভোটগণনার শেষে দেখা যাচ্ছে, হিমাচল প্রদেশের চারটি আসনেই বিপুল ব্যাবধানে জয় পেয়েছে বিজেপি। হামিরপুর, শিমলা এবং কাংড়া নিয়ে বিশেষ সংশয় ছিল না। মণ্ডী আসনটি কংগ্রেসের দখলে ছিল। সেখানে বিক্রমাদিত্য সিংহকে হারিয়ে দিয়েছেন কঙ্গনা। হামিরপুরে বিজেপি প্রার্থী তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর ১ লক্ষ ৮২ হাজার ভোটে জিতেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল সৎপাল রায়জ়াদাকে। কাংড়ায় বিজেপির টিকিটে এ বার লড়েছিলেন রাজীব ভরদ্বাজ। তিনি কংগ্রেসের আনন্দ শর্মাকে আড়াই লক্ষ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন। শিমলায় বিজেপির সুরেশ কুমার কাশ্যপও প্রায় ৯০ হাজারের বেশি ভোটে জিতেছেন।

হিমাচলের চারটি কেন্দ্রেই ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে একতরফা জয় পেয়েছিল বিজেপি। দু’বারই ভোটের ফল ছিল চারে চার। এ রাজ্যে লড়াই বরাবরই মূলত দ্বিমুখী: বিজেপি বনাম কংগ্রেস। রাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতাসীন থাকলেও ২০১৪ সালের পর থেকে লোকসভায় সে ভাবে তারা দাগ কাটতে পারেনি। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, হিমাচলে শাসকদল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ। যে সুযোগকে লোকসভায় কাজে লাগাতে চেয়েছিল বিজেপি।

পর পর দু’টি লোকসভা ভোটে চারে চার হলেও ২০২৪ সালে হিমাচলে লোকসভা নির্বাচনের সমীকরণ কিন্তু অন্য রকম ছিল। বিজেপির দখলে তিনটি আসন— হামিরপুর, কাংড়া এবং শিমলা। মণ্ডী আসনটি কংগ্রেসের দখলে। ২০২১ সালে মণ্ডীর সাংসদ রামস্বরূপ শর্মার মৃত্যুর পর উপনির্বাচনে জিতেছিলেন কংগ্রেসের প্রতিভা সিংহ। তবে এ বার তিনি প্রার্থী হননি। বদলে কংগ্রেস টিকিট দিয়েছিল প্রতিভার পুত্র বিক্রমাদিত্যকে।

২০২২ সালে বিজেপিকে হারিয়ে হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা ভোটে জিতেছিল কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন সুখবিন্দর সিংহ সুখু। কিন্তু হিমাচলে কংগ্রেসের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব বার বার প্রকাশ্যে এসে পড়ছিল। গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাজ্যসভা ভোটের সময় ছয় কংগ্রেস বিধায়ক বিজেপির প্রার্থী হর্ষ মহাজনের সমর্থনে ‘ক্রস ভোটিং’ করেন। হেরে যান কংগ্রেস প্রার্থী অভিষেক মনু সিঙ্ঘভি। ঘটনাচক্রে, ওই বিধায়কেরা মণ্ডীর বিদায়ী সাংসদ প্রতিভা এবং কংগ্রেস প্রার্থী বিক্রমাদিত্যের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলে পরিচিত। রাজ্যসভা ভোটের পরেই হিমাচলের মুখ্যমন্ত্রী সুখুর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারের অভিযোগ তুলে মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দিয়েছিলেন বিক্রমাদিত্য। পরে প্রিয়ঙ্কা গান্ধীর প্রচেষ্টায় ইস্তফা ফিরিয়ে নেন তিনি। কিন্তু প্রার্থী হওয়ার আগে অন্তত দেড় মাস দলের কাজে ‘সক্রিয়’ ভূমিকায় দেখা যায়নি তাঁকে। ফলে দলের অন্দরের অস্বস্তি বাইরেও অনুভূত হয়েছে। ভোটবাক্সেও তার প্রতিফলন ঘটতে পারে বলে অনেকে মনে করেছিলেন। হলও তাই।

গত দুই লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখলে বোঝা যাচ্ছে, হামিরপুরে ২০১৪ সালে ৫৩.৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। কংগ্রেস প্রার্থী রাজেন্দ্র সিংহ রানাকে হারিয়ে বিজেপির অনুরাগ জিতেছিলেন ৯৮ হাজারেরও বেশি ভোটে। পরের বার ব্যবধান চোখে পড়ার মতো বাড়িয়ে ফেলেন অনুরাগ। ২০১৯ সালে হামিরপুরে প্রায় ৪ লক্ষ ভোটে জেতে বিজেপি। অনুরাগের বিরুদ্ধে সে বার কংগ্রেসের প্রার্থী ছিলেন রামলাল ঠাকুর। ভোট পড়েছিল ৭০.৮৩ শতাংশ। হামিরপুরে এখন মোট ভোটার ১৪.১১ লক্ষ। অনুরাগ বর্তমানে কেন্দ্রীয় তথ্য এবং সম্প্রচারমন্ত্রী। ক্রীড়া এবং যুব বিষয়ক মন্ত্রকও সামলান তিনি। ফলে তিনি ‘ওজনদার’ প্রার্থী। ২০০৮ সালে এই কেন্দ্র থেকে প্রথম বার উপনির্বাচনে লড়ে জয় পেয়েছিলেন অনুরাগ। পরে ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৯ সালেও জেতেন। হামিরপুরকে বিজেপির শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করে ফেলেছিলেন অনুরাগ।

