বরিশাল জেলার লাকুটিয়া জমিদার বাড়ি আনুমানিক ১৬০০ কিংবা ১৭০০ সালে জমিদার রাজচন্দ্র রায় তৈরি করান। রাজচন্দ্রের পুত্র পিয়ারীলাল রায় একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ব্যারিস্টার ও সমাজসেবী ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র বিখ্যাত বৈমানিক ইন্দ্রলাল রায় এবং বক্সার পরেশলাল রায়।
ইন্দ্রলাল রায় (২ ডিসেম্বর ১৮৯৮ – ১৮ জুলাই ১৯১৮) প্রথম ভারতীয় বাঙালি বিমান চালক এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একমাত্র ভারতীয় বৈমানিক। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করেন এবং মারা যান। তিনি ফ্রান্সের পক্ষ হয়ে জার্মানির বিপক্ষে বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযানে অংশ নেন এবং যুদ্ধবিমান চালনায় দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় বিমান চালক, যিনি ১৭০ ঘণ্টা বিমান চালানোর রেকর্ড করেছিলেন। ইংল্যান্ড সরকার তাকে মরণোত্তর Distinguished Flying Cross – ডিএফসি সম্মানে ভূষিত করে। কলকাতার ভবানীপুরে ‘ইন্দ্র রায় রোড’ রাস্তাটির নাম তার নামানুসারে করা হয়।
পরেশলাল রায় বাখরগঞ্জ জেলায় লাখুটিয়া গ্রামে ২০ ডিসেম্বর ১৮৯৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা বিখ্যাত আইনবিদ পিয়ারীলাল রায় এবং মাতা নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনকারী ললিতা রায়। তাঁর এক ভাই ইন্দ্রলাল রায় খ্যাতনামা বৈমানিক। ডাঃ সূর্যকুমার চক্রবর্তী তাঁর পিতামহ। শৈশব থেকেই শিক্ষাদীক্ষা সবই ইংল্যান্ডে। ১০ বছর বয়সে বক্সিংয়ের তালিম নেন কেমব্রিজের বিখ্যাত কোচ বিলি চাইল্ডেসের কাছে। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বি .এ পাশ করেন। ফেদারওয়েটর বিশ্বচ্যাম্পিয়ান জিম ড্রিসকল পরে স্বেছায় তাঁর শিক্ষাভার গ্রহণ করেন। বিলাতে পাঠ্যাবস্থায় তিনি বক্সিং শিক্ষা চালিয়ে যান। ১৯৯২ সালে সেন্ট পলস স্কুলে পড়ার সময় বক্সিংয়ে ফেদারওয়েট বিভাগে পাবলিক স্কুল চ্যাম্পিয়ান হন। বক্সিংয়ে তিনিই এশিয়ার প্রথম কেমব্রিজ ব্লু। পরে রাগবি খেলাতেও ব্লু পান। ১৯১৪ সালে ইংল্যান্ডের ব্যান্টমওয়েট তিনিই চ্যাম্পিয়ান হন। বন্দুক ছোড়া ও অশ্বারোহনে দক্ষ ছিলেন। সম্ভবত তিনিই ভারতের প্রথম অপেশাদারি জকি যিনি রেসের মাঠে ঘোড়া চালিয়েছেন। জওহরলাল নেহেরু তারই ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল কেমব্রিজে পড়ার সময়। কেমব্রিজ ও অক্সফোড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “ইউনিভার্সিটি চ্যাম্পিয়ানশিপ” ও “অক্সফোড ব্লু” লাভ করেন।
এই জমিদার বংশের মূল প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রূপচন্দ্র রায়। জমিদার বংশের লোকেরা অনেক জনহিতকর কাজ করে গেছেন। তঁরা তখনকার সময়ে উল্লেখযোগ্য রাজচন্দ্র কলেজ ও পুষ্পরানী বিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন।

