কঙ্কালসার চেহারা নিয়ে কোনও রকমে দাঁড়িয়ে রয়েছে কিছু কালো, পোড়া, ভাঙাচোরা বাড়ি। কিছু কিছু আবার একেবারে ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়ে ধ্বংসস্তূপের চেহারা নিয়েছে।
এটা যদি ইজ়রায়েলের তেল আভিভ শহরের বিভিন্ন জনপদের ছবি হয়, তা হলে উল্টো দিকে জ্বলছে ইরানও। রাজধানী শহর তেহরানের কাছে শাহরানের তেলের ভান্ডার জ্বলতে থাকার যে ছবি প্রকাশ্যে এসেছে, তা দেখে আঁতকে ওঠার মতোই।
ইজ়রায়েল-ইরানের সংঘর্ষে এখনও পর্যন্ত দু’পক্ষেরই বেশ কয়েক জনের মৃত্যু হয়েছে। ইরানে শনিবার পর্যন্ত অন্তত ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে ইজ়রায়েলি হামলায়। অন্য দিকে, ইরানের প্রত্যাঘাতে ইজ়রায়েলেও অন্তত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে রবিবার পর্যন্ত। তবে শুধু হানাহানিই নয়, একে অপরের উপর হামলায় দু’পক্ষেরই বহু ঘরবাড়ি, বহুতল ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। কিংবা আধভাঙা অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
তবে ডোনাল্ড ট্রাম্প আশাবাদী, ইরান-ইজ়রায়েলের সংঘর্ষও থামবে। ঠিক যে ভাবে ভারত-পাকিস্তানের সংঘর্ষ থেমেছে! মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথায়, ‘‘ইরান এবং ইজ়রায়েলের বোঝাপড়ায় আসা উচিত আর তারা সেটা করবেও।’’ দাবি করেন, আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনায় আনার পরেই ‘দুই দুর্দান্ত নেতা’ (ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ) দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং সংঘাত বন্ধ করেছিলেন।
ইরান-ইজ়রায়েলের মধ্যে মুহুর্মুহু আক্রমণ, প্রতি আক্রমণের আবহে শনিবার রাতেও দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা করানোর প্রস্তাব দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তবে সেই বার্তার সঙ্গে ‘হুমকি’ও ছিল। ইরানকে হুমকি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। বলেছিলেন, ইরান যদি কোনও ভাবে আমেরিকার উপর হামলা চালানোর চেষ্টা করে, তা হলে ‘তছনছ’ করে দেওয়া হবে। এমন প্রত্যাঘাত করা হবে, যা আগে হয়নি।
রবিবার অবশ্য সেই পথে হাঁটেননি ট্রাম্প। তিনি দাবি করেন, ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাত থামানোর জন্য তিনি লাগাতার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কথায়, ‘‘অনেক ফোনাফুনি, বৈঠক চলছে। আমি নিজেও অনেক কিছু করছি। কিন্তু আমি কোনও কিছুর জন্যই কৃতিত্ব নিতে চাই না। মানুষ সব বোঝে। চলুন, পশ্চিম এশিয়াকে আবার মহান করে তুলি।’’
ভারতও শনিবার দু’পক্ষকে কূটনীতিক আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের বার্তা দিয়েছিল। দিয়েছিল সৌদি আরব এবং ওমানও। পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি ফেরাতে ইরানের সঙ্গে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানিও আলোচনা চেয়েছে। কিন্তু সংঘর্ষ থামার নাম নেই! ইজ়রায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, শনিবার রাত থেকে রবিবার ভোরের মধ্যে পর পর ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়েছে ইরান থেকে। তার কোনওটির লক্ষ্য ছিল তেল আভিভ, কোনওটির রাজধানী জেরুসালেম। দুই শহরেই রবিবার ভোর থেকে সাইরেন বাজছে অনবরত। রাত আড়াইটে নাগাদ (স্থানীয় সময়) ইজ়রায়েলের সেনার তরফে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে (শেল্টারে) যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। রবিবার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন ইজ়রায়েলের প্রধান বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। সেখানে তিনি বলেন, তিনি বলেন, “ভাবুন যদি ইরানের হাতে পরমাণু বোমা থাকত, তবে কী হতে পারত!” কারণ, গোটা বিবাদেরই সূত্রপাত— ইরান শীঘ্রই পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে, এই আশঙ্কা থেকে।
ইজ়রায়েলও ইরানের উপর গোলাবর্ষণ করেছিল শনিবার রাতে। রাজধানী তেহরানের শাহরান তৈলভান্ডার লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল ইজ়রায়েল। ছবিতে দেখা গিয়েছে, তেলের ভান্ডার জ্বলছে। কালো ধোঁয়ায় ঢেকেছে রাতের আকাশ। যদিও ইরান জানিয়েছে, শাহরানে ইজ়রায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র পড়লেও পরিস্থিতি আপাতত নিয়ন্ত্রণে। এ ছাড়া, তেহরানে ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ভবনে একটি ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ে। তাতেও সামান্য কিছু ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি। ইরানের সংবাদ সংস্থা তাসনিম রবিবার এই তথ্য জানিয়েছে।
ইরানের পাশে ‘বন্ধু’
ইজ়রায়েলের সঙ্গে সংঘাতের তৃতীয় দিনে ‘বন্ধু’কে পাশে পেয়েছে ইরান। ইয়েমেন থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র বর্ষণ শুরু হল ইজ়রায়েলে। একই সঙ্গে তেল আভিভ থেকে ইয়েমেনের সশস্ত্র গোষ্ঠী হুথিদের লক্ষ্য করে পাল্টা হামলা চালানো হয়েছে। ইজ়রায়েলের বাহিনী জানিয়েছে, তাদের নিশানায় ছিলেন হুথিদের সামরিক বাহিনীর চিফ অফ স্টাফ মুহাম্মদ আল-ঘামারি। যদিও ইজ়রায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রে তাঁর কোনও ক্ষতি হয়েছে কি না, এখনও স্পষ্ট নয়। ইজ়রায়েলি সংবাদমাধ্যমও তা নিশ্চিত করেনি। পশ্চিম এশিয়ায় ইরানের অন্যতম সহায়ক ইয়েমেনের হুথিরা। এই গোষ্ঠী বরাবর ইরান সমর্থিত। গাজ়ায় প্যালেস্টাইনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের সঙ্গে ইজ়রায়েলের যুদ্ধেও হুথিরা হামাসের পাশে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু গত শুক্রবার থেকে ইরানের সঙ্গে ইজ়রায়েলের যে সশস্ত্র সংঘাত চলছে, তাতে এই প্রথম অন্য কোনও দেশের সমর্থন পেল তেহরান। ইজ়রায়েলের সঙ্গে ইয়েমেনের ক্ষেপণাস্ত্র সংঘাত পশ্চিম এশিয়ার উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিল।
লক্ষ্য ইরানের অস্ত্রকারখানা?
