৪৭১ দিন। ১৯ নভেম্বর ২০২৩ থেকে ৪ মার্চ ২০২৫। ঠিক ৪৭১ দিন পর বদলা নিল ভারত। এক দিনের বিশ্বকাপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল ভারতের। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সেমিফাইনালে সেই অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েই ফাইনালে উঠল ভারত। দুবাইয়ের মাঠে শেষ হাসি হাসলেন রোহিত শর্মারা। ১১ বল বাকি থাকতে ৪ উইকেটে জিতলেন তাঁরা। বল হাতে মহম্মদ শামি ও বরুণ চক্রবর্তী যে কাজ শুরু করেছিলেন তা শেষ করলেন বিরাট কোহলি, শ্রেয়স আয়ারেরা। আরও এক বার কোহলি দেখালেন, তিনি বড় ম্যাচের ক্রিকেটার। পাকিস্তানের পর অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধেও ম্যাচ জেতানো ইনিংস এল কোহলির ব্যাট থেকে। চেজ়মাস্টারের ভূমিকায় কোহলির উপর কেন সকলে চোখ বন্ধ করে ভরসা করে তা দেখিয়ে দিলেন ভারতীয় ক্রিকেটার। দলকে ফাইনালে তুললেও শতরান হাতছাড়া করার আফসোস হবে তাঁর। অহেতুক বড় শট মারতে গিয়ে ৮৪ রান করে আউট হলেন তিনি।
ভারতের মাথাব্যথা কমালেন বরুণ
আইসিসি প্রতিযোগিতায় ভারতের বড় মাথাব্যথা ট্রেভিস হেড। সে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল হোক, বা এক দিনের বিশ্বকাপ ফাইনাল। শতরান করে ভারতকে হারিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার দুবাইয়েও সেই কাজটাই শুরু করে দিয়েছিলেন হেড। পাওয়ার প্লে-র মধ্যে একের পর এক বড় শট খেলছিলেন। পেসার, স্পিনার সকলের বলে মারছিলেন। হেডকে থামাতে বরুণের হাতে বল তুলে দেন রোহিত। গত ম্যাচে নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট নিয়েছিলেন। এই ম্যাচেও ৩৯ রানের মাথায় হেডকে আউট করলেন তিনি। হেড আউট হওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার রান তোলার গতি কমে যায়।
মাঝের ওভারে ধাক্কা জাডেজা, অক্ষরের
অস্ট্রেলিয়াকে চাপে রাখতে মাঝের ওভারে উইকেট তুলতে হত ভারতকে। সেই কাজটা করেন রবীন্দ্র জাডেজা। মার্নাশ লাবুশেনকে ২৯ ও জশ ইংলিসকে ১১ রানের মাথায় ফেরান তিনি। নিয়মিত উইকেট পড়ায় অস্ট্রেলিয়ার রান তোলার গতি ধাক্কা খায়। গ্লেন ম্যাক্সওয়েলকে হাত খুলতে দেননি অক্ষর পটেল। ৭ রানে তাঁকে আউট করেন।
অধিনায়কের ইনিংস স্মিথের
অপর প্রান্তে উইকেট পড়লেও এক দিকে ভাল খেলছিলেন অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ। শুরুতে ভাগ্যের সাহায্যও পান তিনি। একটি বল উইকেটে লাগলেও বেল পড়েনি। সেই সুযোগ কাজে লাগান স্মিথ। রানের গতি কম থাকলেও উইকেট দেননি। অর্ধশতরান করেন। দেখে মনে হচ্ছিল, শতরানও করবেন। কিন্তু ৭৩ রানের মাথায় উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে খেলতে গিয়ে শামির বলে বোল্ড হন স্মিথ। তিনি আউট হওয়ার পরেই ম্যাচ ভারতের দিকে ঘুরে যায়।
শামির ৩ উইকেট
বাংলাদেশ ম্যাচের পর উইকেট পাচ্ছিলেন না শামি। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে উইকেটে ফিরলেন তিনি। নতুন বলে অস্ট্রেলিয়াকে প্রথম ধাক্কা দেন শামি। ফেরান তরুণ কুপার কনোলিকে। পরে পুরনো বলে অস্ট্রেলিয়ার সবচেয়ে বড় উইকেট স্মিথকে আউট করেন তিনি। ১০ ওভারের স্পেলে ৪৮ রান দিয়ে ৩ উইকেট নেন শামি। নিজের বলে দু’টি ক্যাচ ছাড়েন শামি। নইলে উইকেটের সংখ্যা আরও বাড়তে পারত।
শ্রেয়সের সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট ক্যারে
স্মিথ আউট হওয়ার পর অস্ট্রেলিয়াকে টানছিলেন অ্যালেক্স ক্যারে। অর্ধশতরান করে খেলছিলেন তিনি। তাঁর খেলা দেখে মনে হচ্ছিল অস্ট্রেলিয়ার রান ২৮০-র বেশি হবে। কিন্তু ৬১ রানের মাথায় দূর থেকে সরাসরি থ্রোয়ে তাঁকে রান আউট করেন শ্রেয়স আয়ার। ক্যারে ফেরায় অন্তত ২৫ রান কম হয় অস্ট্রেলিয়ার।
আবার ব্যর্থ ভারতের দুই ওপেনার
রান তাড়া করতে নেমে আরও এক বার রান পেলেন না শুভমন গিল। নিউ জ়িল্যান্ডের বিরুদ্ধে ২ রানে আউট হয়েছিলেন। এ বার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ৮ রান করে ফিরলেন তিনি। রোহিত ভাল খেলছিলেন। শুরু থেকেই হাত খুলেছিলেন। কিন্তু তিনিও বড় রান করতে পারেননি। ২৮ রান করে কনোলির বলে ফেরেন তিনি।
