প্রথম গর্ত থেকে তখনও ভেসে আসছিল হইচই। দ্বিতীয় গর্তে এ বার হেলমেট মাথায় উঠে দাঁড়ালেন তিনি। চশমা চোখে, দোহারা চেহারা। হেলমেট ছাপিয়ে লম্বা চুল। আরে, ইনি তো মহিলা!
গুজরাতের লাজগঞ্জ এলাকার মরুভূমি। সেখানেই খোঁড়া হয়েছে ১৬ বাই ৬ ফুটের দু’টি লম্বা গর্ত। পুণের ডেকান কলেজ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক ও নৃতত্ত্ববিদদের এই দলটি প্রায়ই এই মরুভূমে আসে। গত কয়েক বছর ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চালিয়ে পাথরের বেশ কিছু ভাঙা টুকরো পেয়েছে তারা। সেগুলো নাকি আদি প্রস্তরযুগের চিহ্ন।
Advertisement
হীরা সিংহ ও অন্য শ্রমিকেরা এখানে আসা এই দলটিকে এত দিনে চিনে গিয়েছেন। দলের নেতৃত্বে দু’জন। এক জন প্রত্ন-ইতিহাসবিদ হাসমুখ ধীরাজলাল সঙ্কলিয়া। অন্য জন এই উদ্ভট মহিলা। নৃতত্ত্বের অধ্যাপক। দুই নেতাই রসিকতার ছলে পরস্পরকে ‘ক্যাপ্টেন’ বলে ডাকেন।
গুজরাতের প্রত্ন-ইতিহাসের পণ্ডিত সঙ্কলিয়াকে তাও বোঝা যায়। কিন্তু এই মহিলা! মাটির নীচে পাথরে এক বার মানুষের খুলি পাওয়া গিয়েছিল। মহিলার তার পর কত যে নির্দেশ! গাঁইতি ও দিকে চালাও, ডান দিক ঘেঁষে, সাবধানে! শহুরে মেয়েদের ব্যাপারই আলাদা।
বেচারি হীরা সিংহ! গর্ত খুঁড়তে শাবল, বেলচা, কোদাল-সহ মজুরদের সে-ই গ্রাম থেকে নিয়ে আসে। পাথরে পুরনো বাসনের টুকরো পেলে সঙ্কলিয়াকে দিতে হয়, হাড়গোড় পেলে এই মহিলাকে। কোনটা মানুষের হাড়, কোনটা কুকুরের, সে সব বাপু হীরা সিংহ জানে না।
ভদ্রমহিলা এমনিতে ভাল। হীরা সিংহদের সঙ্গে তোমরা কী জাত, বাড়িতে কে কে আছে, বিয়ের সময় কত দূর মেয়ে খুঁজতে যাও ইত্যাদি নানা প্রশ্ন ও হরেক গল্প করেন। কিন্তু বেচাল দেখলে সাংঘাতিক। এক বার হীরা সিংহরা ওঁদের বয়কট করেছিল। ভদ্রমহিলারা লাজগঞ্জ স্টেশনে নেমে দেখলেন, চেনা কুলি, মজুরেরা কেউ নেই।
হীরা সিংহকে স্টেশনে ডেকে পাঠানো হল। বেচারি কী আর করে! সত্যি কথা বলতে বাধ্য হল। গত বার ওঁর দলে উনি এমন এক জন মজুরকে নিয়েছিলেন, যে জাতে অস্পৃশ্য। তাই এ বার তারা কাজ করবে না। সঙ্কলিয়া স্যর নিজে গুজরাতি, রামায়ণ-মহাভারত জানেন। জানেন এলাকার রীতি-রেওয়াজ। তিনি মিটমাটের চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভদ্রমহিলা সটান বলে দিলেন, এ সব অস্পৃশ্য-টস্পৃশ্য ভাবলে কাউকেই আর কাজ করতে হবে না। বাপ রে, গান্ধী মহারাজের চেলা নাকি! কিন্তু তা হলে তো খদ্দর পরতেন। বাংলোর বারান্দায় বসে নির্ঘাত চরকা কাটতেন। কিন্তু সারা ক্ষণই তো বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে হাড়গোড় পরিষ্কার করেন, মাপামাপি করে কাগজ-পেনসিলে কী সব অঙ্ক কষেন! হীরা সিংহ মাথা চুলকোয়।
এত দিনে হীরা সিংহ জেনে গিয়েছে, ভদ্রমহিলা ডেকান কলেজে নৃতত্ত্ব বিভাগের প্রধান। বেশ কয়েক জন তাঁর কাছে গবেষণা করে। হীরা সিংহ বোঝে, যারা জ্যান্ত মানুষের জাত আর মরা মানুষের হা়ড়গোড় মাপামাপি করে, তাদের নৃতাত্ত্বিক বলে।
গত কয়েক দিন এই দুই গর্তে প্রবল ব্যস্ততা। খোঁড়াখুঁড়ির জন্য ওঁরা কয়েকটা জায়গা চিহ্নিত করে গর্ত খুঁড়তে বলেছিলেন। প্রথমে পাওয়া গেল কুকুরের হাড়, তার পর আস্ত একটা মাথার খুলি।
খুলির এক পাশ প্রায় বিধ্বস্ত, ভারী কিছু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন। ভদ্রমহিলার উৎসাহ দেখে কে! তাঁর ছাত্ররা বলল, “ম্যাডাম, যুদ্ধে আহত হয়ে মারা গিয়েছিল। এখানে সমাধি দেওয়া হয়েছিল।”