ইরানে অস্ত্র তৈরির কারখানার আশপাশে যে জনবসতি রয়েছে, সেখানকার নাগরিকদের সরে যেতে বলেছে ইজ়রায়েল। রবিবার এক্স (সাবেক টুইটার) হ্যান্ডলে এই নিয়ে পোস্ট দিয়েছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সেনা। তার পরেই প্রশ্ন উঠছে, ইরানের পরমাণু কেন্দ্রের পরে কি তাদের অস্ত্র ভাণ্ডার লক্ষ্য করে হামলা চালাতে পারে ইজ়রায়েল? নেতানিয়াহু প্রশানের একটি সূত্র বলছে, তেহরানের উপর চাপ বৃদ্ধি করতেই নাগরিকদের সরে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইজ়রায়েল। রবিবার ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইজ়রায়েল কাটজ় বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘‘ইরানের স্বৈরাচারী শাসক (সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা খামেনেই) তেহরানকে বেইরুটে (সিরিয়ার রাজধানী) পরিণত করছেন। নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে তেহরানের নাগরিকদের পণবন্দিতে পরিণত করছেন।’’ তার পরেই এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট দিয়ে তেহরানের নাগরিকদের সতর্ক করে ইজ়রায়েল সেনা। তাতে জানায়, ‘‘দেশের অস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানা এবং সেই সংক্রান্ত পরিকাঠামোর আশপাশে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের এখনই সেই জায়গা ছেড়ে দেওয়া উচিত। কর্তৃপক্ষকে সেই বিষয়টি জানানো উচিত।’’
আলোচনা চায় তিন দেশ
পশ্চিম এশিয়ায় শান্তি ফেরাতে ইরানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে চায় তিন ইউরোপীয় দেশ! জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন দ্রুত ইরানের সঙ্গে বৈঠক করে সমাধানসূত্র বার করতে চায়। এমনটাই জানিয়েছেন জার্মানির বিদেশমন্ত্রী জোহান ওয়েডফুল। তবে ওই বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয় যে শুধুমাত্র তেহরানের পারমাণবিক কর্মকাণ্ড, তা-ও স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনি। ঘটনাচক্রে, জার্মানি এবং ব্রিটেন দুই দেশই ইজ়রায়েলের পাশে দাঁড়িয়েছে। জার্মান বিদেশমন্ত্রী বর্তমান পশ্চিম এশিয়া সফরে ওমানে রয়েছেন। ইজ়রায়েল এবং ইরানের মধ্যে সংঘর্ষের পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তিনি। জার্মানির সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘এআরডি’কে তিনি জানান, ইজ়রায়েল এবং ইরানের মধ্যে সংঘর্ষ থামানোর চেষ্টা করছে জার্মানি। তাঁর বক্তব্য, আগেও গঠনমূলক আলোচনায় বসার সুযোগ পেয়েছিল তেহরান। কিন্তু সেই সুযোগ তারা কাজে লাগায়নি। তবে এখনও আলোচনায় বসার সময় রয়েছে বলে মনে করছেন তিনি। জোহান বলেন, “জার্মানি, ফ্রান্স এবং ব্রিটেন তৈরি আছে। আমরা চাই ইরান দ্রুত পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের প্রসঙ্গে আলোচনায় বসুক। আশা করি তারা এই প্রস্তাব গ্রহণ করবে।” তাঁর বক্তব্য, ইরান যাতে ইজ়রায়েল, পশ্চিম এশিয়া বা ইউরোপের জন্য কোনও বিপদ ডেকে না আনে, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য তা নিশ্চিত প্রয়োজন। তিনি বলেন, “ইরান এবং ইজ়রায়েলের উপর সকল পক্ষের প্রভাব বিস্তার করতে হবে। একমাত্র তা হলেই এই সংঘর্ষ বন্ধ হবে।”