গাছটির বোটানিক্যাল নাম Bixa orellana (L.) Kuntze; একটি লম্বা গুল্ম কিংবা ছোট্ট চিরহরিৎ বৃক্ষ। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মধ্যে গাছটির উৎস বা আদি বাসভূমি সম্পর্কে দ্বিধা আছে। এই গাছের বিটপগুলির অগ্রভাগে গুচ্ছাকারে জন্মানো বীজশুঁটি, তারই ভেতরে রক্ষিত ৩০-৪০ টির মতো লাল-বাদামী বীজ; বীজের উপরিভাগে মোমের মতোন রক্তরাঙা এরিল-লেয়ার বা স্বল্প শাঁসালো অংশ; আর তাতেই লাল-কমলা রঙের ‘Annatto’ ক্যারোটিনয়েড রঙ, যাতে ৮০ শতাংশ লালরঙের Bixin dye এবং বাকী প্রায় ২০ শতাংশের মতো হলদে রঙের Norbixin dye — রঙ হিসাবে এটিই লোকশিল্পীদের কাছে দরকারি অংশ। এই উদ্ভিজ্জ রঙ দিয়েই তারা পট চিত্রে লাল, কমলায় ভরিয়ে দেয়। তবে গাছটি কিন্তু ভারতীয় উদ্ভিদ নয় মোটেই, জানা যায় সেন্ট্রাল আমেরিকা এই গাছটির আদি বাসভূমি। মেক্সিকো, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে এই গাছের আদি ঠিকানা। অর্থাৎ ভারতীয় লোকশিল্পীরা যদি রঙ হিসাবে এই গাছটি ব্যবহার করতে থাকে, তা অর্বাচীন কালের প্র্যাক্টিস হিসাবে ধরে নিতে হবে।
ষোড়শ বা সপ্তদশ শতাব্দীতে এই গাছ সেন্ট্রাল আমেরিকা থেকে সাউথ ইস্ট এশিয়া, আফ্রিকা প্রভৃতি জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের রাজ্যে ০গাছটির দেশীয় নাম হয়েছে সিঁদুরে ফল, কোথাও লটকন, কেউ ডাকে লিপস্টিক প্ল্যান্ট। কসমেটিক শিল্পে, খাবার নিরাপদে রঙ করতে, লোকচিকিৎসায় এর ব্যবহার শুরু হয়ে গেছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল, আদি বাসভূমির দেশে দেশে এই রঙটি অশুভ আত্মাকে তাড়াতে লোকপ্রসাধনের অঙ্গ করে নিয়েছে। মনে করা হয়, এর বীজের গুঁড়ো রান্নায় ব্যবহার করলে তা শুদ্ধ ও সাত্ত্বিক হয়ে ওঠে। নিরাপদ এবং টেকসই ব্যবহারের ধারণা সম্ভবত এইভাবেই এলো।
লটকন বা সিঁদুরে ফলের ব্যবহার এর বীজ থেকেই শুরু হোক। অবিলম্বে এর অর্থকরী চাষাবাদ দরকার। হোটেল মালিকদের সংগঠন, পেস্ট্রি, বেকারি, আইসক্রিম এবং মিষ্টি দোকানের সংগঠনগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, চাইলেই হাতের কাছে রঙটিকে কী পাওয়া যাবে? না পাওয়া গেলে নিজেরাই কী ছোটো করে চাষ করে নিতে পারি? খুব বেশি পরিমাণে তো প্রয়োজন হয় না! অথচ যদি মিষ্টির দোকানে একটা ডিসপ্লে বোর্ডে বিজ্ঞাপন দিই, “এই দোকানে ব্যবহৃত উদ্ভিজ্জ এবং নিরাপদ”, তাহলে মিষ্টি দাম খানিকটা বেশি ধার্য করলেও সচেতন স্বাস্থ্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তা কিনবেন ওই বেশি দামেই। আজ আমরা তাই গাছের বিবরণ সহ তার চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে সামান্য আলোচনা করবো।
সিঁদুরে গাছটি ক্রান্তীয় এবং উপক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে সহজেই জন্মাতে পারে, তুষারপাতহীন এলাকা চাই। মাটিতে যেন সারাবছর আর্দ্রতা থাকে। মাটি হবে মধ্যম মানের উর্বর। রৌদ্রোজ্জ্বল কিংবা আংশিক ছায়াতে এই গাছ জন্মাতে পারে। চারা সহজেই তৈরি হয় বীজ থেকে। তবে কাটিং করেও চারা তৈরি করা যায়। কাটিং-এর চারায় ফুল-ফল আগে আসে। বর্ষাকালে পেনসিল থিকনেসের ছয় থেকে আট ইঞ্চির ডালগুলির তলাটি তেছড়া করে