ভরসার নাম শ্রেয়স
ব্যাট হাতে আরও এক বার ভরসা জোগালেন শ্রেয়স। তিনি ভারতের মিডল অর্ডারে নিজের জায়গা ক্রমেই পাকা করছেন। দুই উইকেট পড়ার পরে জুটি বাঁধার দরকার ছিল। কোহলির সঙ্গে সেটাই করলেন শ্রেয়স। কোনও তাড়াহুড়ো করলেন না। দৌড়ে রানের দিকে বেশি নজর দিলেন। দু’জনের মধ্যে ৯১ রানের জুটি হয়। আরও একটি অর্ধশতরান করার সুযোগ ছিল শ্রেয়সের। কিন্তু ৪৫ রান করে অ্যাডাম জ়াম্পার বলে আউট হন তিনি। তত ক্ষণে ভাল জায়গায় পৌঁছেছে ভারত।
গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস অক্ষর, রাহুলের
ভারতের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেললেন অক্ষর ও লোকেশ রাহুল। কোহলিকে সঙ্গ দিলেন তাঁরা। অক্ষর ২৭ রান করে আউট হলেন। দুই ব্যাটারের জন্যই কোহলি অনেক নিশ্চিন্ত মনে খেলতে পারলেন। কঠিন উইকেটে বড় শটের থেকে দৌড়ে রানের উপর বেশি ভরসা ছিল ভারতীয় ব্যাটারদের। কোহলি, অক্ষর, রাহুল তিন জনই ভাল দৌড়ান। সেই কারণে স্কোরবোর্ড সচল রাখতে সমস্যা হয়নি তাঁদের।
চেজ়মাস্টার কোহলি
আরও এক বার কঠিন ম্যাচে জ্বলে উঠলেন কোহলি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শতরান করেছিলেন। দু’ম্যাচ পরে এল আরও ম্যাচ জেতানো ইনিংস। কোহলি জানতেন, তিনি আউট হয়ে গেলে রান তাড়া করতে সমস্যা হবে। তাই নিজের খেলার ধরন বদলাননি তিনি। এক রান, দু’রান করে এগিয়ে যান। প্রথমে শ্রেয়স, তার পরে অক্ষর ও সব শেষে রাহুলের সঙ্গে জুটি বাঁধেন।
অর্ধশতরান করার পরেও খেলার ধরন বদলাননি কোহলি। তিনি জানতেন, শেষ পর্যন্ত খেলতে হবে তাঁকে। দুবাইয়ের উইকেটে নতুন ব্যাটারের পক্ষে স্কোরবোর্ড সচল রাখা কঠিন। বাকিদের উপর চাপ পড়তে দেননি তিনি। কোহলির খেলতে সমস্যা হয় লেগ স্পিনের বিরুদ্ধে। জ়াম্পা তাঁকে অনেক বার আউট করেছেন। তাই এই ম্যাচে জ়াম্পাকে সাবধানে খেলছিলেন তিনি। দুবাইয়ের মাঠ বেশ বড়। ফলে দু’রান নিতে সমস্যা হচ্ছিল না তাঁর। দেখে মনে হচ্ছিল, হাসতে হাসতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৮৩তম শতরান আসতে চলেছে। কিন্তু জ়াম্পার বলে বড় শট মারতে গিয়ে ৮৪ রানে ফিরলেন কোহলি। দলকে জিতিয়ে ফিরতে না পারায় আফসোস করতে দেখা গেল কোহলিকে।
আরও এক বার দলের ভার নিজের ঘাড়ে নিলেন কোহলি। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে কোচ গৌতম গম্ভীর জানিয়েছিলেন, কোহলি তাঁর দলের খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার। চ্যাম্পিয়ন হতে গেলে কোহলিকে তাঁর দরকার। এই ইনিংসের পর মুখের হাসি আরও চওড়া হল গম্ভীরের। ৩০০তম এক দিনের ম্যাচে গ্লেন ফিলিপ্সের দুরন্ত ক্যাচে আউট হয়েছিলেন কোহলি। গ্যালারিতে বসে হতাশ হয়েছিলেন স্ত্রী অনুষ্কা শর্মা। কিন্তু পরের ম্যাচেই মুখে হাসি ফুটল তাঁরও। কোহলির আরও একটি ম্যাচ জেতানো ইনিংস গ্যালারিতে বসে দেখলেন অনুষ্কা।
কোহলি আউট হওয়ার পর বাকি কাজটা করলেন হার্দিক ও রাহুল। হার্দিক স্পিনারদের বিরুদ্ধে তিনটি বড় ছক্কা মেরে কাজ সহজ করলেন। ২৪ বলে ২৮ রান করলেন তিনি। রাহুল শেষ পর্যন্ত খেললেন। ৩৪ বলে ৪২ রান করলেন তিনি। ছক্কা মেরে দলকে জেতালেন রাহুল।
সুযোগ নষ্টের খেসারত দিল অস্ট্রেলিয়া
অস্ট্রেলিয়াও সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু তা কাজে লাগাতে পারেনি তারা। রোহিতের জোড়া ক্যাচ পড়ে। কোহলির ক্যাচ ছাড়েন ম্যাক্সওয়েল। ফিল্ডিংয়েও বেশ কিছু ভুল করেন তাঁরা। এই ছবি সাধারণত অস্ট্রেলিয়ার ফিল্ডিংয়ে দেখা যায় না। এই রকম গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে এত ভুল করলে তার খেসারত তো দিতেই হবে। সেটাই দিল অস্ট্রেলিয়া। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি থেকে বিদায় নিল এক দিনের ক্রিকেটের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দল।