ইরানকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতে বলেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ইরানও জবাব দিয়েছে, তারা মাথা নত করবে না। ট্রাম্পের হুমকির পরেই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতোল্লা আলি খামেনেই ‘যুদ্ধ শুরু’র ঘোষণাও করে দিয়েছেন। তার পর থেকেই তীব্র জল্পনা, এ বার কি সত্যিই যুদ্ধের ময়দানে নামবে আমেরিকা? ট্রাম্পের জবাব, ‘‘করতেও পারি, আবার না-ও করত পারি। কেউ জানে না আমি কী করব।’’
মঙ্গলবার সরাসরি খামেনেইকে নিশানা করেছিলেন ট্রাম্প। বলেছিলেন, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা কোথায় লুকিয়ে রয়েছেন, তা তিনি জানেন। কিন্তু এখনই তাঁকে হত্যা করবে না আমেরিকা। ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে জানিয়ে ইরানকেও ‘তছনছ’ করে দেওয়ার হঁশিয়ারি দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের সেই হুঁশিয়ারির কয়েক ঘণ্টা পর, বুধবার জবাব দিলেন খামেনেই। এক্স হ্যান্ডলে পর পর পোস্ট করে ‘যুদ্ধ শুরু’র ঘোষণা করলেন তিনি।
যদিও সেই যুদ্ধ কার বিরুদ্ধে, তা ওই পোস্টে অবশ্য স্পষ্ট করা হয়নি। ফার্সি ভাষায় করা ওই পোস্টের সঙ্গে খামেনেই একটি ছবিও দেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, এক ব্যক্তি তরোয়াল হাতে একটি দুর্গের প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে। তাঁর পিছনে রয়েছেন অনুগামীরা। আর আকাশ থেকে উল্কা ঝরছে! ওই পোস্টের পরেই খামেনেই ইজ়রায়েলকে নিশানা করে লিখেছেন, ‘‘আমাদের অবশ্যই সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কঠোর জবাব দিতে হবে। আমরা কোনও ইহুদিবাদীদের প্রতি দয়া দেখাব না!’’ প্রসঙ্গত, ট্রাম্পের পর ইজ়রায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজ়রায়েল কাৎজ়ও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, খামেনেইয়ের পরিণতিও প্রতিবেশী ইরাকের পদচ্যুত এবং নিহত প্রাক্তন সর্বাধিনায়ক সাদ্দাম হুসেনের মতো হবে!
পরে টেলিভিশন বার্তাতেও নাম না করে ট্রাম্পকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন খামেনেই। বলেছেন, ইরানকে যারা চেনে, তারা এই ভাষায় কথা বলে না। ধর্মীয় নেতার কথায়, ‘‘বুদ্ধিমান লোকজন, যাঁরা ইরানকে চেনেন, ইরানিদের চেনেন, ইরানের ইতিহাস জানেন, তাঁরা কখনও এই ধরনের হুমকির ভাষায় কথা বলেন না। আমেরিকানদের জানা উচিত, আমেরিকার সেনাবাহিনীর যে কোনও রকমের হস্তক্ষেপ অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে আনবে।’’ ইরানের উপর ‘যুদ্ধ’ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে খামেনেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তাঁরা আত্মসমর্পণ করবেন না। কোনও ‘চাপিয়ে দেওয়া শান্তি’র কাছেও মাথানত করবে না ইরান।
খামেনেইয়ের জবাবের পরেই বিভিন্ন মহলে ধারণা তৈরি হয় যে, এ বার হয়তো ট্রাম্পের ‘ধৈর্যের বাঁধ’ ভাঙবে! এ কথাও ঠিক যে, ওয়াশিংটনে তৎপরতাও বেড়েছিল। ওয়াকিবহাল মহলের একাংশের দাবি, মঙ্গলবার মার্কিন গোয়েন্দাদের সঙ্গে বৈঠকেও বসেছিলেন ট্রাম্প। যদিও সেই বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা জানা যায়নি।
সংবাদমাধ্যম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী খবর, ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধে আমেরিকা যোগ দিলে পশ্চিম এশিয়ায় যে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, সেখানে হামলা চালাতে ক্ষেপণাস্ত্র এবং সামরিক সরঞ্জাম প্রস্তুত রাখছে ইরান। ইরান সমর্থিত বিদ্রোহী গোষ্ঠী হুথি-ও লোহিত সাগরে মার্কিন যুদ্ধজাহাজে হামলা করতে পারে বলে মনে করছেন আমেরিকার প্রশাসনিক কর্তারা। কেউ কেউ আবার এ-ও মনে করছেন, ইরান হরমুজ প্রণালীতে ‘মাইনিং’ও শুরু করতে পারে। সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, জর্ডন এবং সৌদি আরব-সহ পশ্চিম এশিয়ায় সামরিক ঘাঁটিতে মোতায়েন মার্কিন সেনাদের উদ্দেশে এ নিয়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। রিপোর্টে দাবি, পশ্চিম এশিয়ায় ৪০ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে।