কেটে বালির তৈরি চারাতলায় স্থাপন স্থাপন করা হয় এবং নিয়মিত সেচ দিয়ে তার শেকড় গজানোর উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা হয়। ছয় ইঞ্জি দূরে দূরে সারিগুলিতে দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি দূরত্বে কাটিং বসানো হয়৷ বর্ষাকালে এক মাসের মধ্যে বা কিছুটা সময় পরে চারা গজিয়ে যায়। শিকড় গজানো চারাগুলি ছোটো পলিব্যাগের জৈবসার মিশ্রিত দোঁয়াশমাটিতে রোপণ করে শক্তপোক্ত করে নেওয়া হয় আর দুই থেকে তিন সপ্তাহ। তারপর চারা বিক্রি করা যায়, মূল জমিতে লাগানো চলে। বর্ষার সময় চারা লাগানোর সঠিক সময়৷ তিন বা সাড়ে তিন মিটার দূরত্বে চারাগাছ লাগানো হবে। প্রথম বর্ষায় লাগালে অনেক সময় সেই বছরই শীতের আগে ফুল চলে আসে। বসন্তের মরশুমে ফল তোলার সময় হয়ে যায়। তবে কোনো এক বছরের বর্ষায় রোপন করে দ্বিতীয় বছর থেকে ফলন নেওয়া শুরু করলে অধিক ফলন মেলে।
কৃষিবিদ ও বাগান বিলাসীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে জেনেছি,
গাছ রোপণের পূর্বে প্রস্তুত গর্তে কমপক্ষে এক/দেড় ঝুড়ি জৈবসার দেওয়া দরকার। দ্বিতীয় বছরে এক/দেড় ঝুড়ি জৈবসার ছাড়াও গাছ প্রতি সর্বমোট ২৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ৫০০ গ্রাম সিঙ্গেল সুপার ফসফেট এবং ৩০০ গ্রাম মিউরিয়েট অফ পটাশ বছরে দু’টি ভাগে বিভক্ত করে দেওয়া যায় – প্রথমটি বর্ষার শুরুতে এবং দ্বিতীয়টি বর্ষার শেষে ফুল আসার পর। গাছের বয়স বাড়াতে থাকলে সারের পরিমাণ বাড়ে। পাঁচ-ছয় বছর থেকে পূর্ণাঙ্গ গাছে ১ কেজি ইউরিয়া, দুই কেজি সিঙ্গেল সুপার ফসফেট এবং সোওয়া কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ দেওয়া যায়। মাটি একেবারে শুষ্ক না হয়, এইমতো সেচ দিতে হবে। যেখানে জলের সংকট, সেখানে খড়, বাগান ঝাঁটানো শুকনো পাতা বা পলিথিন বিছিয়ে মালচিং বা ভূ-আস্তরণ করে দিলে মাটি কিছুটা আর্দ্র থাকে। ফুল আসার পর সেচের অভাব যেন না হয়।
এদের ফুলগুলি ডালের মাথায় মাথায় গুচ্ছাকারে ফোটে। ফুলগুলি উজ্জ্বল সাদা বা বেগুনি, পরিমাপ প্রায় ৫ সেন্টিমিটার। দেখতে যেন এক পাপড়ির বুনো গোলাপের মতো। ফলগুলি গ্লোবিউলার বা ডিম্বাকার, একগুচ্ছে ধরে থাকে, ফলের বাইরে নরম কাঁটা, ফলের রং লালচে-সবুজ বা লালচে-বাদামী। থোকা থোকা ফলগুলি শুকিয়ে গেলে ফেটে যায়, বীজ দেখতে পাওয়া যায়। পরিণতি প্রাপ্ত ফলগুলি রঙ ধরে গেলে, শুকনোর আগেই চয়ন করা হয়। বীজের জন্য আরও কিছুটা সময় গাছে ফল রেখে দিতে হয়। পাঁচ বছরের একটি গাছে সহজেই পঁচিশ-ত্রিশ কেজির মতো ফলন পাওয়া যায়। ফলগুলিতে হাল্কা চাপ দিলে তা ফেটে বীজ দৃশ্যমান হয়ে পড়ে। এই বীজগুলিকে আলাদা পাত্রে নিয়ে ক্ষারীয় জলে, উদ্ভিজ্জ তেলে অথবা জৈব দ্রাবকে তার রঙ অংশটিকে পৃথক করে নিয়ে নেওয়া হয়। রঙ নেওয়ার পর বীজগুলি চারা তৈরির কাজে ব্যবহারও চলে৷ আর রান্নার কাজে এর বীজ শুকিয়ে গুঁড়িয়ে রাখা হয় মশলা বা কণ্ডিমেন্ট রূপে ব্যবহারের জন্য। লোকশিল্পীরা বীজগুলি সামান্য ক্ষার মিশানো জলে বা জৈবদ্রাবকে নিয়ে তুলির টানে ক্রমান্বয়ে ছবি রাঙিয়ে তোলেন।
ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়।