ম্যাডাম তাকালেন, “হতে পারে। কিন্তু আর একটু পাশে এ বার খুঁড়ে দেখতে বলো।”
এটা দু’দিন আগের কথা। তার পরই আজ, ১৯৪৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এই সহর্ষ চিৎকার।
ভদ্রমহিলা চলে এলেন অন্য গর্তে। ছোট্ট এক মানুষের কঙ্কাল। কয়েক শতকের প্রাচীনতায় ধূলিধূসরিত হলেও অটুট।
“এটা বোধ হয় লোকটার বাচ্চা। ওই যুদ্ধে, শত্রুর আক্রমণে বাচ্চাটাও মারা গিয়েছিল, ম্যাডাম।”
ম্যাডাম হাসলেন, “না, এর কোমরের হাড় সরু। মনে হয়, কোনও মেয়ে। লোকটার বৌ হয়তো।”
“প্রস্তরযুগে মেয়েরাও যুদ্ধে যেত, ম্যাম?”
“না। কিন্তু আমরা এখানে কী কী পেলাম? কুকুর, লড়াইয়ে নিহত এক পুরুষ। সম্ভবত লোকটিকে গোর দেওয়ার সময় তার সম্পত্তিও এখানে পুঁতে দিয়েছিল ওর গোষ্ঠীর লোকেরা। পোষা কুকুর আর তার বৌ। দুইয়ের মধ্যে কোনও ফারাক নেই, কী বলো।”
আসল চিন্তাটা মাথায় এল বাংলোয় ফিরে ডায়েরি লিখতে লিখতে। সেই নারী-কঙ্কালের কথা ভেবে লিখলেন, “কে ও? ও কি আসলে আমি?”
ডেকান কলেজের সেই মহিলার নেতৃত্বে এ ভাবেই স্বাধীনতার তিন বছর আগে লাজগঞ্জের বালিয়াড়িতে খুঁজে পাওয়া গেল উপমহাদেশের প্রাচীন প্রস্তরযুগের আদিম নৃতাত্ত্বিক নমুনা। পুরুষের বিধ্বস্ত খুলি, আর এক নারীর আস্ত কঙ্কাল।
খাণ্ডবদহন, আজও
ভদ্রমহিলার নাম ইরাবতী কার্ভে। শাঁওলী মিত্রের ‘নাথবতী অনাথবৎ’ নাটক ও অরুন্ধতী বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত ‘যুগান্ত’ বইয়ের কল্যাণে বাঙালি জানে, তিনি প্রমাণ করেছিলেন, অর্জুন নয়, দ্রৌপদী আসলে ভীমকে ভালবাসতেন। ভীমই তো শত বাধা তুচ্ছ করে তাঁর জন্য পদ্ম আনতে গিয়েছিলেন, ভরা রাজসভায় তাঁর অপমানে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ ও দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপানের শপথ নিয়েছিলেন, জুয়াড়ি বড়দার হাত দুটো অক্ষম রাগে পোড়াতে গিয়েছিলেন। কে ভুলতে পারে ইরাবতীর বর্ণনায় মহাপ্রস্থানের পথে পড়ে যাওয়া দ্রৌপদীর শেষ আর্তি, “সামনের জন্মে সকলের বড় ভাই হয়ো ভীম। তোমার আশ্রয়ে আমরা তখন সুখে থাকব।” ধর্মনিষ্ঠ যুধিষ্ঠির এবং বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন, দুজনকেই নাকচ করে দিয়েছিল তাঁর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি।
ইরাবতী তাঁর নৃতত্ত্বচর্চায় সব সময় প্রাচীন কঙ্কালটির সামাজিক অবস্থান জানতে চেষ্টা করতেন; রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য প্রাচীন সাহিত্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতেন। এ সব আমরা আঁচ করতে পারি, কিন্তু তিনিই যে ভারতের প্রথম মহিলা নৃতাত্ত্বিক, সে কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। নারীবাদের রমরমার এই যুগে তাঁকে বিস্মৃত হওয়াটা অন্যায়।
লাজগঞ্জের ঘটনার প্রায় এক দশক পরে মহারাষ্ট্রে কোয়েনা নদীর জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে এ ভাবেই তাঁর কৃষ্ণ ও অর্জুনের খাণ্ডবদহনের কথা মনে পড়েছিল। তখন স্বাধীন ভারত, প্রধানমন্ত্রীর আসনে জহরলাল নেহরু।
