রবিবার সকালে ভারতের জয় দেখার যে হাজার চল্লিশেক দর্শক ইডেন গার্ডেন্সের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন, তাঁরা কি ভাবতে পেরেছিলেন দুপুরের মধ্যেই মুখের হাসি মিলিয়ে যাবে? বিষণ্ণ মুখে বাড়ি ফেরার পথ ধরতে হবে? নিশ্চিত ভাবেই ভাবেননি। গৌতম গম্ভীরের জমানায় সেটাই দেখতে হল। যে ইডেন বহু ঐতিহাসিক ম্যাচ দেখেছে, সেখানেই আড়াই দিনে শেষ হয়ে গেল একটি টেস্ট। এই ফরম্যাট তো বটেই, ক্রিকেটের জন্যও যা ভাল বিজ্ঞাপন নয়। আরও এক বার নিজেদের অস্ত্রে নিজেরাই ‘কাটা পড়ল’ ভারত। গত বছর নিউ জ়িল্যান্ডের কাছে হেরেও শিক্ষা নেয়নি তারা। রবিবারের ম্যাচ তার জ্বলন্ত উদাহরণ।
রবিবারের ইডেন মনে রাখবে পাঁচ ফুট দু’ইঞ্চির টেম্বা বাভুমাকে। ম্যাচ চলাকালীন তাঁকে ‘বামন’ বলে কটাক্ষ করা হয়েছিল। প্রোটিয়া অধিনায়ক জবাব দেওয়ার জন্য বেছে নিলেন নিজের ব্যাটকেই। দেখিয়ে দিলেন, উচ্চতা কম হতে পারে, প্রতিভা, জেদ অনেক বড়। সেই জেদের সামনেই নেতিয়ে গেল ভারতের তেজ। স্বাভাবিক ভাবেই ম্যাচের পর ইডেনের পিচ নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। গম্ভীর যাবতীয় দোষ নিজেদের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, সুজন মুখোপাধ্যায়েরা। সমালোচকদের মুখ অবশ্য বন্ধ করা যায়নি। গম্ভীর ঠেকে শিখবেন, এমনটাই আশা করেছেন সৌরভ।
আড়াই দিনেই হার
শনিবার খেলার শেষে চেতেশ্বর পুজারা বলেছিলেন, ইডেন গার্ডেন্সের এই পিচে চতুর্থ ইনিংসে ১২০ রান তাড়া করাও কঠিন হতে পারে। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে দেন ঋষভ পন্থেরা। দক্ষিণ আফ্রিকার দ্বিতীয় ইনিংস ১৫৩ রানে শেষ হওয়ায় ভারতের লক্ষ্য দাঁড়ায় ১২৪ রান। সেই রান তুলতেই কেঁপে যায় শুভমন গিলহীন ভারতীয় ব্যাটিং লাইন-আপ। ৯৩ রানে শেষ হয়ে যায় ভারতের দ্বিতীয় ইনিংস। নিজেদের পছন্দের পিচে ৩০ রানে হেরেছে গম্ভীরের দল। ভারতের লক্ষ্য ‘কঠিন’ করে দেন বাভুমা। দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়ককে আউট করতেই পারেননি জসপ্রীত বুমরাহ, মহম্মদ সিরাজ, রবীন্দ্র জাডেজারা। ৫৫ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলেন চোট সারিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ফেরা ব্যাটার। ম্যাচের প্রথম দিনই ইডেনের ২২ ব্যাটারদের বধ্যভূমি হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। সেই পিচেই অপ্রতিরোধ্য দেখায় বাভুমাকে। একমাত্র ব্যাটার হিসাবে ইডেন টেস্টে অর্ধশতরান করেন। ৫০ রান করতেই ইডেনের দর্শকেরা দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানান তাঁকে।
রান তাড়া করতে নেমে ওয়াশিংটন সুন্দর (৩১) ছাড়া ভারতের আর কারও মধ্যে বাভুমাসুলভ লড়াই দেখা যায়নি। প্রথম ওভারেই মার্কো জানসেনের বলে আউট হয়ে যান যশস্বী জয়সওয়াল (০)। তৃতীয় ওভারে জানসেন তুলে নেন লোকেশ রাহুলের (১) উইকেট। ১ রানে ২ উইকেট হারানো দলের ইনিংস মেরামত করার চেষ্টা করেন ওয়াশিংটন এবং ধ্রুব জুরেল। উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়ার পর সাইমন হারমারকে অযথা ছক্কা মারতে গিয়ে উইকেট ছুড়ে দিলেন জুরেল (১৩)। এর পর হারমারের বলে তাঁর হাতেই ক্যাচ দিয়ে দলকে খাদের কিনারায় পৌঁছে দেন পন্থ (২)। লাভ হয়নি জাডেজার (১৮) আগ্রাসী ব্যাটিংয়েও। ২২ গজের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করে যান ওয়াশিংটন। তাঁকে প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে পারেননি কেউ। অক্ষর শেষবেলায় আগ্রাসী ব্যাটিং করে চেষ্টা করেন একটা। কিন্তু হারমারের বলে ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হয়ে যান ২৬ রান করে। বাউন্ডারির দিকে মুখ করে দৌড়ে দুরন্ত ক্যাচ নেন বাভুমা। তাঁর ওই ক্যাচই ১৫ বছর পর ভারতের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট জয় নিশ্চিত করে দেয়।
