ছেলেধরা-গুজব ছড়াচ্ছে, বাড়ছে গণপিটুনি! মূল ঘটনার ‘রহস্যভেদ’ করে কড়া বার্তা দিল পুলিশ

বারাসতের কাজিপাড়ায় বালক খুনের ঘটনার পর থেকেই ছড়াচ্ছিল ‘ছেলেধরা-গুজব’! তার পরিণতি— জেলার বিভিন্ন জায়গায় গণপিটুনির ঘটনা। উন্মত্ত জনতার হাতে প্রহৃত হতে হয়েছে ‘অচেনা’ যুবক-যুবতীদের! কড়া হাতে তা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টাও করেছে পুলিশ। কিন্তু কিছুতেই রাশ টানা যাচ্ছে না গুজবে, গণপ্রহারের ঘটনায়। সেই আবহে বারাসতের মূল ঘটনার ‘রহস্যভেদ’ করে কড়া বার্তা দিল পুলিশ। স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হল, গুজব ছড়ালে কড়া পদক্ষেপ করা হবে।

রবিবার বারাসতের জেলা পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা ঝারখারিয়া দাবি করেন, পুলিশকে ভুল পথে চালিত করতেই পরিকল্পনা করে এলাকায় ছেলেধরার উপদ্রবের মনগড়া কাহিনি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। স্থানীয় মসজিদে গিয়ে গ্রামবাসীদের সতর্ক করে বলা হয়েছিল, বাইরের লোক দেখলেই মারধর করতে হবে। কিন্তু এত কিছু করেও শেষরক্ষা হল না। তদন্তে উঠে এসেছে, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের জেরেই ১১ বছরের ওই বালক ফারদিন নবিকে খুন করেছেন তার জেঠু আঞ্জিব নবি। পাশাপাশি, পুলিশ আরও জানিয়েছে, জেলা জুড়ে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির একের পর এক যে ঘটনা ঘটে চলেছে, তা আঞ্জিবেরই মস্তিষ্কপ্রসূত।

বারাসতের ফারদিনের ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হওয়ার পর থেকেই সমাজমাধ্যমে ‘ছেলেধরা’ নিয়ে ‘গুজব’ আগুনের শিখার মতো ছড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনায়। তার পরেই বারাসত, খড়দহ, অশোকনগরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটে। শনিবার রাতে বনগাঁতেও এক যুবককে ছেলেধরা সন্দেহে মারধর করেন স্থানীয় লোকজন। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, প্রতিটি ঘটনাতেই লোকমুখে বা সমাজমাধ্যমে ‘গুজব’ ছড়িয়ে পড়ে সেই ঘটনা ঘটেছে। বারাসতে একই দিনে দুই জায়গায় মোট তিন জনকে ছেলেধরা সন্দেহে মারধর করা হয়। তাঁদের মধ্যে এক মহিলাও ছিলেন। পরে অশোকনগরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি দেওয়া হয় এক তরুণীকে। বাধা দিতে গেলে পুলিশকেও মারধর করে উন্মত্ত জনতা। খড়দহে গত শনিবার এক যুবককে ছেলেধরা সন্দেহে মারধর করেন এলাকার মানুষ। শনিবার একই ঘটনা ঘটেছে বনগাঁতেও। বনগাঁ পুরসভা এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ঠাকুরপল্লিতে রাস্তায় ভবঘুরে এক যুবককে ঘুরতে দেখে সন্দেহ হয় স্থানীয়দের। দ্রুত গুজব ছড়িয়ে পড়ে এলাকায়। স্থানীয়দের সন্দেহ হয়, ওই যুবক ছেলেধরা। শিশু অপহরণের উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন। মুহূর্তে এলাকায় লোকজন জড়ো হয়ে যায়। শুরু হয় গণপিটুনি। ছেলেধরা সন্দেহে ওই যুবককে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে বলে অভিযোগ। গুরুতর জখম অবস্থায় তিনি এখন বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। রবিবার জেলার গাইঘাটাতেও এক যুবককে মারধর করা হয় ছেলেধরা সন্দেহে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁকে উদ্ধার করে পুলিশ।

লাগাতার গণপিটুনির ঘটনার নেপথ্যে কে বা কারা? এই প্রশ্নই এত দিন ভাবাচ্ছিল পুলিশ প্রশাসনকে। রবিবার জেলা পুলিশ সুপার প্রতীক্ষা জানান, মসজিদে আজান দেওয়ার কাজ করতেন আঞ্জিব। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তিনি নমাজ শেষের পর গলায় ছদ্ম উত্তেজনা এনে এলাকাবাসীকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে, এলাকায় ছেলেধরা ঘুরছে। তাই বাইরের কাউকে দেখলেই মেরে তাড়াতে হবে। ৯ জুন ফারদিন নবি নামে বালক নিখোঁজ হয়। ১৩ জুন, বাড়ির পাশে অন্য একটি বাড়ির পরিত্যক্ত শৌচাগার থেকে তার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। পুলিশ জানিয়েছে, গরমে দেহে পচন ধরেছিল। আঞ্জিব সেই দেহ দেখিয়েই পাড়া-প্রতিবেশীদের বলতে থাকেন, ফারদিনের কিডনি কেটে বার করে নেওয়া হয়েছে, চোখ খুবলে নেওয়া হয়েছে। আর এ সবই এলাকায় খুব সম্প্রতি থাকতে আসা দুই মহিলার কাজ। কিন্তু গল্প ফেঁদেও শেষরক্ষা হল না। হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিল পুলিশ!