মহারাষ্ট্রের কোয়েনা নদীতে বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। অনেকগুলি গ্রাম সলিলসমাধিতে যাবে। মেয়ে জয়কে সঙ্গে নিয়ে ১৯৬৫ সালের জুলাই থেকে ১৯৬৭-র জানুয়ারি অবধি ইরাবতী সেখানে চালালেন নৃতাত্ত্বিক সমীক্ষা। যারা ঘরবাড়ি, খেতিজমি, মন্দির হারাল, সবাই যে দুঃখিত এমন নয়। প্রায় সবাই সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। দেখা গেল, তরুণ প্রজন্ম বেশ আনন্দিত। এক সঙ্গে এত টাকা তারা আগে কখনও পায়নি। কিন্তু সেই টাকার বেশিটাই জুয়া আর মদে উড়ে গেল। সরকারি কর্তারা যেখানে ভবিতব্য বোঝাতে পারেননি, লোকজন শেষ মুহূর্ত অবধি ভিটেমাটি আঁকড়ে ছিল, জল বাড়তে প্রাণ বাঁচাতে একবস্ত্রে পালিয়ে আসে, উপযুক্ত নথিপত্রের অভাবে তাদের ক্ষতিপূরণ অনেকটাই কম।
যে গ্রামগুলিতে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সরকারি পুর্নবাসন দেওয়া হয়েছিল, সেখানেও গেলেন ইরাবতী। কী আশ্চর্য! এই নতুন গ্রামগুলিও সরকার থেকে তৈরি হয়েছে পুরনো নিয়মেই। ভাল জায়গায় উঁচু জাতের ঘরবাড়ি, অনেকটা ব্যবধান রেখে নিচু জাতের। গবেষণার ফল, ১৯৬৯ সালে বেরোনো ‘আ সার্ভে অব দ্য পিপল ডিসপ্লেসড থ্রু দ্য কোয়েনা ড্যাম’। উন্নয়নের ফলে মানুষ যে কী ভাবে ভিটেমাটি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়, তার প্রথম দলিল এল ভারতের প্রথম মহিলা নৃতত্ত্ববিদের হাত ধরে।
এর কয়েক বছর পর অসমের গারো পাহাড়ে ফিল্ডওয়ার্কে গিয়েছেন তিনি। এক সন্ধ্যায় বাংলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, দূরে জঙ্গলে আগুন। লোকে বলল, এখানে এ ভাবেই জঙ্গল পুড়িয়ে চাষ হয়। পশুপাখিরা? নির্লিপ্ত উত্তর এল, ‘কেউ কেউ মারা যায়, অনেকে বেঁচেও যায়।’
সভ্যতা তা হলে এই রকম? সবাই কৃষ্ণ আর অর্জুনের মতো খাণ্ডববনের অধিবাসীদের আগুনে পুড়িয়ে, জলে ডুবিয়ে তৈরি করবে নিজস্ব ইন্দ্রপ্রস্থ?
শ্রীকৃষ্ণ আর অর্জুন, দুই নায়ককে তাই কখনও ক্ষমা করতে পারেননি এই নৃতত্ত্ববিদ। ‘দ্য বিগিনিং অব দি এন্ড’ নিবন্ধে এই দুই মহাভারতীয় চরিত্রকে তাই তিনি তুলনা করেন এ যুগের অন্যতম যুদ্ধবাজ খলনায়কের সঙ্গে, “খাণ্ডবদহনে এই দুই ধর্মযোদ্ধার ন্যায়নীতির কোনও বালাই ছিল না। তক্ষক নাগ কোনও ক্রমে বেঁচে যায়, কিন্তু হিটলার যে ভাবে একটি জাতিকে পৃথিবীর বুক থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন, কৃষ্ণার্জুনও সে ভাবে ওই অরণ্যের সব অধিবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছিলেন।”
অধ্যাপক যখন প্রেরণা
কোনও অধ্যাপক খ্যাতনামা প্রাবন্ধিক হতেই পারেন, কিন্তু তাঁর সাফল্য আরও একটা বিষয়ে নির্ভর করে। কত জনকে তিনি যথাযথ প্রেরণা দিয়ে নতুন গবেষণার সন্ধান দিতে পারলেন, পরবর্তী প্রজন্মে বিষয়টাকে কত দূর চারিয়ে দিতে পারলেন, তার উপর। শুধু গুনে-গেঁথে পরীক্ষায় পাশ নম্বর তুলিয়ে দেওয়াটাই তাঁর কাজ নয়। তাঁর ছাত্র কে সি মালহোত্রের গল্পটা সেখানেই উজ্জ্বল।
মালহোত্র ডেকান কলেজে ইরাবতীর গোড়ার দিকের ছাত্র, পিএইচ ডি-র গবেষণাও তাঁর কাছে।
মহারাষ্ট্রে নন্দীওয়ালা নামে এক যাযাবর সম্প্রদায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। সঙ্গে একটা ষাঁড়। গ্রামের কেউ হয়তো জিজ্ঞাসা করল, “এ বার ভাল ফসল হবে?” ষাঁড় দু’পাশে মাথা নাড়ল, মানে, না। উপর-নীচে মাথা নাড়ল, মানে, ফসল ভাল হবে। এই যাযাবররা আদৌ মহারাষ্ট্রের লোক? শিবের ষাঁড় নন্দী কী ভাবে হলেন ওঁদের উপাস্য? আধুনিক পৃথিবীতেও কী ভাবে ওঁরা টিকিয়ে রাখেন বংশপরম্পরার এই পেশা?
