(সম্ভাবনাময় ফসল অ্যাভোকাডো চাষ নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য। এ রাজ্যেও কী সফল ও বানিজ্যিকভাবে অ্যাভোকাডো চাষ করে চাষী লাভবান হতে পারবেন? জানতে হলে অ্যাভোকাডো সিরিজের সবকটি নিবন্ধই পড়তে হবে। এটি তার প্রথম পর্ব।)

কী নামে পরিচিত অ্যাভোকাডো?
‘Avocado’ ফলটিকে বিশ্ববাসী ডাকে ‘Butter fruit’ নামেও, বাংলায় সাম্প্রতিক নামকরণ ‘মাখম-ফল’ বা ‘মাখন-ফল’। যেন মখমলের মতো নরম খাদ্য, মাখন-সদৃশ্য স্নেহপদার্থ! এর বিজ্ঞান সম্মত নাম Persea americana, নামেতেই বোঝা যায়, এর আদি বাসভূমি আমেরিকা। ফলটির আদিনিবাস ভারতবর্ষ থেকে বহুদূরে। মধ্য আমেরিকা, মেক্সিকো এবং সন্নিহিত দেশ এই ফসলটির উৎস। সম্ভবত একাধিক সম্পর্কিত বন্য প্রজাতি থেকে এর উদ্ভব। আদি বাসভূমিতে গৃহপালিত হয়ে একদা চাষাবাদ শুরু হয়েছিল, তারপর তার ক্রম উত্তরণ। ‘অ্যাভোকাডো’ নামটি মোটেই ভারতীয় নয়, ইংরেজি বা অন্য কোনো ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠী থেকেও আসে নি। এসেছে মধ্য মেক্সিকোর নাহুয়াটল ভাষা থেকে। মূল শব্দটি হল ‘Ahuacat’, এর অর্থ ইংরেজিতে ‘Testicle’, যার অর্থ হচ্ছে পুরুষের দুটি গোল জননাঙ্গ বা অণ্ডকোষের একটি। এটি উর্বরতা শক্তিবর্ধক খাদ্য বা Fertility boosting food হিসাবে অ্যাভোকাডো-বিশ্বে স্বীকৃত।

কীভাবে ভারতে অ্যাভোকাডো এলো?
প্রায় সোওয়া চারশো বছর আগে এই ফসলটি অন্বেষণ করেছিল স্পেনীয় বণিকেরা। তারা লক্ষ্য করেছিল মেক্সিকো থেকে পেরু পর্যন্ত অ্যাভোকাডো চাষ হচ্ছে। তারাই ১৬০১ সালে গাছটি দক্ষিণ স্পেনে নিয়ে আসে। তারাই ১৬৫০ সালে জ্যামাইকাতে এই ফলচাষের প্রবর্তন করে। এই ফলটি তারপর বিশ্বের নানান জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়, ১৮৩৩ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বে ফ্লোরিডায়, ১৮৫৬ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে (প্রশান্ত মহাসাগরীয় পশ্চিম উপকূলে) ক্যালিফোর্ণিয়ায় এবং ১৮৯২ সালে আফ্রিকার পূর্ব উপকূলের তাঞ্জানিয়ার জাঞ্জিবারে। জানা যায় ওলন্দাজ বণিকদের আগ্রহে অ্যাভোকাডো প্রায় ২০০ বছর আগে শ্রীলঙ্কায় আসে এবং দেশের আর্দ্র অঞ্চলের গৃহবাগিচায় অন্তর্ভূক্ত হয়৷ তবে রেকর্ড অনুযায়ী জানা যায়, ব্রিটিশ আধিপত্যে ১৯২৭ সালের ১২ ই মে বেশ কয়েকটি জাতের অ্যাভোকাডো শ্রীলঙ্কায় আমদানি করা (Introduced) হয়েছিল। যেমন Datton, Puebla, Winslowson, Gottfried, St. Anne, Pollock. ভারতে অ্যাভোকাডো উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে আসে বলে জানা গেলেও, আনুষ্ঠানিকভাবে বিংশশতাব্দীর প্রথম দিকে শ্রীলঙ্কা থেকে ফলটি ভারতে আসে।

