‘প্রথম দেখলাম’! সশক্তিকরণের ‘সাফল্য’ দেখে বঙ্গ বিজেপির দরাজ প্রশংসায় বনসল, ধরলেন ডিজিটাল যাচাইয়ের ‘ফাঁকি’ও

মাঝে তিন বছর চার মাসের ব্যবধান। তার ও পারে ছিল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অসন্তোষ, শূন্য থেকে শুরু করার বার্তা। সঙ্গে বুথ স্তর থেকে সংগঠন নতুন করে গড়ে তোলার পরামর্শ। আর তার এ পারে পৌঁছে বঙ্গ বিজেপি পেল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রশংসা, সন্তুষ্টি। এবং সে সব জুটল সংগঠনের বুথ স্তরকে ‘শক্তিশালী’ করে তোলার কর্মসূচি রূপায়ণ করেই। ২০২১ সালের পরে সম্ভবত এই প্রথম বার পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির এমন ‘দরাজ শংসাপত্র’ পেল দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে।

প্রশংসার মাঝে অবশ্য ঈষৎ কটাক্ষও জুটেছে। সাংগঠনিক হিসাবে জল মেশানোর প্রবণতা বন্ধ করতে গোটা ‘বুথ সশক্তিকরণ’ কর্মসূচিকে নিশ্ছিদ্র করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকেরা। আপাতদৃষ্টিতে যে বন্দোবস্তকে নিশ্ছিদ্র বলে তাঁরা মনে করেছিলেন, বাংলার বিজেপি কর্মীদের ‘মেধা’ যে সেখানেও ছিদ্র খুঁজে নিয়েছে! তবে কর্মসূচি রূপায়ণের সামগ্রিক চেহারা দেখে বনসল সন্তুষ্ট বলে বিজেপি সূত্রের খবর। তাই ঈষৎ ‘কারচুপি’র চেষ্টাকে ‘লঘু অপরাধ’ হিসেবেই আপাতত দেখেছেন।

গত কয়েক মাস ধরে দফায় দফায় বিজেপির কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক বনসল বঙ্গ বিজেপির ‘বুথ সশক্তিকরণ টিমের’ সঙ্গে বৈঠক করছেন। জেলা, মণ্ডল, শক্তিকেন্দ্র এবং বুথ— সব স্তরের কমিটির চেহারা সরেজমিনে খতিয়ে দেখে এসে ‘টিম’ রিপোর্ট দিয়েছে বনসলকে। তার ভিত্তিতে তিনি প্রতি বারই পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন। বিজেপি সূত্রের দাবি, বুথে বুথে পৌঁছে দলের সাংগঠনিক পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখার পরে ৮০ হাজার বুথের মধ্যে প্রায় ৬০ হাজার বুথে কমিটি গঠনের কাজ সারা। দ্বিতীয় বারের ‘ডিজিটাল যাচাই’ প্রক্রিয়ার কাজও প্রায় শেষ পর্বে।

মঙ্গলবার সকালে বিধাননগর সেক্টর ফাইভের বিজেপি দফতরে এই কমিটির সঙ্গে ফের বৈঠকে বসেন বনসল এবং রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। বৈঠকের শুরুতেই বনসল এই কর্মসূচির ‘সাফল্যের’ ভূয়সি প্রশংসা করেন। সূত্রের দাবি, পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি কোনও সাংগঠনিক কর্মসূচির রূপায়ণ এত ‘গুরুত্ব দিয়ে’, এত ‘সফল ভাবে’ এবং এত ‘মসৃণ ভাবে’ করেছে, এমনটা তিনি এই প্রথম দেখলেন বলেও বনসল মন্তব্য করেন। বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সন্তোষ প্রকাশ করে জানান, রাজ্য স্তরে হোক বা তার নীচের স্তরে, যাঁরা এই কর্মসূচি রূপায়ণের দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে যে রকম সমন্বয় ও সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিতে তেমনটা তিনি আগে দেখেননি।