মালহোত্রকে নিয়ে এ বিষয়ে গবেষণা করতে মাসের পর মাস নন্দীওয়ালাদের সঙ্গ নিলেন ইরাবতী। গবেষণা জানাল, ওঁদের পূর্বপুরুষরা অন্ধ্রের লোক। পরে মহারাষ্ট্রে পরিযায়ী হয়ে আসা, এবং কালক্রমে সেখানেই থিতু। ভারতীয় রাজ্যগুলি কখনই বন্ধ-দুয়ার ছিল না, ভাষা ও আচার ব্যবহারের বিভিন্নতা সত্ত্বেও এখানকার লোক সেখানে এসে ঘাঁটি গেড়ে থিতু হয়েছে।
ইরাবতী চলে এলেন, কিন্তু মালহোত্র বছরের পর বছর সেখানে গেলেন, নন্দীওয়ালাদের সঙ্গে থাকলেন। পরবর্তী কালে নন্দীওয়ালাদের নিয়েই তাঁর গবেষণাগ্রন্থ, আমেরিকার উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নন্দীওয়ালাদের নিয়ে তথ্যচিত্র।
মহারাষ্ট্রের দুই অন্ত্যজ জাতি মাহার ও ধাঙড়দের নিয়েও কাজ করেছিলেন ইরাবতী। মাহার মানে সংবিধানস্রষ্টা বি আর আম্বেডকর যে নিচু জাতে জন্ম নিয়েছিলেন। ইরাবতীরা সেখানে প্রশ্ন করেছিলেন, মহারাষ্ট্র মানে জানেন? উত্তর এল, “হ্যাঁ, মাহারেরা যেখানে থাকে, যত দূরে থাকে, সেটাই মহারাষ্ট্র।” উচ্চবর্গের রাজ ঠাকরে, দেবেন্দ্র ফডণবীসরা আজও মহারাষ্ট্রের এই সংজ্ঞা জানেন না।
সে বারেই গবেষকরা এক মাহারকে প্রশ্ন করেন, আপনার জাত? উত্তর, ‘হরিজন’। টিমের এক গবেষক ছাত্রের বকুনি, ‘বলুন না, মাহার। আমি নিজেও আপনাদের মতো মাহার। সেটাই আমাদের পরিচয়। খামোকা হরিজন-টরিজন বলেন কেন?’
বোঝা যাচ্ছে, নৃতত্ত্বে ছাত্রদের কী ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি! ভাষার ভিত্তিতে ষাটের দশকে গুজরাতিভাষী অঞ্চলগুলি যখন আলাদা হয়ে জন্ম হল পৃথক মহারাষ্ট্র রাজ্যের, ইরাবতী তার অন্যতম সমর্থক। তাঁর গবেষণাই মহারাষ্ট্র পক্ষের নথিতে, সরকারি বয়ানে বারংবার নির্দেশ করা হয়েছে।
আরও একটা বিষয়। তখন নৃতত্ত্বের গবেষণায় কে কোন জাত, কার সঙ্গে মিল, জানতে রক্ত পরীক্ষা হত। লোকে জিজ্ঞাসা করত, “কেন রক্ত নিচ্ছেন? সরকারি লোক বুঝি? আচ্ছা, আমার কি হাঁপানি হতে পারে, বাবু? মা ওই রোগে খুব ভুগতেন।”
নৃতত্ত্ব-গবেষকরা কত ক্ষণ আর এ সব হাবিজাবি প্রশ্নের উত্তর দেবেন? ইরাবতী ছোট্ট একটি ইংরেজি পুস্তিকা ধরিয়ে দিতেন, কেন রক্ত, কী কাজে লাগবে সব সেখানে লেখা আছে। মাহার গ্রামে এক জন এক দিন খুব মুখ ঝামটা দিল, “এ সব কী? আমাদের ভাষায় কিছু থাকলে দিন, তা হলে তো বুঝব।”