কাংড়া লোকসভা কেন্দ্রে ২০১৪ সালে ৫৭.০৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল বিজেপি। শান্তা কুমার শর্মা সাড়ে ৪ লক্ষ ভোটে জিতেছিলেন। হেরে গিয়েছিলেন কংগ্রেসের চন্দ্র কুমার। পরের লোকসভা ভোটে ওই কেন্দ্রে বিজেপির ভোট-ব্যবধান বিপুল বৃদ্ধি পায়। ২০১৯ সালে রেকর্ড ব্যবধানে জেতেন ওবিসি নেতা কিশান কপূর। হিমাচল প্রদেশের বরিষ্ঠ বিজেপি নেতাদের অন্যতম তিনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাঁর জয়ের ব্যবধান ছিল প্রায় পৌনে ৫ লক্ষ। শতাংশের বিচারে ৭২.২ শতাংশ। যা ছিল সারা দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ওই বছর কাংড়ায় কংগ্রেস প্রার্থী করেছিল পবন কাজলকে। ভোট পড়েছিল ৭০.৭৩ শতাংশ। তবে এ বার আর কাংড়া থেকে কিশানকে টিকিট দেয়নি বিজেপি। ওই কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে ভোটে লড়েছেন কাংড়ার ‘ভূমিপুত্র’ রাজীব ভরদ্বাজ। তিনি রাজ্য বিজেপির সহ-সভাপতির পদে রয়েছেন দীর্ঘ দিন। অনেকে বলছিলেন, রাজীব রাজ্য বিজেপির ‘ব্রাহ্মণ’ মুখ। কাংড়ায় তাঁকে প্রার্থী করে ভোটে ‘ব্রাহ্মণ তাস’ ব্যবহার করেছিল বিজেপি। কাংড়ার ২৩ শতাংশ ব্রাহ্মণ ভোটে যা আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল ‘তুরুপের তাস’।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

হিমাচল প্রদেশের সবচেয়ে বড় লোকসভা কেন্দ্র মণ্ডীতে এ বার তারকা প্রার্থী দিয়েছিল বিজেপি। বলি অভিনেত্রী কঙ্গনা এই প্রথম বার ভোটে লড়লেন। মণ্ডীতে ২০১৪ সালে ৪৯.৯৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছিলেন বিজেপি প্রার্থী রামস্বরূপ শর্মা। পেয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৬২ হাজার ভোট। কংগ্রেসের প্রতিভাকে ৩৯ হাজার ভোটে হারিয়েছিলেন তিনি। ২০১৯ সালেও মণ্ডীতে তাঁকেই প্রার্থী করেছিল বিজেপি। ব্যবধান আরও বৃদ্ধি পায়। সে বার বিজেপিকে ৪ লক্ষেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে জয় এনে দিয়েছিলেন রামস্বরূপ। তবে ২০২১ সালে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। দিল্লির বাড়িতে ঝুলন্ত অবস্থায় মণ্ডীর সাংসদের দেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। রামস্বরূপের মৃত্যুর পরে মণ্ডী কেন্দ্রটি বিজেপির হাতছাড়া হয়ে যায়। ওই কেন্দ্রের উপনির্বাচনে জেতেন কংগ্রেসের প্রতিভা। যিনি ২০১৪ সালে রামস্বরূপের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। সাংসদ হিসাবে তিন বছর দায়িত্ব সামলেছেন প্রতিভা। তাঁর স্বামী প্রয়াত বীরভদ্র হিমাচলের ছ’বারের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী। মণ্ডীতে এ বার কঙ্গনার বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রার্থী হন প্রতিভার পুত্র বিক্রমাদিত্য। তিনি রাজ্যের মন্ত্রীও বটে। প্রতিভা কিছু দিন আগে ভোটে লড়ার বিষয়ে অনীহা প্রকাশ করেছিলেন। তার পরেই বিক্রমাদিত্যকে টিকিট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। তবে লাভ হল না।

হিমাচলের চতুর্থ লোকসভা কেন্দ্র শিমলা। এই আসনটি তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত। ২০১৪ সালে ওই কেন্দ্র থেকে বীরেন্দ্র কাশ্যপকে প্রার্থী করেছিল বিজেপি। তিনি ৫২.৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে জেতেন। কংগ্রেসের মোহনলাল ব্রাক্টার সঙ্গে তাঁর ভোট-ব্যবধান ছিল প্রায় ৮৪ হাজারের। ২০১৯ সালে ওই কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন সুরেশ কুমার কাশ্যপ। তিনি হিমাচল প্রদেশের বিজেপির তফসিলি জাতি মোর্চার সভাপতি। সাংসদ হওয়ার আগে হিমাচলের পছাড় কেন্দ্র থেকে ২০১২ এবং ২০১৭ সালে বিধানসভা ভোটেও জিতেছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী ধনীরাম শান্ডিলকে ৩ লক্ষেরও বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন তিনি। হামিরপুরের মতো এই কেন্দ্রেও এ বার প্রার্থী বদল করেনি বিজেপি। সুরেশের উপরেই আস্থা রেখেছে দল। তিনিও সফল হলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.