অ্যাভোকাডোর পুষ্টিমূল্য:
যাদের কাছে ফলটি অপরিচিত, তারা ‘মাখন ফলে’র সঙ্গে ‘মাখানা’-কে অনেকসময় গুলিয়ে ফেলেন। মাখানা হচ্ছে পদ্মগোত্রীয় জলজ উদ্ভিদের বীজ থেকে প্রাপ্ত একরকমের খই। নিয়মিত মাখানা খেলেও জোয়ান ও পালোয়ান হওয়া যায় বলে, লোকসমাজ মনে করে৷ বাংলায় একটি প্রবাদ আছে, “তিল তিসি তাল মাখানা/ খায় জোয়ানে হয় মর্দানা।” তিল ও তিসি তৈলবীজ ফসল, এর বীজ ফ্যাট সমৃদ্ধ। এদিকে তালশাঁস ও পাকা তালের রসে পুষ্টিমূল্য প্রচুর। তালশাঁস দেখতে পুরুষের অণ্ডকোষের মতো। যেখানে মাখানার পরিচিতি ‘সুপার ফুড’, আর অ্যাভোকাডোর পরিচিতি ‘ফার্টিলিটি বুস্টিং ফুড’ হিসাবে, তাই এই দুয়ের মিলও একটি গুরুত্বপূর্ণ লোকসংস্কৃতিগত বিষয়। আগামী দিনে বাংলার লোককবি এমন প্রবচনও দিতে পারেন, “মাখম-ফল আর মাখানা/ খায় স্ত্রী-পুরুষে, হয় মর্দানা। “
বিশ্বে পুষ্টিকর ফলগুলির অন্যতম অ্যাভোকাডো। ফলের কম্পোজিশন বা উপাদান অলিভ ওয়েলের মতো, ৫ থেকে ৪০ শতাংশ ফ্যাট, অনেকক্ষেত্রেই ৩০ শতাংশ। এই ফ্যাট মনো-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট। এই ফল গ্রহণে ব্লাড-প্রেসার কমায়, কোলেস্টেরলের সমস্যাও থাকে না। কারণ অ্যাভোকাডো গুড কোলেস্টেরল মেইনটেইন করে, বদ কোলেস্টেরল কমায়। এই ফল উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ (৪ শতাংশ), আপেলে যে মাত্রায় প্রোটিন আছে, তার তিনগুণ প্রোটিন অ্যাভোকাডোতে আছে। রয়েছে প্রায় সমস্ত অ্যামাইনো অ্যাসিড। তবে কার্বোহাইড্রেটের মাত্রা কম। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য তাই হাই-এনার্জি খাবার। অ্যাভোকাডো ফলে রয়েছে উচ্চ মূল্যের শক্তি, প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে ২৪৫ ক্যালোরি শক্তি। রয়েছে বিবিধ ভিটামিন ও খনিজ লবণ — ভিটামিন – এ (ক্যারোটিন), ভিটামিন – ই, বি-কমপ্লেক্স, ফোলিক অ্যাসিড, উচ্চমাত্রায় কপার এবং আয়রন, অতি উচ্চমাত্রায় পটাসিয়াম (ট্রপিকাল এবং সাব-ট্রপিকাল ফলে ও সব্জিতে এত উচ্চমাত্রায় পটাসিয়াম কমই মেলে), রয়েছে ভালোমাত্রায় ক্যালসিয়ামও। আর লভ্য বহু অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এনজাইম, অর্থাৎ এটি একটি ক্যান্সার প্রতিরোধী খাদ্য।