অতঃপর ‘কিনশিপ অর্গানাইজ়েশন’ এবং ‘হিন্দু সোসাইটি’র মতো নৃতাত্ত্বিক গবেষণা ছাড়া তাঁর যাবতীয় নিবন্ধ মরাঠি ভাষাতেই লিখেছেন ইরাবতী। ‘যুগান্ত’ থেকে ‘ভূভারা’, ‘আমচি সংস্কৃতি’, ‘পরিপূর্তি’ সব। দুর্ভাগ্য, ‘যুগান্ত’ ছাড়া বেশির ভাগ বই-ই অন্য কোনও ভারতীয় বা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়নি। আমেরিকায় পড়াতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধে নিজেই ‘যুগান্ত’ অনুবাদ করেছিলেন।
আষাঢ় মাসের একাদশীতে মহারাষ্ট্রের পান্ধারপুরে, বিখ্যাত বিটঠল মন্দিরে টানা কয়েক দিন ট্রাকে বা হেঁটে যেতে হয়। তুকারাম এবং মরাঠি ভক্তি অন্দোলনের অনেক সাধকই বিটঠল বা শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত। ইরাবতী সেই যাত্রায় গেলেন। ব্রাহ্মণরা পরিষ্কার কাপড় পরে আলাদা খেতে বসে, মেয়েরাই রান্নাবান্না করে, যাত্রায় রোজ বিটঠলের প্রতীকী রুপোর পাদুকা পুজো করে মাদল বাজিয়ে গান গাওয়ার চমৎকার বর্ণনা। পড়লে এখনকার সুধীর চক্রবর্তী বা শক্তিনাথ ঝা-র কথা মনে পড়ে। এখানেই ইরাবতী কার্ভে ভারতীয় সাহিত্যের অন্যতম পুরোগামিনী।
সীতা বনাম দ্রৌপদী
টানা কয়েক দশক ধরে দেশি-ভিনদেশি পণ্ডিতদের অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে ষাটের দশকে পুণের ভান্ডারকর ইনস্টিটিউট থেকে বিষ্ণু সীতারাম সুকথনকরের সম্পাদনায় বেরোতে থাকে মহাভারতের মান্য সংস্করণ। সেটি পাঠ করেই ইরাবতী লেখেন তাঁর বিখ্যাত ‘যুগান্ত’। শুধু ভীমকে দ্রৌপদীর তন্নিষ্ঠ প্রেমিক ভেবেই থেমে যান না ইরাবতী, বড় রাজনৈতিক বা সামাজিক আন্দোলনের নেতারা যেমন নিজের মহত্ত্ব বোঝাতে ত্যাগের পর ত্যাগ করে যান এবং শেষে ক্লান্ত শরশয্যা নেন, ভীষ্মও কি সে রকম? নিজের মহত্ত্ব পালনের নেশায় কাশীরাজকন্যা অম্বাকে গ্রহণ করলেন না। ভাইদের স্ত্রী বিধবা হল। কুরুবংশে সুদর্শন তরুণের অভাব নেই। কিন্তু ভীষ্ম সত্যবতীর আহ্বান সত্ত্বেও প্রথা মেনে গেলেন না ভাদ্রবৌদের বিছানায়। ডেকে আনলেন বনবাসী, গেঁয়ো ব্যাসদেবকে। কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম কেন রাজসভায় দ্রৌপদীর অপমানে নীরব থাকলেন? কেনই বা ভাইপোদের মধ্যে যুদ্ধ থামানোর এতটুকু চেষ্টা না করে কৌরবদের সেনাপতি হলেন? এই কারণেই কি চেদিরাজ শিশুপাল তাঁকে গালি দিয়ে বলেছিলেন ‘প্রাজ্ঞমানীন’? মানে, যে প্রাজ্ঞ নয়, কিন্তু আত্মম্ভরিতায় নিজেকে প্রাজ্ঞ ভাবে! ইরাবতী জানতেন না, একুশ শতকে ভারতের রাজনীতি এই সব প্রাজ্ঞমানীনে ভরে যাবে!