প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো এই জমিদার বাড়ি। বরিশাল শহর থেকে আট কিলোমিটার উত্তরে লাকুটিয়া বাজার। এরপর ইট বিছানো হাঁটাপথ। কিছু দূর যাওয়ার পর মিলবে জমিদারদের অনেক মন্দির আর সমাধিসৌধ। রাস্তার ডান পাশে। এগুলোর বেশির ভাগই আটচালা দেউলরীতিতে তৈরি। শিখররীতির মন্দিরও। পাঁচটা মন্দির এখনো বলতে গেলে অক্ষতই আছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি এখন পরিত্যক্ত ভুতুড়ে বাড়িতে পরিণত হয়েছে। অথচ বাড়িটিকে ঘিরে রয়েছে প্রায় চার শ’ বছরের পুরনো ইতিহাস।
খোসালচন্দ্র রায় লিখিত ‘‘বাকেরগঞ্জের ইতিহাস গ্রন্থ’’ থেকে জানা গেছে, রূপচন্দ্র রায় ছিলেন এই জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর পৌত্র রাজচন্দ্র রায়ের সময়ে এর প্রতিপত্তি বাড়ে। তিনিই মূল জমিদার বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। তাঁর বসানো হাটকেই সবাই বলে বাবুরহাট। তিনি প্রজাদরদী ছিলেন। লাকুটিয়া থেকে বরিশাল অবধি রাস্তা তাঁর আমলেই তৈরি হয়েছিল। বেশ ঘটা করে তিনি রাস উৎসব করতেন। তাঁর দুই পুত্র রাখালচন্দ্র রায় ও প্যারীলাল রায় ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী ছিলেন।
বর্তমানে এখানে তাদের কোনও উত্তরসূরি নেই। এখানে শেষ জমিদার ছিলেন দেবেন রায় চৌধুরী। পরে তিনি ভারতের কলকাতায় সপরিবারে চলে যান এবং সেখানেই মারা যান। তবে তিনি তাঁর মেয়ে মন্দিরা রায় চৌধুরীকে বরিশালের কাশিপুরের মুখার্জী বাড়ি দিয়ে যান। তিনি এখনও এখানে আছেন।
লাকুটিয়া জমিদারদের সব থেকে সুন্দর স্থাপনা হলো মন্দিরগুলো। সবচেয়ে উঁচু মন্দিরের শিলালিপি থেকে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী পংকজকুমার রায়চৌধুরী তাঁর স্বর্গত পিতা সুরেন্দ্রকুমার রায়চৌধুরী এবং মাতা পুষ্পরাণী রায়চৌধুরীর পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশ্যে এটি তৈরি করেছেন। লোহার দরজা পেরিয়ে জমিদার বাড়ির মূল প্রবেশপথের বাঁ পাশেই শান বাঁধানো ঘাটলা বাঁধা সুন্দর একটি পুকুর। বাড়িটি এখন বিএডিসির তত্ত্বাবধানে আছে। বাড়ির তিন ধারে ধানের জমি। বাড়ির কাছেই আমবাগান। বাগানটি গড়ে উঠেছে বিশাল এক দীঘির পাড়ে। একে সবাই রাণীর দিঘি বলে। শীতের সময় এখানে অনেকেই পিকনিক করতে আসেন। এই দীঘিতে প্রতি বছর চারদিক আলোকিত করে ফোটে পদ্মফুল। যেমন বড় তেমন এর রং। পাতাগুলোও ভীষন বড় বড়। বরিশালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পদ্মফুল ফোটে এই দীঘিতেই। এখানে তিনটি মন্দির, দুইটি পুরোনো বাড়ি ও একটি বিশাল দিঘী রয়েছে।
বর্তমানে প্রাসাদের অনেকাংশ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবনগুলি শ্যাওলায় আচ্ছাদিত৷ স্থানীয় জনশ্রুতি অনুসারে এই ভবনগুলি ভূতপ্রেত দ্বারা সংক্রামিত হয়ে আছে৷ এখন এটি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন তত্ত্বাবধায়নে রয়েছে। এখানে বিভিন্ন পর্যটক দেখতে আসেন৷