কীভাবে খাওয়া হয় অ্যাভোকাডো?
অ্যাভোকাডোর তাজা-পাকা ফল খাওয়া হয়, স্যাণ্ড-উইচের মধ্যে মাখনের মতো পরত লাগিয়ে খাওয়া চলে, স্যালাডের মতো করে ব্যবহৃত হয়, শাঁস আইস ক্রীমে বা মিল্কশেকে মিশিয়ে সুখাদ্য করে তোলা যায়। ফ্রিজে শাঁস সংরক্ষণ করে রাখা চলে৷ এছাড়া শুকনো অ্যাভোকাডো পাউডার তৈরি করার চেষ্টাও হয়েছে, যার মধ্যে অ্যাভোকাডোর আদর্শ সুগন্ধি। অ্যাভোকাডো খাদ্য ছাড়াও কসমেটিক বা প্রসাধনী শিল্পে অনবদ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এর সবুজ কাঁচা ফলের খোসায় ছত্রাক প্রতিরোধী যৌগ থাকে, যা চর্মরোগ প্রতিরোধী প্রসাধনী ক্রীম হিসাবে ব্যবহার করা যায়।

অ্যাভোকাডো গাছটি কেমন?
অ্যাভোকাডো একটি চিরহরিৎ নাতিশীতোষ্ণ বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ। গাছে সবসময় পাতা থাকে। বছরে দুই-তিন দফায় নতুন শাখা-পল্লব আসে। কাণ্ড কাষ্ঠল, কিছুটা ছড়ানো অথবা উর্ধমুখী বৃদ্ধিপ্রাপ্ত উদ্ভিদ। পাতাগুলো আকারে বড়, শাখায় বিপরীতক্রমে পাতাগুলো জন্মায়। চর্মবৎ বা লেদারি পাতাগুলি আকারে উপবৃত্তাকার বা ভল্লাকার চাকুর মতো। পুষ্পমঞ্জরীটি শাখার আগায় জন্মায়, তাতে ফুলগুলি ছোটো, হলুদ এবং পূর্ণাঙ্গ, ফুলে তিনটে করে বৃতি ও পাপড়ি থাকে। এটি উদ্ভিদবিদ্যাগত পরিভাষায় বেরি-টাইপের ফল, ফলের আকৃতি গোলক/উপগোল কিংবা কিছুটা ডিম্বাকৃতি, ফলের রঙ সবুজ কিংবা বেগুনি অথবা মিশ্র, তাতে একটি বড়সড় বীজ থাকে।
অ্যাভোকাডোর ফুল ফোটার একটি সিকোয়েন্স বা ক্রম পরিলক্ষিত হয়। তার উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন জাতে দুই ধরনের ফুল ফোটে। টাইপ-এ (Flower type A): যেমন Arka Supreme জাতে পরিলক্ষিত হয়, তাতে প্রথম দিনের প্রভাতে ফুলের কার্যকরী স্ত্রী-অঙ্গ বিকাশ লাভ করে, সেদিন বিকেলে আবার ফুলটি বন্ধ থাকে; পরদিন সকালেও বন্ধ কিন্তু বিকেলে কার্যকরী পুরুষ অঙ্গাদি বিকশিত হয়। আর ফুলের টাইপ-বি: যেমন Arka Cooge Ravi জাতে পরিলক্ষিত হয়, তাতে প্রথম দিনের সকালে ফুলটি বন্ধ থাকে, বিকেলে মেলে ধরে কার্যকরী স্ত্রী অঙ্গ, পরিদিন সকালে মেলে দেয় কার্যকরী পুরুষ অঙ্গ, দ্বিতীয় দিন বিকেলে ফুলটি বন্ধই থাকে। নতুন এলাকায় কলমের চারা লাগিয়ে অ্যাভোকাডো চাষ করতে হলে এই দুই টাইপের জাত ১:১ অনুপাতে বা ২:১ অনুপাতে রোপণ করতে হবে। তাতে উত্তম পরাগমিলন ঘটে ফলের গুটি ধরবে। তা না হলে ফুল এলেও ফল হয় না। মিশ্রজাতের ফলের বাগান এই কারণেই করতে হয়।

[কৃতজ্ঞতা স্বীকার ICAR-AICRP on Fruits, Mohanpur Center, BCKV. প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র তৃতীয় পর্বে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। অ্যাভোকাডো গাছ ও পুষ্পবিন্যাসের ছবি ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর নিজস্ব তোলা, ফলের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।]

অস্মিতা চক্রবর্তী এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.