‘দড়িতে ঝুলে খাদ পেরোতে না পারলে ওই মানুষগুলোর কাছে পৌঁছোতেই পারতাম না’! বিধ্বস্ত নাগরাকাটায় চিকিৎসক ইরফান

পরনে নীল-সাদা চেক শার্ট আর কালো ট্রাউজার্স। পায়ে সাদা হাওয়াই চপ্পল। মাথায় ফাইবারের হলুদ হেলমেট। হাতে গ্লাভস! দড়ি বেয়ে খাদ পার হচ্ছেন এক তরুণ। গত ২৪ ঘণ্টায় যে ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল।

না! কোনও ‘অ্যাডভেঞ্চার’ নয়। গত রবিবার এ ভাবেই খাদ পেরিয়ে দুর্যোগ-ধ্বস্ত বামনডাঙায় পৌঁছেছিলেন ৩২ বছরের চিকিৎসক মোল্লা ইরফান হোসেন। ৫০ ফুটের বেশি রাস্তা ধসে গিয়েছে। তৈরি হয়ে গিয়েছে খাদ। দুর্যোগের ঝাপটায় তখন লণ্ডভণ্ড অবস্থা। ইরফানের সঙ্গে একই ভাবে দড়িতে ঝুলে খাদ পেরিয়েছিলেন আরও চার জন স্বাস্থ্যকর্মী। পৌঁছেছিলেন গ্রামে। ঘুরেছিলেন বাড়ি বাড়ি।

ইরফান জলপাইগুড়ির নাগরাকাটা ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিক। অতীতে কখনও এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে? মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দুর্যোগে বিধ্বস্ত এলাকায় ঘুরতে ঘুরতেই ফোনে ইরফান জানাচ্ছিলেন, কখনও এই ধরনের অভিজ্ঞতা হয়নি তাঁর। ভয় লাগেনি? ইরফানের জবাব, ‘‘বিপর্যয় মোকাবিলা দলের লোকজন ছিলেন। তাঁরা সাহায্য করেছিলেন। আর সেই সময়ে ভয় কাজ করেনি। কারণ তখন গ্রামে পৌঁছোতেই হতো। ওই ভাবে না হলে গ্রামে বিপর্যস্ত মানুষের কাছে পৌঁছোতেই পারতাম না।’’

বর্ধমান শহরের ছেলে ইরফান। বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল বয়েজ় স্কুল, আল আমিন মিশনে পড়াশোনার পরে ডাক্তারিতে সুযোগ পান। ভর্তি হন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে। এমবিবিএস পাশ করার পর আপাতত তিনি সরকারি স্বাস্থ্য আধিকারিক। পরিবারের বাকিরা থাকেন বর্ধমানেই। তাঁরা ছবি দেখেননি? দেখেছেন। ইরফান জানিয়েছেন, পরিবারের তরফে তাঁকে বলা হয়েছে, তিনি যেন সাবধানে থেকে দুর্গতদের সাহায্য করেন।

পরিস্থিতি কেমন? বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ইরফান জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি মোটেই ভাল না। বিভিন্ন জায়গা বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘আহত, জখম মানুষের উপায় নেই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসার। তাই আমাদেরই পৌঁছে যেতে হচ্ছে গ্রামে গ্রামে। রবিবার থেকে এই কাজটাই করে চলেছি।’’ দড়িতে ঝুলে খাদ পার হতে ভয় না-পেলেও ইরফান জানাচ্ছেন, এখন তাঁর ‘ভয়’ লাগছে। কেন? তাঁর কথায়, ‘‘অনেকে ফোন করছেন। জানতে চাইছেন। এতে ভয় লাগছে!’’ ইরফান শুধু চিকিৎসা করে যেতে চান। প্রচারের আলো তাঁর উপর পড়ুক তিনি চান না। মুখে না-বললেও তাঁর ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট, তিনি মনে করেন না তিনি বিরাট কিছু করেছেন। বরং তিনি মনে করেন, পেশার প্রতি দায়বদ্ধ হলে যা করা উচিত, তা-ই করেছেন। বাড়তি কিছু নয়।

ঘটনাচক্রে, ইরফান তৃণমূলের চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ হেল্থ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। সেটা নিয়েও খুব ঢাক পেটাতে চান না ইরফান। থাকতে চান কাজে। চিকিৎসায়। বিধ্বস্ত মানুষের পরিষেবায়। আপাতত নাওয়াখাওয়া ভুলে সেটাই করে যেতে চান। চান না তাঁকে নিয়ে হই হই হোক। কারণ, মানুষ অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। তিনি তাঁর পেশার দায়বদ্ধতা পালন করছেন মাত্র!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.