প্রতিরোধ যেটুকু জাডেজা-বুমরাহ-সিরাজের! জয়ের ১৯৩ রান তুলতে গিয়ে ১৭০ রানে গুটিয়ে গেল ভারত, সিরিজ়ে ২-১ এগিয়ে গেল ইংল্যান্ড

মরিয়া চেষ্টা করেও ভারতকে জেতাতে পারলেন না রবীন্দ্র জাডেজা। ব্যর্থ হল ব্যাট হাতে জসপ্রীত বুমরাহ, মহম্মদ সিরাজের লড়াইও। লর্ডসে ১৯৩ রানের লক্ষ্যে ভারতের পৌঁছোতে না পারার পিছনে প্রধান দায় ব্যাটারদের। শুভমন গিলদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় ১৭০ রানে শেষ হল ভারতের ইনিংস। শেষ দিকে জাডেজা এবং বুমরাহ (৫) মরিয়া লড়াই করলেন। ১১২ রানে ৮ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর ২২ ওভার লড়াই করলেন তাঁরা। নবম উইকেটে তাঁদের তোলা ৩৫ রানও হার ঠেকাতে পারল না। মহম্মদ সিরাজের (৪) ৩০ বলের লড়াইও দাম পেল না। দশম উইকেট ১৩.২ ওভার সঙ্গ দিলেন জাডেজাকে। তাতেও রক্ষা হল না। রুদ্ধশ্বাস লড়াই শেষে ২২ রানে জিতে সিরিজ়ে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে গেলেন বেন স্টোকসেরা।

শেষ দিন জয়ের জন্য ভারতের দরকার ছিল ১৩৫ রান। ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৬ উইকেট। জয়ের সুযোগ ছিল দু’দলের সামনেই। সকালের লর্ডসে বোলারেরা কিছুটা হলেও বাড়তি সুবিধা পান। চেনা পরিবেশ কাজে লাগালেন স্টোকস, জফ্রা আর্চারেরা। বল সুইং করল। ঋষভ পন্থ (৯), লোকেশ রাহুল (৩৯), ওয়াশিংটন সুন্দরেরা (শূন্য) বলের লাইন মিস করলেন। প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে ৮২ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে চাপে পড়ে যায় ভারতীয় শিবির। চাপের মুখে লড়াই করার জন্য ছিলেন বলতে জাডেজা এবং নীতীশ কুমার রেড্ডি। নীতীশও পারলেন না (১৩)। অভিজ্ঞ জাডেজা ফর্মে রয়েছেন। তরুণ নীতীশ ব্যাট হাতে ফর্মের খোঁজে রয়েছেন। রাহুল আউট হওয়ার পরই ম্যাচের ফলাফল এক রকম ঠিক হয়ে গিয়েছিল। তবু জাডেজা মরিয়া লড়াই চালালেন। টানা চারটি টেস্ট ইনিংসে অর্ধশতরান করলেন জাডেজা। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকলেন ৬১ রানে। দাঁতে দাঁত চেপে সঙ্গ দিলেন বুমরাহ-সিরাজ। চেষ্টা করলেন ইংল্যান্ডের জয় ঠেকিয়ে রাখতে।

লর্ডস। ক্রিকেটের আঁতুড়ঘর হিসাবে পরিচিত। ইংরেজদের হাতেই এই খেলার প্রচলন। সেই মাঠে টেস্টের প্রথম দিন থেকে শুভমন, মহম্মদ সিরাজেরা আগ্রাসন দেখিয়ে এসেছেন। সাজঘরে থাকলেও পিছিয়ে ছিলেন না কোচ গৌতম গম্ভীরও! শুধু কথায়, আচরণে আগ্রাসন দেখালেই ম্যাচ জেতা যায় না। ব্যাট বা বল হাতেও জেতার মতো কিছু করতে হয়। টেস্ট অধিনায়কত্বের শৈশবে থাকা শুভমন নিশ্চই প্রথম তিন ম্যাচের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝবেন। প্রথম দু’টেস্টে শরীরী আগ্রাসন কম ছিল ভারতীয় ক্রিকেটারদের। সঙ্গে ছিল ব্যাটে, বলে পারফরম্যান্স। প্রথম টেস্ট হারলেও লড়াই ছিল। দ্বিতীয় টেস্টে বড় ব্যবধানে জয়ই কি লক্ষ্যচ্যুত করে দিল ভারতীয় দলকে? লর্ডসে শেষবেলার লড়াই ছাড়া বলার মতো পারফরম্যান্স বলতে প্রথম ইনিংসে বুমরাহের ৭৪ রানে ৫ উইকেট আর রাহুলের ১০০ রানের ইনিংস। কিন্তু জয় এল কোথায়?

