ক্রিকেট মাঠের পিচে ‘প্রপোজ়’ করেছিলেন, ক্রিকেট মাঠেই তাঁর নামে স্ট্যান্ড! ১৭ বছরে সম্পূর্ণ রোহিত-রীতিকার কাহিনির বৃত্ত

শুক্রবার মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ‘রোহিত শর্মা স্ট্যান্ড’ উদ্বোধনের সময় চোখে জল রীতিকা সজদের। আনন্দাশ্রু। ১৭ বছর আগেও কি এমনই ছিল? যেদিন এমনই এক ক্রিকেট মাঠের পিচের উপর নিয়ে গিয়ে তাঁর সামনে নতজানু হয়েছিলেন প্রেমিক রোহিত?

সেটা ছিল বোরিভেলি ক্রিকেট স্টেডিয়াম। রোহিতের ম্যানেজার ছিলেন রীতিকা। দু’জনের সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়িয়ে যেতে খুব একটা সময় নেয়নি। অতঃপর রীতিকাকে বোরিভেলি স্টেডিয়ামের মাঝখানে পিচের উপর নিয়ে গিয়েছিলেন রোহিত। হাঁটু গেড়ে বসে বলেছিলেন, ‘‘এটাই আমার প্রতিদিনের অফিস। আমার আঁতুড়ঘর। এখানেই আমি বেড়ে উঠেছি। তুমি কি আমার সঙ্গে হাঁটবে?’’

বাকিটা ইতিহাস। যে ইতিহাস লেখা হল গত ১৭ বছর ধরে।

সেটা ২০০৮ সাল। রোহিত তখন ২০ বা ২১। ততদিনে ‘প্রতিভাবান ক্রিকেটার’ হিসাবে চিহ্নিত। ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেকের পর গোটা ১৫-১৬ এক দিনের ম্যাচ আর চার-পাঁচটা টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ঠিকই। কিন্তু তখনও অনিশ্চিত তাঁর ক্রিকেট ভবিষ্যৎ। প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের সম্ভাবনা জাগিয়ে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা তো বিরল নয়। বোরিভেলিতে দাদু-ঠাকুমার কাছে বড় হওয়া তরুণ রোহিত বয়ে যেতে পারতেন ভারতীয় ক্রিকেটের বৈভবের স্রোতে। এ-ও এক ঘটনাচক্রে, যে রীতিকাই তাঁর কাছে নিয়ে আসতেন কোটি কোটি টাকার হাতছানি।

রীতিকা তখন মুম্বইয়ের একটি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট সংস্থার অন্যতম কর্ণধার। সেই সংস্থার সিইও এবং রীতিকার তুতো ভাই বান্টি সজদে চেয়েছিলেন রোহিতকে চুক্তিবদ্ধ করতে। দায়িত্ব দিয়েছিলেন বোন রীতিকাকে। ওই সংস্থার সঙ্গে ততদিনে ক্রিকেটার যুবরাজ সিংহ-সহ কয়েক জন ক্রীড়াবিদ চুক্তিবদ্ধ। যুবরাজের বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত বিষয় দেখতেন বান্টি। আর সংস্থার তরফে যুবরাজের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন রীতিকা। সেই সূত্রে রীতিকা রাখিও পরাতেন যুবরাজকে। ব্যবসায়িক যোগাযোগ ছাপিয়ে তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল পারিবারিক সম্পর্ক। শোনা যায়, ক্রিকেটার রোহিতকে বাগে পেতে যুবরাজের সাহায্য চান রীতিকা। ‘রাখি বোন’কে সাহায্যও করেছিলেন যুবরাজ। তিনি তখন ভারতীয় দলে সিনিয়র। তবে জুনিয়র সতীর্থ রোহিতকে হুঁশিয়ারি দিয়ে যুবরাজ বলেছিলেন, রীতিকা তাঁর বোন। কথাবার্তা যেন পেশাগত বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকে। সতর্ক করে দেন রীতিকাকেও। পরে এক সাক্ষাৎকারে রোহিতই বলে দিয়েছিলেন, ‘‘যুবিভাই আমাকে কড়া সুরে পরিষ্কার বলে দিয়েছিল রীতিকার থেকে দূরে থাকতে। প্রয়োজন ছাড়া কথা-টথা না বলতে।’’

কথা অবশ্য শুরুতে ফোনেই হত। শেষমেশ ২০০৮ সালে একটি বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে প্রথম দেখা। এবং মুখোমুখি কথা। শর্মা দম্পতির ঘনিষ্ঠেরা বলেন, প্রথম দেখাতেই নাকি ভাল লাগা ছিল। তখন দু’জনেই ভুলেছেন যুবরাজের সতর্কবাণী! ক্রমশ ভাল বন্ধু হয়ে ওঠেন রোহিত-রীতিকা। ঘন ঘন দেখা করতেন কাজের ছুতোয়। ভাললাগা থেকেই ভালবাসা।

দু’জনে এক দিন যান বোরিভেলি স্পোর্টস ক্লাবে। যেখানে ক্রিকেটার রোহিতের ‘ব্যাটে খড়ি’। সেখানেই রোহিত প্রপোজ় করেন রীতিকাকে। ২০০৮ থেকেই রোহিত-রীতিকার একসঙ্গে পথ চলা শুরু। ছ’বছর পর, ২০১৫ সালে প্রেম পরিণতি পায় পরিণয়ে। ২০১৮ সালে প্রথম সন্তান সামাইরা। ২০২৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান আহান। যাদের নিয়ে ক্রিকেট মাঠের বাইরের রোহিত পুরোপুরি ‘ফ্যামিলিম্যান’। যিনি কন্যাকে স্কুলে ছেড়ে আসতে যান। যোগ দেন স্কুলের ‘পেরেন্ট-টিচার্স’ বৈঠকেও।

ক্রিকেটের দুনিয়ায় রোহিত ‘হিটম্যান’। ভারতের অধিনায়কত্ব করেছেন তিন ফর্ম্যাটে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছেন। ওয়ান ডে বিশ্বকাপে ফাইনালে তুলেছেন দেশকে। সদ্য টেস্ট ম্যাচের আঙিনা ছেড়েছেন। কিন্তু জানিয়েছেন, খেলবেন একদিনের আন্তর্জাতিক। ইচ্ছা আছে ২০২৭ সালের বিশ্বকাপ পর্যন্ত খেলার। রোহিতের টেস্ট থেকে অবসর নিয়ে আবেগতাড়িত হয়েছেন তাঁর ভক্তেরা। সেই আবহেই শুক্রবার ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে উদ্বোধন হল ‘রোহিত শর্মা স্ট্যান্ড’-এর। ১৭ বছর আগের প্রেমিকা রীতিকা রইলেন রোহিতের পাশে। জীবনসঙ্গিনীর পরিচয়ে।

ক্রিকেটমাঠে শুরু হয়েছিল তাঁদের কাহিনি। ১৭ বছর পরে সেই ক্রিকেট মাঠেই বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। ১৭ বছর আগে এক নবীন ক্রিকেটার নতজানু হয়েছিল প্রেমিকার সামনে। ১৭ বছর পরে যাঁর নামে তাঁর শহরের বৃহত্তম স্টেডিয়ামে স্ট্যান্ডের উদ্বোধন হল, তিনি ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক, সাদা বলের ক্রিকেটে চুড়ান্ত সফল (একমাত্র তাঁরই তিনটি দ্বিশতরান রয়েছে ওই ফর্ম্যাটে) এবং দুই সন্তানের পিতা।

সমাপতন? হবে হয়ত। সুখকর সমাপতন। আনন্দাশ্রুর দোষ কী!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.