তিন বছর চার মাস আগে ঠিক এর বিপরীত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি। ২০২২ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে নিউটাউনে বঙ্গ বিজেপির নেতৃত্বকে নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন অমিত শাহ। কোনও রাখঢাক না করে বলেছিলেন, আবার বুথ স্তর থেকে সংগঠন নতুন করে গড়তে হবে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে আবার শূন্য থেকে শুরু করতে হবে। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ার পরে রাজ্য জুড়ে বিজেপির সংগঠন পুরোপুরি ধসে গিয়েছিল। ২০২২ সালে শতাধিক পুরসভার নির্বাচনে বিজেপির ভোটপ্রাপ্তির হার ১৩ শতাংশে নেমে আসে। বিজেপির থেকে কিছু আসন কম পেলেও শতাংশের বিচারে বামেদের সম্মিলিত ভোট বিজেপির থেকে ১ শতাংশ বেশি ছিল সে বার। দল বাংলায় কোথা থেকে কোথায় নেমেছে, বুঝতে অসুবিধা হয়নি শাহের। তাই শুধু শূন্য থেকে শুরু করার বার্তা দিয়ে থামেননি। বাংলায় জিততে হলে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেক উত্থান-পতন পেরিয়েই এগোতে হবে, হাল ছাড়লে চলবে না, সে বার্তাও দিয়েছিলেন।

শাহের সেই বৈঠকের পরে গঙ্গা দিয়ে অনেক জলই গড়িয়ে গিয়েছে। ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি আবার বাম-কংগ্রেসকে অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যে বিজেপির আসনসংখ্যা ১৮ থেকে ১২-য় নামলেও শতাংশের বিচারে ভোটপ্রাপ্তির হার ২০২১ সালের হিসাবের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। তার পরে জোরকদমে বিধানসভা নির্বাচনের প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। কিন্তু এই সময়কালে বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব অভ্যন্তরীণ বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতার কাছ থেকে দরাজ শংসাপত্র বা ভূয়সি প্রশংসা পেয়েছেন, এমন খবর মেলেনি। তাই মঙ্গলবারের বৈঠকে বনসলের এই ‘সন্তোষ প্রকাশ’কে খাটো করে দেখছেন না রাজ্যের বিজেপি নেতারা।

সে সবের মাঝেও অবশ্য ‘কারচুপি’ ধরে ফেলার কথা বলতে ভোলেননি বনসল। বিভিন্ন স্তরের সাংগঠনিক কমিটির পদাধিকারী ও সদস্যদের নাম-ধাম তাঁদের এলাকায় পৌঁছে ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় যাচাই করা হচ্ছে এ বার। ভুয়ো সদস্যের পাসপোর্ট সাইজ ছবি বসিয়ে ফর্ম পূরণ করে রাজ্য নেতৃত্বের কাছে পাঠিয়ে দিয়েই আগে কাজ সেরে ফেলতেন নীচের স্তরের অনেক নেতা। তা রুখতে এ বার ‘বুথ সশক্তিকরণ টিম’ একেবারে বুথ পর্যন্ত পৌঁছে একটি অ্যাপের মাধ্যমে কমিটি সদস্য ও পদাধিকারীদের পরিচয়ের সত্যতা যাচাই করেছেন। প্রত্যেক কমিটি সদস্য তথা পদাধিকারীকে ওই অ্যাপের ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পাতা ফেলতে হয়েছে। তবেই তাঁদের ছবি উঠেছে এবং তাঁদের অস্তিত্ব যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু বিজেপি সূত্রের খবর, সে প্রক্রিয়াকেও কোথাও কোথাও ফাঁকি দেওয়া হয়েছে বলে বনসল বৈঠকে জানান। কর্মসূত্রে ভিনরাজ্যে চলে গিয়েছেন, এমন ভোটারদেরও কমিটিতে রাখা হয়েছিল কোথাও কোথাও। ডিজিটাল যাচাইয়ের সময়ে ভিডিয়ো কলে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অ্যাপের ক্যামেরার সামনে চোখের পাতা ফেলতে বলা হয়েছে। তাতে ডিজিটাল যাচাই সম্পন্ন করা গিয়েছে ঠিকই। কিন্তু বনসলের কান পর্যন্ত সে খবর পৌঁছেও গিয়েছে। বিজেপি সূত্র জানাচ্ছে, কটাক্ষের সুরে সহাস্য বনসল বলেছেন, ‘‘এ সব বাংলার বিজেপি কর্মীদের পক্ষেই সম্ভব!’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.