আর কুন্তী? বনবাসে মাদ্রী পাণ্ডুর সঙ্গে সহমরণে গেলেন, তার পর নিজের ও সৎ ছেলেদের সমান চোখে দেখার পরীক্ষা। তাদের সঙ্গে জতুগৃহ গমন, নিষাদী ও তার পাঁচ পুত্রকে পুড়িয়ে মেরে ছেলেদের সঙ্গে অরণ্যবাস, ভবিষ্যতে ছেলেদের মধ্যে যাতে বিবাদ না ঘটতে পারে, তাই দ্রৌপদীকে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সমান ভাগ করে দেওয়া। উদ্যোগপর্বে ধর্মপ্রাণ বড় ছেলেকে যুদ্ধের জন্য তাতানো। বুকের ভিতরে অজস্র দুঃখ পুষে রেখেছেন, কর্ণের জীবদ্দশায় তাঁকে পুত্রের স্বীকৃতি দিতে পারেননি। শেষে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুনদের যাবতীয় অনুরোধ অগ্রাহ্য করে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, বিদুরদের সঙ্গে বনগমন। সারা জীবন ক্ষত্রিয়ত্বের পরীক্ষা দিয়ে গেলেন এই নারী। এমনকি মৃত্যুর সময়েও! দাবানলে পালালেন না, মাটিতে বসে শ্বাসরোধ করে প্রাণায়াম করতে করতে জীবন্ত ভস্মীভূত হলেন!
চোখে পটি বাঁধা গান্ধারীই বা কম কিসে? বানপ্রস্থের পথে গভীর অরণ্যে যেতে যেতে ধৃতরাষ্ট্র দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। গান্ধারী বললেন, “এখন আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে কী হবে? আমাদের, দুই অন্ধের তো এ ভাবেই দিন কাটার কথা ছিল, মহারাজ।” ধৃতরাষ্ট্র বললেন, “জানি গান্ধারী, তোমার সঙ্গে অন্যায় করা হয়েছিল। আমার অন্ধত্বের কথা না জানিয়ে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি অপরাধী।” গান্ধারী বললেন, “না, মহারাজ। আমি হস্তিনাপুরে এসেই পিতৃগৃহকে মন থেকে মুছে ফেলেছিলাম। আপনি তো দেখেছেন, প্রাসাদে থেকেও আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে কখনও কথা বলিনি।” ধৃতরাষ্ট্র আস্তে আস্তে উত্তর দিলেন, “আমি কুরুকুলের রাজা ছিলাম। ইচ্ছা করলেই তোমার চোখের পটি ছিঁড়ে দিতে পারতাম। কিন্তু ভেবেছিলাম, অধিকার ফলানোর থেকে ধীরে ধীরে করা ভাল। সন্তানের জন্মের পর আমি তোমাকে চোখ খোলার নির্দেশ দিতেই পারতাম। কিন্তু দিইনি। তত দিনে আমার মনও কঠিন হয়ে উঠছিল। চোখ বেঁধে সতীর ঠাটে তুমি ঘুরে বেড়াতে। আর আমি? ছেলেদের মুখ তুমিও দেখতে পাবে না এই ভেবে প্রতিশোধের আনন্দ পেতাম। আমরা কুরুকুলের পুরুষরা যতই দুর্বল হই না কেন, ক্ষত্রিয়ত্ব কখনও ভুলি না।”
বোঝা যাচ্ছে, নৃতত্ত্ব থেকে মনস্তত্ত্ব, সব মিলিয়ে কী অসাধারণ মহাভারতীয় বৈদগ্ধের প্রবেশ ঘটেছিল এই বইয়ের দশটি প্রবন্ধে! পরবর্তী কালে এই বাংলায় বুদ্ধদেব বসু থেকে গজেন্দ্রকুমার মিত্র অনেকেই মহাভারতের হরেক ব্যাখ্যান দেবেন, কন্নড় ভাষায় এস এল ভৈরাপ্পা ‘পর্ব’ উপন্যাস লিখে আমাদের স্তম্ভিত করে দেবেন, বিদেশি ওয়েন্ডি ডোনিগের থেকে আলেফ হেইলেবেটেল সকলেই জানাবেন তাঁদের নিজস্ব ভাষ্য, কিন্তু এই অগ্রগামিনীকে কেউ আজও টপকে যেতে পারেননি।
কী ভাবেই না মহাকাব্যের তন্নিষ্ঠ অনুধ্যান করেছিলেন তিনি! এক জায়গায় লিখছেন, সে কালে যমজ সন্তানের জন্ম দেওয়া ব্যভিচারের লক্ষণ বলে ধরা হত। সেখান থেকেই কি প্রজাদের গুঞ্জন এবং নরচন্দ্রমার সেটি মেনে নেওয়া? গুজব আটকালেন না, অথচ বার বার স্ত্রীর পবিত্রতার অগ্নিপরীক্ষা নিলেন। এই আদর্শ সতীসাধ্বীর পাশে দ্রৌপদী স্বামীদের সঙ্গে বনবাস, ভরা সভায় বস্ত্রহরণ, শেষে ছেলেদের মৃত্যু, অনেক কিছু মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু নিজস্বতা থেকে বিচ্যুত হননি। ‘জয় শ্রীরাম’ রাজনীতির এই যুগে বাঙালি গর্ববোধ করতে পারে, ইরাবতীর পরে, সে দিন একই কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন বাংলার আর এক বিদুষী সুকুমারী ভট্টাচার্য। এখানেই তাঁর ঐতিহ্যের ধারাবহিকতা।
