ভাবিনি, একটা ফেসবুক পোস্ট ওই রকম দাবানলের মতো হয়ে যাবে। ভাবিনি, এত এত মানুষ রাস্তায় নেমে আসবেন। ভাবিনি, এত মানুষ নিজের মতো করে তাঁদের এলাকায় আন্দোলনকে সংগঠিত রূপ দেবেন। যা ভাবিনি, তা-ই হয়েছে। সেই রাতে নতুন দিনের মশাল জ্বলেছে। সেই মশালকে প্রজ্বলিত রাখাই এখন কাজ। যে মানুষ রাতের দখল নিয়েছিলেন, যাঁরা প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন, সেই মানুষকে আন্দোলনের রাস্তায় রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ। সেটাই এখন দায়িত্ব বলে মনে করছি। কারণ, লড়াইটা অনেক লম্বা। যেতে হবে অনেকটা পথ। যেতে হবে দূর।
হ্যাঁ লড়াইটা লম্বা। তার কারণ, এটা কাঠামো বদলের লড়াই। এই কাঠামো বদলে সেই কাঠামো গড়ে তোলার লড়াই, যা বদল ঘটাবে মানসিকতায়। ধর্ষণের পর খুন, তার বীভৎসতা ক্রমশ ধারাবাহিক হয়ে যাচ্ছে। অতীতের তুলনায় যা অনেক বেশি আগ্রাসী। হিংস্র। পৈশাচিক। মনে রাখতে হবে, নির্ভয়াকাণ্ড সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছিল বীভৎসতার জন্য। কিন্তু তার পর থেকে আরও ঘটনা ঘটেছে। সেগুলিও নারকীয়। শিউরে ওঠার মতো। হাথরস থেকে উন্নাও, কাঠুয়া থেকে আরজি কর— সর্বত্রই সেই বীভৎসতা বিরাজ করেছে। একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে। পুলিশ কিংবা আদালতের কাছে গিয়ে সুরাহার চেষ্টা হচ্ছে বটে। কিন্তু ঘটনা থামছে না। তদন্ত, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা কিছুতেই কাটছে না। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে বিচার হলেও তা কখনওই এক বছর বা তার কম সময়ে শেষ হচ্ছে না। একটি ঘটনার তদন্ত বা বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার আগেই আরও একটি ততোধিক হিংস্র ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এমন কোনও নীতি বা কাঠামোগত বদল হচ্ছে না, যা মানসিকতা পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। সেটাই আমাদের করতে হবে। সেটাই আমাদের লক্ষ্য এখন।
যে মহিলারা কখনও ভাবেননি আন্দোলনের সরণিতে নামবেন, তাঁরা সেই রাতে নেমেছিলেন। নিজেদের মতো করে সবটা করেছেন। জেলায় জেলায় যাঁরা রাত দখলের ‘কোঅর্ডিনেটর’ ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং সমন্বয় করে এগোতে হবে। কেন্দ্রীয় ভাবে কর্মসূচি এবং আন্দোলনের রূপরেখা ঠিক করে অগ্রসর হলে আশা করি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে। ঘটানো সম্ভব। এই সাহস পাচ্ছি ১৫ অগস্ট শুরুর রাত থেকে। যে রাতে মশাল জ্বলেছিল।
এখন মূলত চারটি বিষয়কে ‘ফোকাস’ করে এগোতে চাই। এক, এই ধরনের ঘটনায় নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় তদন্ত সুনিশ্চিত করা। দুই, স্কুল পাঠ্যক্রমে লিঙ্গসাম্যের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা। তিন, রাতে সুরক্ষিত গণপরিবহণ এবং চার, কর্মস্থলে রাতে মহিলাদের জন্য নিরাপদ বিশ্রামকক্ষ। স্কুল পাঠ্যক্রমে লিঙ্গসাম্য অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। যে ভাবে অন্যান্য বিষয়ের সিলেবাস শ্রেণি অনুযায়ী বদলায়, তেমনই লিঙ্গসাম্যের পাঠক্রমও জরুরি। দিল্লির ঘটনার পরে অনেক কিছু হয়েছিল। বিশাখা কমিটির সুপারিশে যা বলা হয়েছিল, বাস্তবে তার প্রায় কোনও কিছুই প্রয়োগ করা হয়নি। কর্মক্ষেত্রে মহিলারা আক্রান্ত হলে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে যে তদন্ত হওয়া প্রয়োজন, তা হয় না। এ নিয়ে বহু জায়গায় বহু আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু অবস্থার বদল হয়নি। আসলে মৌলিক জায়গায় বদল সবচেয়ে বেশি জরুরি। সেটা মানসিকতার বদল।
যে মহিলারা চিকিৎসাক্ষেত্র, বহুজাতিক সংস্থা বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কর্মরত, তাঁদের রাতে কর্মস্থলে থাকতে হয়। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করে ফিরতেও হয়। সেখানে যদি ন্যূনতম পরিকাঠামো থাকে, তা হলে অনেক অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব। কেন একজন কর্মরত চিকিৎসককে সেমিনার রুমে রাতে বিশ্রাম নিতে হবে? কেন নিরাপদ বিশ্রামের কক্ষ থাকবে না? যদি আরজি করে তা থাকত, তা হলে তো এই ঘটনাটা ঘটত না! কর্মস্থলে মহিলাদের জন্য এমন পরিকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে, যাতে তাঁরা একাগ্রতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন। প্রতিটি কর্মস্থলে শিশু রাখার ক্রেশের ব্যবস্থা থাকা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। যাতে কাজের সময়ে সেই মহিলাকে সন্তানের জন্য মানসিক উচাটনের মধ্যে থাকতে না হয়। গৃহশ্রমিক থেকে বহুজাতিক সংস্থার কর্মী— সকলের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য। রাতের গণপরিবহণ ব্যবস্থায় নিরাপত্তাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এই সব নিয়েই আন্দোলন জারি রাখতে হবে। মাটি কামড়ে সেই লড়াই লড়তে হবে। প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষ বিপন্নতার মধ্যে রয়েছেন। সেই বিপন্নতা দূর করতে হবে। তবে তা এক দিনে হবে না। আন্দোলনের মশাল জ্বালিয়ে রাখতে হবে। এক দিন হবেই!