(অ্যাভোকাডো চাষ বিষয়ে এই লেখকদ্বয়ের এই সিরিজে এটি তৃতীয় নিবন্ধ। সম্ভাবনাময় অ্যাভোকাডো চাষ কোথায় কীভাবে করা যাবে, তার পূর্ণ উত্তর পেতে নিবিড়-পাঠ করতে হবে এই সিরিজের সবকটি নিবন্ধ।)
অ্যাভোকাডো চাষ কোথায় সম্ভব:
মনে রাখতে হবে, অ্যাভোকাডো শুষ্ক-তপ্ত বায়ুপ্রবাহ (Hot dry wind) সহ্য করতে পারে না। সহ্য হয় না তুষারপাতও (Frost)। অ্যাভোকাডো সুনির্দিষ্টভাবে জন্মায় ট্রপিকাল থেকে সেমি ট্রপিকাল অঞ্চলে, যেখানে গ্রীষ্মে বৃষ্টিপাত হয়।শীতপ্রধান অঞ্চলের উষ্ণ এলাকায় অ্যাভোকাডো জন্মায়। আর্দ্র সাব-ট্রপিকাল অঞ্চলের বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে চাষ হয়।
অ্যাভোকাডো চাষ যেখানে সম্ভব নয়, তা হল, যেখানে জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল, যে জমিতে জল জমে, যেখানে লবণাক্ত ভূমি রয়েছে। খুব ভেজা মাটিতে অ্যাভোকাডো সম্ভব নয়, সেখানে শিকড়-পচা (Root-rot) রোগ দেখা যায়। মাটির ক্ষারাম্ল মান হতে হবে ৫ থেকে ৭। এর বেশি হলে মাটিতে আয়রনের ঘাটতি দেখা দেয়।
সফল অ্যাভোকাডো চাষ করতে জমি নির্বাচন:
অ্যাভোকাডো সফলভাবে চাষ করতে হলে চাষের নির্দিষ্ট অঞ্চল এবং জমি চিহ্নিত করতে হবে। দিনের সকল সময়ে সূর্যালোক পায় এমন জায়গা চাষের জন্য উত্তম। দেখতে হবে শুখা মরশুমে যেন পর্যাপ্ত আর্দ্রতা পায়। মাটিতে যতক্ষণ না পর্যন্ত ভালোভাবে শেকড় গজায়, রোপিত চারায় সেচ দিতে হবে। বিন্দুপাতি সেচ ভালো ব্যবস্থা। গোড়ায় জৈববস্তু দিয়ে মালচিং করে দিতে হবে। যেখানে জলজমার সমস্যা, সেখানে মাদা করে (mound) গাছ লাগাতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গে অ্যাভোকাডো চাষের সম্ভাবনা:
অ্যাভোকাডো-বিশ্বের সদৃশ্য জলবায়ু ও আবহাওয়া পশ্চিমবঙ্গে আছে। তাই এই রাজ্যে চাষের সম্ভাবনা। সমগ্র ভারতের মতোই একমাত্র ‘আসমুদ্রহিমাচল’ রাজ্য হল পশ্চিমবঙ্গ। দুইক্ষেত্রেই সাগর তার পা ধুইয়ে চলে, মাথায় হিমালয়ের মুকুট, উভয়ক্ষেত্রেই রয়েছে মালভূমি এবং সমতলভূমি। আর অন্য এমন কোনো রাজ্য নেই যাতে সর্বভারতীয় সদৃশ্য কৃষি-জলবায়ু অঞ্চল রয়েছে। এরাজ্যে ছ’টি কৃষি-জলবায়ু অঞ্চল পরিলক্ষিত হয় – পার্বত্য অঞ্চল, তরাই অঞ্চল, লাল কাঁকুড়ে মৃত্তিকা যুক্ত অঞ্চল, সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনাভূমি অঞ্চল, নবগঠিত পাললিক মৃত্তিকা অঞ্চল এবং পুরাতন পলিগঠিত অঞ্চল। এখানে রয়েছে মাটির বিভিন্নতা। রয়েছে জলবায়ুর বিভিন্নতা — টেম্পারেট (শীতপ্রধান), সাব-ট্রপিকাল (নাতিশীতোষ্ণ), ট্রপিকাল (ক্রান্তীয়) এবং সেমি-ট্রপিকাল জলবায়ু (মাঝারি ক্রান্তীয় জলবায়ু)। তবে রাজ্যে লাভজনক অ্যাভোকাডো চাষ করার আগে হোম-গার্ডেনে কয়েকটি উপযোগী জাত পরীক্ষা করে নেওয়াই ভালো, যেটা একদা দেড়-দু’শো বছর আগে শ্রীলঙ্কা করে দেখিয়েছে। অ্যাভোকাডো চাষে বাজারের জ্ঞান থাকাও দরকার, কোথায় বিক্রির সম্ভাবনা।
অ্যাভোকাডোর বীজের চারা না কলমের?