যশস্বী জয়সওয়াল, শুভমন, নীতীশেরা ব্যাট হাতে ব্যর্থ। করুণ নায়ারের অবস্থা সত্যিই করুণ। চেন্নাইয়ের ২২ গজে ইংরেজদের বোলিং আর ইংল্যান্ডের মাটিতে তাঁদের বোলিংয়ের পার্থক্য অনেক। করুণ ঠেকে বুঝছেন নিশ্চই। অপরাজিত ৩০৩ রানের পর টেস্টে তাঁর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান ৪০। নিজের পরিসংখ্যানে চোখ রাখলে আরও ভাল বুঝতে পারবেন। তবু আঙুলে চোট নিয়ে প্রায় এক হাতে ঋষভ পন্থ সাধ্য মতো চেষ্টা করেছেন। বল হাতে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ আকাশদীপ, সিরাজেরা। আসলে ভারত দল হিসাবে ব্যর্থ। বিক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স ক্ষণিকের উচ্ছ্বাস তৈরি করতে পারে। তাতে সাজঘরে উৎসবের পরিবেশ রচিত হয় না। সোমবার লর্ডসের সকাল ক্রমশ স্নায়ুর চাপ বাড়িয়েছে ভারতের। যত ক্ষণ একটু একটু করে লক্ষ্য কমেছে, তত ক্ষণ আশা ছিল। ক্ষীণ হলেও ছিল। কিন্তু গম্ভীরদের রক্তচাপ স্থিতিশীল হয়নি। তিনটে স্লিপ, একটা গালি রেখে সমানে আগ্রাসী বোলিং করে গিয়েছেন স্টোকসেরা। পরে ক্লোজ-ইন ফিল্ডার আরও বাড়িয়েছেন তাঁরা। ভারতের ব্যাটারদের সমানে ব্যাক ফুটে খেলানোর চেষ্টা করেছেন। আসলে পপিং ক্রিজ়ের লক্ষ্মণরেখার মধ্যে আটকে রাখতে চাইছিলেন। লেখা ভুল হল। আটকেই রেখেছিলেন। এজবাস্টনে ইংল্যান্ডের সামনে জয়ের জন্য ৬০৮ রানের লক্ষ্য টাঙিয়ে দিয়েছিলেন শুভমনেরা। সেই চাপ সামনে স্টোকসেরা পৌঁছেছিলেন ২৭১ পর্যন্ত। লর্ডসে কলার তুলেই নেমেছিলেন শুভমন। কিন্তু তাঁর দল ১৯৩ রানের লক্ষ্যে পৌঁছতেই হিমশিম খেল। আসলে টেস্ট ক্রিকেটের প্রতিটি বলে পরীক্ষা দিতে হয়। খেটে রান করতে হয়। সাদা বলের ক্রিকেটের মতো ‘অসহায়’ নন বোলারেরা।

প্রথম ইনিংসে ইংল্যান্ডের ৩৮৭ রানের জবাবে ভারতও ছিল ৩৮৭। শুভমনেরা এগিয়ে যেতে পারেননি। পিছিয়েও থাকেননি। আপাত ভাবে ঠিক। কিন্তু ২৭১ রানে ৭ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরও বেন স্টোকসেরা তুলেছিলেন ৩৮৭। অন্য দিকে, ভারত ৩৭৬ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর ইনিংস শেষ করে ৩৮৭ রানে। অর্থাৎ শেষ ৩ উইকেটে ইংল্যান্ড করেছিল ১১৬ রান। ভারত ১১ রান। লর্ডসে এই ১০৫ রানের পার্থক্যের মূল্যও চোকাতে হল শুভমনদের। প্রথম ইনিংসে তাড়াহুড়ো করে খুচরো রান নেওয়ার চেষ্টায় পন্থের রান আউট হওয়াও ভারতের বিপক্ষে গিয়েছে। তৃতীয় দিন চা বিরতির আগে সে সময় ২২ গজে থিতু হয়ে গিয়েছিলেন পন্থ এবং রাহুল। রানও উঠছিল ভাল। তাঁদের হঠকারী সিদ্ধান্তে খানিকটা ছন্দ পতন হয়।