এই ধারাবাহিকতায় নারীবাদী গরমাগরম বিবৃতি নেই, আছে আন্তরিক বুঝদারির প্রয়াস। এক বার ইরাবতী ফিল্ডওয়ার্কে গিয়েছেন, এক চৌকিদারকে দেখে বললেন, “লোকটি ভাল।” ছাত্ররা বলল, “জানেন না ম্যাডাম, লোকটা রোজ বৌকে পেটায়।” ইরাবতী বৌ পেটানোর ঘোর বিরোধী, বললেন, “চলো, আগামী দু’দিন আমরা নৃতত্ত্বের সমীক্ষাটা অন্য ভাবে করি। কারা কারা বৌকে পেটায়।”
দেখা গেল, গ্রামের সব পুরুষই কোনও না কোনও দিন বৌয়ের গায়ে হাত তুলেছে। ইরাবতী জানালেন, সমস্যা এখানেই। কেউ যদি বৌয়ের গায়ে হাত না দেয়, বাকিরা মনে করবে, লোকটা যথেষ্ট পুরুষ নয়, ম্যাদামারা। অতএব, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে বোঝানো দরকার। তাঁর ক্লাসে এক ছাত্রী এক দিন নারীস্বাধীনতার কথা বলছিল, শিক্ষিকা জিজ্ঞাসা করলেন, মানে? ছাত্রী উত্তর দিল, “সমান অধিকার, ম্যাম। চাকরিবাকরি, মাইনে, ঘরের কাজ সবেতেই সমতা।” শিক্ষিকা হাসলেন, “শুধু এইটুকুই? সমকক্ষতার দাবিতেই থেমে যাবে? বেশি কিছু চাইবে না?”
নদীর মতো
নদীর নাম ইরাবতী। ব্রহ্মদেশ, অধুনা মায়ানমারের সবচেয়ে বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ নদী। উত্তরে মাইটিকিনা থেকে কাচিন, মান্দালয়, সাগাইং, বাগো হয়ে দক্ষিণে আন্দামান সাগরে গিয়ে মিশেছে। এখানকার লোকে অবশ্য ইরাবতী বলে না, বলে ইয়াবতী। স্থানীয় ভাষায় ইয়া মানে বড়, বতী মানে নদী। চার ছেলের পর এক মেয়ে, বাবা গণেশহরি কর্মকার তাই আদর করে নদীর নামে একমাত্র মেয়ের নাম রেখেছেন।
গণেশবাবু অবশ্য এখানকার নন, মহারাষ্ট্রের চিৎপাবন ব্রাহ্মণ। মাইটিকিনার ডাকসাইটে ‘ব্রিটিশ কটন কোম্পানি’র পদস্থ কর্মী। পদস্থ মানে, সাহেবি সংস্থায় ভারতীয়রা যত দূর উঠতে পারে আর কী! সাহেবরাই ওঁর বন্ধু, নিজস্ব বাংলো এবং হরেক সুবিধা পান। একমাত্র মেয়েকে রাজকন্যা গোছের মনে করেন, ভবিষ্যতে পারলে কোনও রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে দেন আর কী!
কিন্তু ১৯০৫ সালে জন্মানো ইরাবতীর জন্য তো পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে কোনও রাজপুত্রের আসা সম্ভব নয়। মেয়েদেরও শিক্ষাদীক্ষা দরকার। বিলিতি সাহেবরা যেমন তাঁদের মেয়েদের হোম বা ইংল্যান্ডে পড়াশোনা করতে পাঠান, গণেশবাবুও মেয়েকে পাঠিয়ে দিলেন পুণের স্কুলে।
এই হস্টেল জীবনেই ইরাবতীর জীবন অন্য খাতে বইল। বাচ্চা মেয়ে, রুমমেটদের দাপাদাপিতে অতিষ্ঠ হয়ে প্রায়ই পার্কে বসে গল্পের বই পড়ত। এক দিন তেমনই পড়ছে, ঘাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস ফেলল একটা গুঁফো লোক, “এত মন দিয়ে কী পড়ছ, দেখি।” লোকটা ইরাবতীর সহপাঠিনী শকুন্তলার বাবা। তার চেয়েও বড় কথা, সারা পুণে শহর এঁকে চেনে। ফার্গুসন কলেজের অধ্যক্ষ, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংলার আর পি পরাঞ্জপে। র্যাংলার মানে কেমব্রিজ থেকে অঙ্কে প্রথম শ্রেণির স্নাতক। বাঙালি আনন্দমোহন বসুর মতো।