বীজের থেকে চারা তৈরি হবে, কিন্তু বীজের চারায় ৫-৬ বছরে ফল আসবে। বীজের চারার গুণবত্তা মা-গাছের অনুরূপ হয় না, কাঙ্ক্ষিত গুণমান পরিলক্ষিত হয় না। ফলের গুণমানে এবং ফলনে বৈষম্য প্রচুর৷ ক্রস পলিনেশনের জন্যই এই বিভিন্নতা। ভারতের নানান অঞ্চলে বীজের চারায় বংশবিস্তার হয়েছে। সেই গাছগুলি সবই গুটির জাত। বীজের অঙ্কুরোদগম ক্ষমতা থাকে ২ থেকে ৩ সপ্তাহ। তবে বীজ সংরক্ষিত করা যায় শুকনো পীট বা বালিতে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। পরিপক্ব ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করা হয়। জুলাই মাস বীজ সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। তাড়াতাড়ি বীজ কেয়ারিতে বা পলিব্যাগে ফেলতে হবে। ৮ ঘন্টা জলে ভিজিয়ে বীজ বুনতে হয়। বীজ বপনের আগে বীজের খোসাটি ছাড়িয়ে নিতে হয়। বীজ নার্সারীতে ফেলতে হবে ৩০x৬০ সেন্টিমিটার দূরত্বে। অঙ্কুরোদগমে সময় লাগে ৫০-১০০ দিন। ৮ থেকে ১২ মাসে চারাগুলি সরানোর জন্য রেডি হয়ে যায়। ৪-৫ পাতা বেরোলে বীজতলা থেকে পলিব্যাগে চারা স্থানান্তরিত হয়। চারার উচ্চতা হবে ৮০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার৷
অ্যাভোকাডোর অঙ্গজ বংশবিস্তার:
কলম বা অঙ্গজ জননে তৈরি চারাই রোপণ করতে হয়। কর্ণাটকে কলিকলম (Budding) বা জোড়কলম (Grafting) করে চারা তৈরির সুপারিশ আছে। T-budding বা Patch budding পদ্ধতিতে কলি-কলম করা যায়। Veneer এবং Cleft grafting বা ফাটল জোড় করে জোড়কলম সম্পন্ন হয়। এর মধ্যে ফাটল-জোড়ে কর্ণাটকে সাফল্য বেশি পাওয়া গেছে। সেখানে সেপ্টেম্বর মাসে সবচেয়ে ভালো চারা তৈরি হয়, তারপর মার্চ ও আগষ্টমাস। তামিলনাড়ুতে ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে গুটিকলম এবং ইনার্চিং সাফল্য লাভ করে। পশ্চিমবঙ্গে চিপ-বাডিং সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হচ্ছে বলে চারাকুশলীদের মত। ভারতে অ্যাভোকাডোর তেমন কমার্শিয়াল নার্সারী নেই, যেখানে অঙ্গজ-জনন সুসম্পন্ন হয়।
অ্যাভোকাডো কী দূরত্ব লাগানো হবে?