আমেরিকার সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, মঙ্গলবার ট্রাম্পের সঙ্গে ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ফোনে কথা হয়েছিল। তবে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে কী কথা হয়েছে, তা জানা যায়নি। নেতানিয়াহু চান, আমেরিকা এই যুদ্ধে সামরিক হস্তক্ষেপ করুক। ইরানের মাটির তলার পারমাণবিক কেন্দ্র ফোরডোয় বোমা ফেলুক, যাতে ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। কারণ, ওই পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করতে যে বোমা প্রয়োজন, তা এই মুহূর্তে ইজ়রায়েলের হাতে নেই! ট্রাম্পও আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন, তিনি চান না ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র আসুক। বার বার ইরানের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনাও করেছে আমেরিকা। তার মধ্যেই ইজ়রায়েল হামলা চালানোয় ষষ্ঠ দফার বৈঠক বাতিল হয়ে গিয়েছে। ইরানই আর বৈঠক করতে চায়নি।
পরে সংবাদপত্র ‘দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ দাবি করেছিল, আরবের মধ্যস্থতাকারীদের মারফত আমেরিকা এবং ইজ়রায়েলের কাছে বৈঠকে বসার বার্তা পাঠিয়েছে ইরান। যদিও সেই সময় আমেরিকা বা ইজ়রায়েল কেউ সে বিষয়ে মুখ খোলেনি। ইরানের তরফেও সরকারি ভাবে এ বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। তবে বুধবার ট্রাম্প দাবি করলেন, ইরান আলোচনায় বসতে চেয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘‘ইরানের অনেক সমস্যা রয়েছে। ওরা আলোচনায় বসতে চায়। এটি এত দিনে সেরে নেওয়া উচিত ছিল। ওরা (আমেরিকার সঙ্গে) যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু আমি বলে দিয়েছি, এখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে।’’ ট্রাম্প এ-ও দাবি করেছেন, ইরান আর হামলা প্রতিরোধ করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বলে কিছুই নেই ইরানের।
কী হল গত ২৪ ঘণ্টায়?
গত ২৪ ঘণ্টাতেও ইরান-ইজ়রায়েলের মধ্যে হানাহানি অব্যাহত থেকেছে। বুধবার ভোর (ভারতীয় সময়) থেকেই ইরানে হামলার তেজ বাড়িয়েছিল ইজ়রায়েল সেনা। তেহরানের কাছে তেল সংশোধনাগারে বোমাবর্ষণ করে তারা। ইরানের তেল সংশোধনাগার ধ্বংসের একাধিক ভিডিয়ো ছড়িয়েছে সমাজমাধ্যমে। কারাজ় শহরেও বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গিয়েছে। ইরানের দাবি, বুধবার তেহরানের একটি সেন্ট্রিফিউজ় কারখানায় হামলা চালিয়েছে ইজ়রায়েল। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দাবির ভিত্তিতে সংবাদ সংস্থা এপি জানিয়েছে, গত পাঁচ দিনে ইজ়রায়েলের হামলায় ইরানে এখনও পর্যন্ত ৫৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ১৩২৬ জন। মঙ্গলবার গভীর রাতে ইজ়রায়েলেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। মঙ্গলবার রাত ১২টা ৪০ মিনিট নাগাদ পর পর কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র ইজ়রায়েলের দিকে ছুটে আসে। সঙ্গে সঙ্গে বাজতে শুরু করে সাইরেন। এক নাগাড়ে অন্তত ১৫টি ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। তার পর প্রায় ৪০ মিনিটের বিরতির পর ফের দ্বিতীয় হামলা শুরু হয়। দ্বিতীয় ধাপে মধ্য ইজ়রায়েল এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক লক্ষ্য করে অন্তত ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র ধেয়ে আসে। তবে এখনও পর্যন্ত ওই ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতির কোনও খবর পাওয়া যায়নি। ইরানের সেনাবাহিনীর দাবি, ইজ়রায়েলের উপর তারা ‘হাইপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। বিভিন্ন রিপোর্টে দাবি, উত্তর ইজ়রায়েলের অবস্থিত মেরন বিমানঘাঁটি এবং সে দেশের একটি বায়ুসেনা ঘাঁটিতেও হামলা চলেছে।
ইন্টারনেট বন্ধ হল ইরানে
ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতের আবহে দেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে ইরান। মঙ্গলবার বিকেল থেকেই ইরানের বিস্তীর্ণ অংশে ইন্টারনেট প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে খবর, ক্রমশ সম্পূর্ণ ‘ব্ল্যাক আউট’-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ইরান। সংবাদমাধ্যম এনবিসি নিউজ়-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ইজ়রায়েলি হামলার কারণে নয়, বরং ইরান সরকারের সিদ্ধান্তেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ‘কেন্টিঙ্ক’ এবং ‘নেটব্লক্স’ নামে দুই সংস্থা সারা বিশ্বে ইন্টারনেট সংযোগের উপর নজর রাখে। তারা জানিয়েছে, স্থানীয় সময় অনুযায়ী মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৫টা থেকে ইরানে ইন্টারনেট সংযোগ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে গিয়েছে। কোথাও কোথাও খুবই ধীরগতিতে পরিষেবা চলছে। তবে এর ফলে সব মিলিয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছে ইরানিদের। অন্য দিকে, অতি ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে বিদেশি সাইটগুলি দেখার জন্য ব্যবহৃত ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক (ভিপিএন)-এর মতো পরিষেবাগুলিও প্রভাবিত হয়েছে। ইন্টারনেট পরিষেবা সংস্থা ‘ক্লাউডফ্লেয়ার’-ও জানিয়েছে, ইরানের দু’টি প্রধান মোবাইল নেটওয়ার্ক সংযোগ আচমকা বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে ইরান সরকারের মুখপাত্র ফাতেমেহ মোহাজেরানি জানিয়েছেন, ইজ়রায়েলি সাইবার হামলার প্রতিক্রিয়া হিসাবে আপাতত সাময়িক ভাবে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। এর আগে ২০১৯ সালে ইরানে দেশজোড়া বিক্ষোভের সময় শেষ বার ছ’দিনের ‘ব্ল্যাক আউট’ কার্যকর করা হয়েছিল। সেই ঘটনার দীর্ঘ ছ’বছর পর আবার একই পথে হাঁটল ইরান। ইরানের মানবাধিকার সংস্থা মিয়ান গ্রুপের এক কর্তা আমির রশিদি জানিয়েছেন, যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত কিছু জনপ্রিয় অ্যাপও বন্ধ করে দিয়েছে ইরান। এর মধ্যে হোয়াট্সঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম-ও রয়েছে! নাগরিকদের কাছে ইরান সরকার আর্জি জানিয়েছে, তাঁরা যেন নিজেদের ফোন থেকে হোয়াট্সঅ্যাপ মুছে ফেলেন। ইরানের দাবি, মেটা-র মতো যে সংস্থাগুলি ইজ়রায়েলের কাছে গোপনে তথ্য পাচার করছে। পাল্টা জবাব দিয়েছে হোয়াট্সঅ্যাপও। হোয়াট্সঅ্যাপের তরফে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছে, ‘‘এই সঙ্কটময় মুহূর্তে, যখন মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, সে সময় পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার জন্যই এ সব মিথ্যা অজুহাত দিচ্ছে ইরান।’’ হোয়াট্সঅ্যাপ ছাড়াও গুগল এবং অ্যাপলের অ্যাপ স্টোর ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও পর্যন্ত ইরানের জাতীয় তথ্য নেটওয়ার্ক (এনআইএন) ব্যবহার করতে পারছেন ইরানবাসীরা।
বাংলাদেশি কর্তার বাড়িতে হামলা
ইরানে বাংলাদেশি দূতাবাসের এক আধিকারিকের বাড়ি ভেঙে গুঁড়িয়ে গেল ইজ়রায়েলি হামলায়! গত শুক্রবার থেকে ইরান এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে। দু’দেশই একে অন্যের উপর হামলা চালাচ্ছে। ইরানের রাজধানী তেহরান এবং সংলগ্ন বিভিন্ন অঞ্চলে হামলা হচ্ছে বলে অভিযোগ ইরানের। ‘বিবিসি বাংলা’র প্রতিবেদন অনুসারে, তেহরানে বাংলাদেশি দূতাবাসে কর্মরত আধিকারিকদের বাসভবনেও হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তেহরানে বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্তারা মূলত থাকেন জর্ডন নামে একটি এলাকায়। তেহরানের তিন নম্বর জেলার মধ্যে পড়ে এই জায়গাটি। ‘বিবিসি বাংলা’কে ইরানে বাংলাদেশি দূতাবাসের আধিকারিক ওয়ালিদ ইসলাম বলেন, “আমার বাড়ি পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দিয়েছে।” ওয়ালিদ ইরানে বাংলাদেশি দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি। ইজ়রায়েলি আক্রমণের সময় তিনি বাড়িতে ছিলেন না। তেহরানে কর্মরত বাংলাদেশি দূতাবাসের ওই কর্তার দাবি, শুধু তাঁর বাড়িই নয়, আশপাশে আরও অনেকগুলি বাড়িই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কূটনীতিকদের কয়েকটি বাড়িই আপাতত টিকে রয়েছে ওই এলাকায়। বস্তুত, ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের তরফে আগেই কূটনীতিকদের অন্যত্র সরে যেতে বলা হয়েছিল। সেইমতো তাঁরা বাংলাদেশের দূতাবাস কমপ্লেক্স ছেড়ে তেহরানের অন্য এলাকায় সরে যান।