ভারত-ইংল্যান্ড তৃতীয় টেস্টের স্কোর কার্ড।

ইংল্যান্ডের বোলারেরা উইকেট নিচ্ছেন। ব্যাট হাতেও ধারাবাহিক ভাবে দলের জন্য লড়ছেন। বুমরাহ, সিরাজেরা প্রথম ইনিংসেও সোমবারের মতো ব্যাট করতে পারলে ফলাফল অন্য রকম হতে পারত। ৬ বা ৭ উইকেট পড়ার পরই ইনিংস শেষ হয়ে গেলে আধুনিক ক্রিকেটে সেরা দল হওয়া কঠিন। লাল বলের ক্রিকেটে তো নয়ই। প্রথম দু’টি বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে ওঠা দলের পক্ষে লম্বা ব্যাটিং লেজ শোভনীয় নয়। যা প্রায় প্রতি ম্যাচেই ভারতকে লড়াইয়ে পিছিয়ে দিচ্ছে। কোচ গম্ভীর নিশ্চয়ই ভাববেন।

ফুটবলে মাঝমাঠ খুব গুরুত্বপূর্ণ। মিডফিল্ডারেরা দরকারে রক্ষণ সামলান। আবার গোলের বলও বাড়ান। যে দলের সাপ্লাই লাইন যত ভাল, সেই দলের সাফল্যের সম্ভাবনাও তত বেশি। ফুটবল নয়, এটা ক্রিকেট। তবু বলা যায় ভারতীয় টেস্ট দলের সাপ্লাই লাইন ভরসা দিতে পারছে না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শার্দূল ঠাকুর, ওয়াশিংটন, নীতীশদের খেলাচ্ছেন। ফল পাচ্ছেন না। ব্যাট বা বল হাতে দারুণ কিছু করতে পারছেন না কেউ। ওই বেহাল মাঝমাঠের মতো দেখাচ্ছে ভারতের লোয়ার মিডল অর্ডারকে বা সেকেন্ড লাইন বোলিংকে। টেস্টে দলের ‘সাপোর্ট সিস্টেম’ ঠিক মতো কাজ করছে না। গম্ভীরের দলও আইসিইউ থেকে পাকাপাকি ভাবে বেরোতে পারছে না।

ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ভারতীয় দলের কোচ বলেছিলেন, সকলের মুখে হাসি দেখার জন্য নিজে গম্ভীর থাকেন। নেহাতই রসিকতা। কিন্তু তাঁর অধীনে লাল বলের ক্রিকেটে ভারতীয় দলের পারফরম্যান্স নিয়ে সত্যিই রসিকতা শুরু হতে পারে। ঘরের মাঠে নিউ জ়িল্যান্ড সিরিজ় থেকে একের পর এক হার। গত বার (২০২১ সালে) এই লর্ডসেই ইংল্যান্ডকে ১৫১ রানে হারিয়েছিল বিরাট কোহলির দল। অতীত আঁকড়ে লাভ নেই। টেস্ট ক্রিকেটে আর কোহলি নেই। রোহিত শর্মা, রবিচন্দ্রন অশ্বিনেরাও নেই। গম্ভীরকে নতুন করে ভাবতে হবে। ব্যাটিং লেজ নিয়ে ভাবতে হবে। ‘সাপ্লাই লাইন’ নিয়ে ভাবতে হবে। কোহলি-রোহিতের উপযুক্ত পরিবর্তও খুঁজতে হবে।

দলের পালা বদলের এই সময় হয়তো একটি সময় লাগে। কিন্তু পেশাদার ক্রিকেটে খুব বেশি সময়ও বরাদ্দ থাকে না। অধিনায়ক শুভমনকেও বুঝতে হবে, তাঁর ব্যাটার ‘মোড’টা যত কার্যকর, অধিনায়ক ‘মোড’টা ততটা হচ্ছে না হয়তো। সিরাজরাও বুঝুন, প্রতিপক্ষকে শুধু ‘বাজ়বল’ খেলার চ্যালেঞ্জ ছুড়লেই হয় না। বোলারেরা প্রথম ইনিংসে দলকে ৩০-৪০ রানে এগিয়ে দিতে পারলেও হয়তো সিরিজ়ে দ্বিতীয় বার পিছিয়ে পড়তে হত না। ভারতীয় দল দ্বিতীয় ইনিংসে ২৫ রান ‘বাই’ না দিলেও এগিয়ে যেতে পারত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.