সাউথ ইণ্ডিয়াতে কফি বাগিচায় সাথীফসল হিসাবে অ্যাভোকাডোতে ৬ থেকে ১২ মিটার দূরত্বের সুপারিশ আছে, তবে গাছের বিস্তার ও সাথীফসলের উপর নির্ভর করে এই দূরত্ব। ৮ থেকে ১০ মিটারই আদর্শ, তবে ঘনচাষে ৬x৬ মিটার এমনকি ৫x৫ মিটার দূরত্ব দেওয়া চলে৷ সিকিমে যেখানে ভূমিক্ষয় রোধ করা অ্যাভোকাডো চাষের একটি কারণ, সেখানে পার্বত্য ঢালে ১০x১০ মিটার দূরত্ব দেওয়া হয়। ৬x৬ মিটার দূরত্বে গাছ লাগালে বিঘায় ৩৭ টি গাছ লাগে। ৮x৮ মিটার দূরত্বে ২১ টি, ১০x১০ মিটার দূরত্বে ১৩-১৪ টি গাছ লাগানো যায়।
অ্যাভোকাডো লাগানোর জন্য গর্ত:
উঁচু জায়গায় যেখানে জল জমে না, উর্বর দোঁয়াশ অথবা বেলে দোয়াশ মাটিতে ভালো রোদ পড়ে এবং মাটিতে জল নিষ্কাশনের সুবিধা আছে, এমন জায়গায় গাছ লাগানোর আগে সঠিক গভীরতায় গর্ত খুঁড়তে হবে ৬০ সেন্টিমিটার গভীর করে৷ সমস্যা যুক্ত মাটিতে বা নুড়িপাথরময় অঞ্চলে গাছের বৃদ্ধি সহায়ক জৈবপদার্থ পূর্ণ মাটির যোগান দিতে কখনো ১ ঘন মিটার গর্ত করা হয়। এপ্রিল-মে মাসে গর্ত করে তা পাশে তুলে রোদ খাওয়ানো হয়। এই গর্ত ভরাট করা হয় ১:১ অনুপাতে খামারপচা সার ও উপরের মাটির মিশ্রণে। গাছ লাগাতে হয় জুন-জুলাই নাগাদ, কখনো সেপ্টেম্বর মাসে৷ চারা লাগানোর সময় মাটির বল থাকবে মাটির লেভেলে বা সামান্য একটি উপরে। গুঁড়ি সোজা রাখতে খুঁটি পুঁতে দিতে হবে এবং গাছ বেঁধে দিতে হবে৷ জলমগ্ন স্থানে মাটি দিয়ে তৈরি উঁচু মাদায় গাছ লাগাতে হয়। অনেক সময় গাছগুলি শেডনেট দিয়ে আচ্ছাদিত করা হয়। গাছের গুঁড়ি অনেক সময় সাদা রঙ দিয়ে হোয়াইট ওয়াশ করা হয়৷
অ্যাভোকাডো চাষে সেচ:
মাটিতে যতক্ষণ না পর্যন্ত শেকড় গজায়, সেচ দিতে হবে। শুখা মরশুমে মাটি পর্যাপ্ত আর্দ্র রাখতে হবে৷ গাছে দেখেশুনে জল দেওয়া বিধেয়। গোড়ায় জৈবস্তর দিয়ে মালচিং হলে আর্দ্রতা বজায় থাকে, তাতে আগাছা দমিত হয়, তাপমাত্রা থাকে মাঝারি। সেচের একটি নির্ঘন্ট করে নিলে ভালো হয়৷ ছোটো চারায় প্রখর গ্রীষ্মে বেশি জল লাগে, একদিন অন্তর সেচ দিতে হয়। ঠাণ্ডা মাসগুলিতে সেচে কয়েকটি ছাঁটাই চলে। গাছ জলের অভাবে নুয়ে পড়লে, গাছ তৃষ্ণার্ত দেখালে সেচ দিতে হবে। সবসময় বিবেচনা করেই সেচ দিতে হয়। বয়স্ক গাছে শুখা মাসগুলিতে ৩/৪ সপ্তাহ অন্তর সেচ লাগে। আর্দ্রতার ঘাটতি অনেক সময় মালচিং করে মেটানো যায়। অ্যাভোকাডো চাষে বন্যা-ভাসানো সেচ ঠিক নয়, তাতে রুট-রট বা শেকড়-পচা রোগের আবির্ভাব ঘটে। তবে কখনো ৬০ সেন্টিমিটার বেসিন করে গাছের গোড়ার চারপাশে পরিমিত সেচ দেওয়া যায়।
অ্যাভোকাডো গাছে সার প্রয়োগ:
অ্যাভোকাডোতে জৈব ও অজৈব উভয় প্রকার সারই দিতে হবে৷ ৩০ সেন্টিমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বেসিন করে সার দেওয়া হলে ভাল। তারপর জল দিতে হবে৷ সুষম সার প্রয়োগ করা দরকার। প্রাথমিক পর্যায়ে ১:১:১ অনুপাতে নাইট্রোজেন-ফসফেট-পটাশ সার দিতে হয়। পরে ২:১:২ অনুপাতে তা প্রয়োগ করা যেতে পারে। ১০ বছরের পূর্ণবয়স্ক প্রতিটি গাছে ৮০০:২১০:৪০০ গ্রাম নাইট্রোজেন-ফসফেট-পটাশ সার দিতে হবে। এর সঙ্গে গাছ প্রতি ৬০ কেজি খামার পচা সার লাগবে। প্রথম বছরের গাছে প্রদত্ত পরিমাণটি হবে ১০০:৩০:৬০ গ্রাম, দ্বিতীয় বছরে ২০০:৬০:১২০ গ্রাম — এইরকমভাবে বাড়তে থাকে। এর সঙ্গে জৈবসার ১ থেকে ৩ বছরের জন্য ২৫ কেজি, ৪ থেকে ৬ বছরের জন্য ৩৫ কেজি, ৭ থেকে ১০ বছরের গাছে ৫০ কেজি লাগবে৷ অ্যাভোকাডো গাছে অনুখাদ্যের মধ্যে ফেরাস বা লোহা, জিঙ্ক বা দস্তা এবং বোরণ বা সোহাগার ভালো প্রভাব রয়েছে।

অ্যাভোকাডোর কায়াদান ও ডালপালা ছাঁটাই:
অ্যাভোকাডোর প্রাথমিক অবস্থায় বা যৌবনাবস্থায় হালকা করে ডালপালা ছাঁটাই করা হয়৷ যেমন ক্রিসক্রশ হয়ে যাওয়া ডালপালা, একের সঙ্গে আরেকটি লেগে থাকা ডালপালা ছাঁটতে হবে৷ সেই সঙ্গে পত্রল-বিস্তারে গাছের মুক্ত-কেন্দ্র (Open centre) নির্মাণ করিয়ে দিতে হবে। কায়াদানের (Training) এই প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে Plant Architecture বা গাছের সৌধ নির্মাণ। এতে গাছের অভ্যন্তরে আলো বাতাস পাবার সুবিধা হয়। গাছের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিচের ডালপালা কাটা হয়, তাতে সোজা ও উর্ধমুখী কাণ্ড বজায় থাকে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনমতো মৃত ডাল, রোগাক্রান্ত ডাল, ভীড় হওয়া ডাল কাটা হয়৷
Pollock-এর মতো উর্ধমুখী জাতের (Up right variety) আকৃতি প্রয়োজনমতো কমিয়ে দিতে হবে। আবার Fuerte-এর মতো প্রসারিত জাতের (Spreading variety) শাখাগুলি প্রয়োজনমাফিক পাতলা করে দিতে হবে, কমিয়ে দিতে হবে। ঝুলে পড়া, মাটিতে লেগে যাওয়া ডালগুলি ছেঁটে দিতে হবে যাতে পরিচর্যাগত সুযোগ মেলে। তবে এটাও ঘটনা অ্যাভোকাডোতে ডালপালা বেশি ছাঁটা হলে অতিরিক্ত পত্রল বিস্তার হয়, তাতে ফলন কমে।
অ্যাভোকাডো গাছে শত্রুপোকা:
অ্যাভোকাডো গাছে বেশ কয়েকটি ছিদ্রকারী পোকা বা মাজরা পোকা (Borer) লাগে। যেমন কচিশাখা ও বিটপ ছিদ্রকারী পোকা (Branch and twig borer), বাকল খেকো এবং গুঁড়িকাণ্ড ছিদ্রকারী পোকা (Bark and trunk borer), গুলিতে আহত ছিদ্র হওয়ার মতো গর্ত সৃষ্টিকারী পোকা (Shot hole borer), মাজরা পোকা (Stem borer). এছাড়া লাগে সাদামাছি (Spiralling white flies), চা-মশা (Tea mosquito bag), পাতা মোড়ানো পোকা (Leaf webber), দয়ে পোকা (Mealy bug), চিরুনি পোকা (Avocado thrips – Scirtothrips), মাকড় (Oligonychus perseae) ইত্যাদি। পরিচর্যাগত যত্ন নিলে মাজরা পোকা সহজেই দমন করা যায়, নইলে পরে পোকা দমন কঠিন হয়ে পড়ে। গাছের কাণ্ডে আঘাত থাকা মোটেই ঠিক নয়, কারণ আহত বা ছাঁটা অংশ রাসায়নিক প্রয়োগ করে আচ্ছাদন করে না দিলে, আঘাতপ্রাপ্ত অংশ থেকে নির্গত উদ্ভিজ্জ রসের গন্ধে পূর্ণাঙ্গ পোকারা আকৃষ্ট হয় এবং তারা গাছের গায়ে ডিম পেড়ে চলে যায়। ডিম ফুটে অপূর্ণাঙ্গ দশাগুলি গর্ত বাড়িয়ে প্রবেশ করতে থাকে এবং কোষকলা ভক্ষণ করতে থাকে। ছোটো চারা থেকেই কাণ্ডে হোয়াইট ওয়াশের প্রলেপ বা প্রাইমার রঙ লাগিয়ে দেওয়া যেতে পারে। তাতে মাজরার পূর্ণাঙ্গ পোকা ডিম পারতে অনিচ্ছুক হয়। পোকায় আক্রান্ত ডালপালা দেরী না করে সরিয়ে দিতে হবে। জৈবিক দমন পদ্ধতি সর্বদা অনুসরণ করাও কর্তব্য। প্রয়োজনে খুঁচিয়ে পোকা বার করে, অন্তর্বাহী কীটনাশক গর্তে তুলোয় করে দিয়ে, ভেজা কাদায় গর্ত সিল করে দেওয়া যেতে পারে।