বারাসতকাণ্ডের ‘রহস্যভেদ’

পুলিশ সুপার জানিয়েছেন, পৈতৃক সম্পত্তির বাঁটোয়ারা নিয়ে ফারদিনের বাবা গোলামের সঙ্গে দাদা আঞ্জিবের দীর্ঘদিনের সমস্যা। গত ৭ জুন একটি তালগাছের ফল ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে ভাইয়ে-ভাইয়ে বাদানুবাদ হয়েছিল। সেই সময় বালক ফারদিন নাকি আঞ্জিবের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। সেই থেকে ভাইপোর উপর রাগ আঞ্জিবের। এর পর থেকেই ভাইকে শিক্ষা দিতে ভাইপোকে খুনের পরিকল্পনা করেন আঞ্জিব। ৯ জুন, রবিবার ফারদিনকে বাড়ির পিছনে নিয়ে যান তিনি। গলা টিপে খুন করেন ভাইপোকে। ফারদিনের নিথর দেহ পাশের বাড়ির পরিত্যক্ত শৌচাগারে ঝুলিয়ে দেন। ঘটনার কয়েক দিন পরে ফারদিনের পচাগলা দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ সুপার বলেন, ‘‘ফারদিনকে একটি কাপড় দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই কাপড়টি সংগ্রহ করে গত ৮ জুন থেকেই নিজের ব্যাগে রেখে দিয়েছিল আঞ্জিব। গোলামকে খুন করা কঠিন, কিন্তু বালক ফারদিন সেই তুলনায় অনেক সহজ নিশানা। এটাই ছিল পরিকল্পনা। ৮ জুন থেকেই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন আঞ্জিব। ৯ জুন সেই সুযোগ তিনি পান। ১০ জুন থেকেই খুন ধামাচাপা দিতে বিভিন্ন ভুয়ো তথ্য ছড়াতে শুরু করেন আঞ্জিব।’’ পুলিশ সুপারের দাবি, খুনের ঘটনা ধামাচাপা দিতে আঞ্জিব ব্যবহার করেছিলেন তাঁর পেশাক। মসজিদে আজান দেওয়ার কাজ করতেন। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে গত ১০ জুন, সোমবার আঞ্জিব নমাজ শেষে এলাকাবাসীকে সাবধান করে দেন যে, এলাকায় ছেলেধরা ঘুরছে। তাই বাইরের লোক দেখলেই মেরে তাড়িয়ে দিতে হবে। ফারদিনকে খুন করে তার পেট থেকে কিডনি এবং চোখ বার করে নিয়েছে দুই মহিলা। যে দুই মহিলা কাজিপাড়ায় এসেছেন মাত্র কয়েক দিন হল। ফলে, পাড়াপ্রতিবেশীর সঙ্গে তাঁদের খুব ভাল আলাপও জমে ওঠেনি। সেই সুযোগ কাজে লাগায় আঞ্জিব। কিন্তু পুলিশি তদন্তে আঞ্জিবের সমস্ত জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেল। পুলিশ প্রথম থেকেই আঞ্জিবকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল। পুলিশের সন্দেহ বৃদ্ধি পায়, আঞ্জিবের বার বার বয়ান বদলে। শেষ পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার করে চলে ম্যারাথন জেরা। সেখানেই ভেঙে পড়ে দোষ কবুল করেন আঞ্জিব।

বনগাঁকাণ্ডে গ্রেফতার ছয়

বনগাঁয় ছেলেধরা ভেবে গণপিটুনির ঘটনায় আগেই গ্রেফতার হয়েছিলেন দু’জন। রবিবার আরও চার জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জনে জানালেন বনগাঁর এসডিপিও অর্ক পাঁজা। সেই সঙ্গে গুজব রটানোর অভিযোগেও এক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রবিবার সাংবাদিক বৈঠক করে পুলিশ। সেখানে এসডিপিও জানান, সম্পূর্ণ গুজব ছড়ানো হয়েছে। যাঁদের উপর হামলা হয়েছে, তাঁরা কেউই ছেলেধরা নন। ধৃতদের সোমবার বনগাঁ আদালতে হাজির করানো হবে। একই সঙ্গে গাইঘাটার ঘটনাতেও দোষীদের চিহ্নিত করার কাজ চলছে বলে জানান এসডিপিও। তাঁর কড়া বার্তা, ‘‘কেউ গুজবে কান দেবেন না। কোনও রকম সন্দেহ হলে পুলিশকে জানান। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নেবেন না। যাঁরা গুজব ছড়াবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.