আর পি বাচ্চাকাচ্চা ভালবাসেন, নিজের মেয়ের সহপাঠিনীকে দেখে দুঃখ হল। এত রোগা, সেই সুদূর বর্মা থেকে মা, বাবা ছেড়ে এখানে। এ সব হস্টেলে যত্নআত্তি হয় না। স্কুল এবং গণেশবাবুকে জানিয়ে মেয়েটিকে সটান নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। শকু এবং ইরু এখন থেকে তাঁর কাছেই থাকবে।
অন্য চিৎপাবন ব্রাহ্মণদের মতো আর পি জাতপাত মানেন না। ভগবান-টগবানও নয়— ঘোর নাস্তিক। ইরু আর শকুকে ডাইনিং টেবিলে জেন অস্টেন, ডিকেন্স, শেক্সপিয়র জোরে জোরে পড়তে বলেন। ইতিমধ্যে বম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও হয়েছেন। সেখান থেকেই সমাজতত্ত্বে ইরাবতীর মাস্টার্স ডিগ্রি। মেয়ের এত লেখাপড়া গণেশবাবুর পছন্দ নয়, তিনি অচিরে ইরুর বিয়ে দিতে চান।
দণ্ডকেশব কার্ভে এই পরাঞ্জপের আত্মীয়। মহারাষ্ট্রে বালবিধবাদের শোচনীয় অবস্থা দেখে তিনি ঘটিবাটি বিক্রি করে বিধবাদের জন্য স্কুল করেছেন। বারংবার বলেন, বিয়ে নয়, পড়াশোনা করো। নিজের পায়ে দাঁড়াও। সেই কবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে এক ভদ্রলোক রাজধানী কলকাতায় বিধবাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেছেন, মেয়েদের স্কুল খুলেছেন, আর মহারাষ্ট্র? এখানকার পুণে, নাগপুর, সাতারার অসহায় বালবিধবারা সেই অবস্থাতেই থাকবে? বহু পরে ১৯৫৮ সালে দণ্ডকেশবের শতবর্ষে ভারত সরকার তাঁকে ভারতরত্ন খেতাবেও সম্মানিত করবে। মরাঠিরা আজও তাঁকে মহর্ষি কার্ভে বলেন!
বার্মায় গণেশহরির রাজপুত্তুরের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। তাঁর পুণেবাসী কন্যা এই চালচুলোহীন দণ্ডকেশবের মেজ ছেলে দিনকর কার্ভের গলায় বরমাল্য দিলেন। দিনকর জার্মানিতে রসায়নশাস্ত্র নিয়ে পড়েছেন, ইরাবতীর পড়াশোনা নিয়ে তিনি বা তাঁর বিখ্যাত বাবা, কারও আপত্তি নেই।
গোল বাধল অন্যত্র। যখন ইরাবতী নিজে নৃতাত্ত্বিক গবেষণার জন্য জার্মানিতে স্কলারশিপ পেলেন! নারীশিক্ষার পুরোধা দণ্ডকেশব পুত্রবধূকে একা বিদেশ যেতে দিতে নারাজ, স্বামী দিনকর কার্ভে বরং উৎসাহ দিয়ে স্ত্রীকে বার্লিনগামী জাহাজে তুলে দিলেন। উনিশ শতকের সব মহামহোপাধ্যায়দের জীবনেই এই স্ববিরোধিতা। বাংলায় নারীশিক্ষার পুরোধা বিদ্যাসাগর গ্রামে গ্রামে মেয়ে-স্কুল খুলেও স্ত্রীকে লেখাপড়া শেখাননি, মহারাষ্ট্রে দণ্ডকেশব কার্ভে উচ্চশিক্ষার জন্য পুত্রবধূকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেননি। তবে ইরাবতী যখন জার্মানি যাচ্ছেন, প্রথম মহাযুদ্ধের পর সেই বিশের দশকে, আলোকপ্রাপ্ত ভারতে একটা জিনিস পুরোদমে শুরু হয়ে গিয়েছে। রোম্যান্টিক, সহমর্মী দাম্পত্যপ্রেম।
এর পর ১৯৭০ সালে মাত্র ৬৪ বছর বয়সে ইরাবতী তিন ছেলেমেয়েকে রেখে হৃদ্রোগে মারা যাবেন, বিপত্নীক দিনকর কার্ভে এক দশক পর বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং নব্য হিন্দুত্বের উত্থান এই দম্পতিকে দেখতে হয়নি।
দেশের প্রথম মহিলা নৃতাত্ত্বিকের জীবন এ রকমই। বিভিন্ন জনজাতিকে নিয়ে কাজ করা এবং মানবিক দৃষ্টিতে রামায়ণ-মহাভারতের আলোচনা। সেখানেই যুগান্ত!
ঋণ: ইরু: উর্মিলা দেশপাণ্ডে ও থিয়াগো পিন্টো বারবারোসা; দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব হিন্দুইজ়ম: সম্পাদনায় ইলিনর জেলিয়ট ও ম্যাক্সিন বার্নস্টাইন
গৌতম চক্রবর্তী