অ্যাভোকাডোর রোগ সমস্যা:
অ্যাভোকাডোর রোগসমস্যার মধ্যে প্রধান হচ্ছে শেকড় পচা রোগ (Phytophthora root rot), কাণ্ড-প্রান্ত বা ডাটাপচা রোগ (Stem end rot), ব্যাক্টেরিয়াঘটিত নরম-পচা রোগ (Bacterial soft rot), অ্যানথ্রাকনোস বা কালো দাগী (Anthracnose), পাতা-ডালপালা-ফলে ছত্রাক সংক্রমণ বা স্ক্যাব (Scab disease), পাতায় শৈবাল ঘটিত দাগ (Algal leaf spot) ইত্যাদি। ছত্রাকঘটিত শিকড় পচা রোগে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। চাষ জমির জল নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতেই হবে৷ আর দরকার গোড়ার কাছাকাছি মাটি ড্রেনচিং করে বা খানিকটা খুঁড়ে অন্তর্বাহী ছত্রাকনাশকের দ্রবণ পরিমাণ মতো ঢেলে দিতে হবে৷ রুট-রট রোগের প্রতিরোধে ভালো নার্সারী থেকে স্বাস্থ্যবান চারা কিনতে হবে। পচন-সহনশীল এলাগাছ বা রুটস্টকের উপর জোড়কলমে পরশাখী জুড়লে ভালো৷ মাটিতে পরিমাণ মতো জিপসাম ব্যবহার করে ছত্রাকের স্পোর বা রেণু দমন করা যায়। মালচিং বা ভূ-আস্তরণে গোড়ার মাটি ঢেকে দিলে এই ছত্রাক অনেকটা দমন করা যায়। ফসফোনেট জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করা যেতে পারে। অ্যানথ্রাকনোস বা কালো দাগী রোগ দমন করতেও ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করতে হবে৷ ব্যাক্টেরিয়া নরম-পচা রোগ লেগেছে নিশ্চিত হলে, ছত্রাকনাশকের বদলে ব্যাক্টেরিয়া নাশক ওষুধে গোড়ার মাটি ও গাছ ভিজিয়ে দিতে হবে।

অ্যাভোকাডোর ফলন:
বীজের চারায় ৫-৬ বছরে ফল আসে। কলমের চারায় লাগানোর পরের মরশুমেই ফুল-ফল আসে। কিন্তু গাছের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে ফসল নেওয়া হয় না। কলমের চারায় চতুর্থ বছর থেকে অর্থাৎ তিন বছর পর নিয়মিত ফল চয়ন করা যায়। দক্ষিণ ভারতে আগষ্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ফল পাড়া হয়, যখন ফলের রঙের পরিবর্তন আসে এবং ফলের আকার বাড়ে। Purple জাতে ফল যখন কালচে বেগুনি হয় এবং Green জাতের ফলে যখন হলদেটে আভা দেখা দেয়, তখন ফল পাড়তে হবে৷ Arka Supreme এবং Arka Coorge Ravi জাতে মে-জুলাই মাসে ফল তোলা হয়৷
২৫-৩০ বা ততোধিক বছরের পুরাতন ও বৃহৎ গাছে তিন হাজারটির মতো ফল পাওয়া যায়। ১০ বছর বা তার বেশি গাছে চার-পাঁচশোটি ফল এলেই ভালো বলতে হবে। ফল পাড়ার ৪-৫ দিন পর ফল পাকে। অনেক ব্যবসায়ী ১০ পিপিএম ইথিলিন দিয়ে ফল পাকান। ১৫ থেকে ২১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফল পাকে। ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা হলে বিঘ্নিত হয়। ফল সংরক্ষণের জন্য ৬ থেকে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতিটি ফল একক স্তরে (Single layer) মোড়ানো হয়, যাতে বায়ুচলাচল স্বাভাবিক থাকে৷ উপযুক্ত প্যাকিং বাক্স বা কার্টুনে ফল দূরের বাজারে পাঠাতে হবে, যাত্রাপথে এবং ক্রেতার কাছে পৌঁছানোর সময় তা পরিপক্ব হয়ে ওঠে। উন্নত ফলনশীল এক একটি গাছে ৮০ থেকে ১০০ কেজি ফলন পাওয়া যায়। ৬x৬ মিটার দূরত্ব দিলে এক বিঘায় ৩৭ টি গাছ লাগানো যায়। কোয়ালিটি এবং জাত-ভেদে বাজারে প্রতি কেজি অ্যাভোকাডোর দাম ৫০০ থেকে ১৫০০ টাকা। যদি ২০০ টাকা কেজি দরেও পাইকারি রেটে ফল বেচা যায় এবং গাছ প্রতি ৮০ কেজি ফল ধরে তবে এই হিসাবে প্রতি বিঘায় আয় বছরে ৬ লক্ষ টাকা। জৈবিক পদ্ধতিতে বিঘা প্রতি খরচ এক লক্ষ টাকা করলেও বছরে বিঘা প্রতি নীট লাভ ৫ লক্ষ টাকা। জাত বৈচিত্র্য সম্পর্কে ভালোভাবে স্টাডি করে নিলে অ্যাভোকাডো ফলচাষ সত্যিই লাভজনক। আগামী দিনে রাজ্যের চাষীরা কীভাবে নিজেরাই পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে একটি উপযুক্ত চাষ ব্যবস্থাপনার দিকে যায়, সেটিই দেখার। ইতোমধ্যে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণার ফলাফলও আসতে শুরু করবে৷ সকলের যথাযোগ্য অংশগ্রহণ জরুরি।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার, ICAR-AICRP on Fruits, Mohanpur Center. BCKV.
অ্যাভোকাডো গাছ ও পুষ্পবিন্যাসের ছবি ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর নিজস্ব তোলা, ফলের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।]
তথ্যসূত্র:
- Ponnuswami, V., Padmadevi, K. and Muthukumar. S. 2012. Botany of Horticultural Crops. Narendra Publishing House, Delhi, pp. 98
- Singh, A., Mishra, D. S. and Singh, N. 2014. Avocado, In: Tropical and Subtropical fruit crops: Crop improvement and varietal wealth, Part-I. Ed. S. N. Ghosh, Jaya publishing house, Delhi, pp. 27-37.
- De, L. C. and Bhattacharya, S.K. 2008. Hand book of edible fruits. Aviskar Publishers, Distributors, Jaipur, pp. 375-377.
- Murulidharan, B. M. 2023. Avocado varieties Arka Supreme and Arka Coorg Ravi. MLT proposal presented at GD 10 of ICAR-AICRP on Fruits on 02/03/2023 from CHES, ICAR-IIHR, Bengaluru.
- Anonymous 1995. Descriptors of Avocado ( Persea spp ), IPGRI, Rome, Itali, pp: 1-52.
[অ্যাভোকাডো চাষ সম্পর্কে আকাশবাণী কলকাতার গীতাঞ্জলিতে বিস্তারিত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নিবন্ধের দ্বিতীয় লেখক ড. কল্যাণ চক্রবর্তী। সাক্ষাৎকারের জন্য প্রয়োজনীয় লিটারেচার নিবিড়পাঠ করে তথ্য সংকলন, সম্পাদনাসহ মূল্যবান সংযোজন, ভাষাগত পরিমার্জন করে দিয়েছেন প্রযুক্তিবিদ অস্মিতা চক্রবর্তী]
অস্মিতা চক্রবর্তী এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