পিচের পক্ষে গম্ভীর
পিচ নিয়ে তিন দিন ধরে নানা কথা হলেও কোচ গম্ভীর ম্যাচ হেরে কোনও অভিযোগ করেননি, বরং নিজেদের ব্যর্থতা মেনে নেন। গম্ভীর মানতে চাননি ইডেনের ২২ গজ স্পিন সহায়ক ছিল। জোরে বোলারদের বেশি উইকেট পাওয়ার তথ্যকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করেন। রবিবার সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে গম্ভীর বলেন, ‘‘ইডেনের পিচ বিপজ্জনক ছিল না। খেলার উপযোগী ছিল। টেম্বা বাভুমা তো রান করল। ওয়াশিংটন সুন্দরও ভাল ব্যাট করল। অক্ষর পটেলও তো খেলল। খেলা যাবে না, এমন উইকেট তো ছিল না। জানি না কেন বার বার স্পিন সহায়ক পিচ বলা হচ্ছে! জোরে বোলারেরাই বেশি উইকেট পেয়েছে এই টেস্টে। ব্যাটারদের টেকনিক, মানসিক শক্তি এবং ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয় এ রকম পিচে। আমরা পারিনি। এমন পিচে রক্ষণ ভাল হওয়া দরকার।’’ পিচ নিয়ে বিতর্ক উড়িয়ে গম্ভীর আরও বলেন, ‘‘আমরা যেমন পিচ চেয়েছিলাম, ঠিক তেমনই পেয়েছি। কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত সাহায্য করেছেন। ভাল খেলতে না পারলে তো এমনই হবে। ১২৪ রান তাড়া করতে না পারার কোনও কারণ ছিল না।’’
গম্ভীর জানান, তিনি এমন পিচ চান যাতে টস গুরুত্বপূর্ণ না হয়। তিনি বলেন, ‘‘আমরা চাই প্রথম দিন থেকেই পিচ স্পিনারদের সাহায্য করুক। যাতে টস গুরুত্বপূর্ণ না হয়। আমরা জিতলে পিচ নিয়ে হয়তো এত আলোচনা হত না। তবে একটা কথা বলা দরকার। আমাদের ক্রিকেটারেরা যে কোনও পরিস্থিতিতে ভাল করতে পারে।’’ গম্ভীর বার বার বুঝিয়ে দিয়েছেন, হারের জন্য পিচের অজুহাত দিতে চান না। তাঁর দলের ক্রিকেটারেরা খেলতে পারেননি বলেই, এ ভাবে হারতে হয়েছে। সিএবি সভাপতি আগেই বলেছিলেন, ভারতীয় দল যে পিচ চেয়েছে, সেটাই দেওয়া হয়েছিল। চার দিন আগে থেকে পিচে জল দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। সৌরভ আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, তিন দিনে শেষ হয়ে যেতে পারে খেলা। ভারতীয় দলকে পছন্দ মতো ২২ গজ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আয়োজক হিসাবে। সেই পছন্দের ২২ গজেই দাঁড়াতে পারেননি ভারতের ব্যাটারেরা। দক্ষিণ আফ্রিকার স্পিনারদেরও সামলাতে পারলেন না ঋষভ পন্থ, যশস্বী জয়সওয়ালেরা। ভারতীয়েরা স্পিন বল খেলায় দক্ষ, ক্রিকেট বিশ্ব এমনই জেনে এসেছে এত দিন ধরে। সেই ধারণাও এ বার ভাঙতে বসেছে। এ নিয়ে গম্ভীরের বক্তব্য, ‘‘দুই জমানার তুলনা করা ঠিক নয়। আমাদের দলে কত জন তরুণ ক্রিকেটার রয়েছে দেখুন। ওদের অভিজ্ঞতা কম।’’
ক্ষুব্ধ প্রাক্তনেরা
গম্ভীর যতই সাফাই গান, তাঁর মন্তব্যের সমালোচনা করেছেন প্রাক্তনেরা। অবাক অনিল কুম্বলে। ইডেনে দীর্ঘ দিন খেলার সুবাদে কুম্বলে জানান, জীবনে এমন পিচ দেখেননি তিনি। গম্ভীরের মন্তব্যের সমালোচনা করেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন পেসার ডেল স্টেনও। আরও এক ধাপ এগিয়ে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলে দেন, এ বার হয়তো গম্ভীর বাকিদের কথা শুনে পিচ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা ছেড়ে দেবেন। চেতেশ্বর পুজারার পরামর্শ, তিন দিনে ম্যাচ শেষ হয়ে যাওয়ার মতো পিচ না বানিয়ে আরও ভাল পিচে খেলা উচিত ভারতের। কুম্বলে বলেছেন, “ইডেনের ঐতিহ্যের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, এখানে অনেক ভাল ভাল ম্যাচ হয়েছে। আমি অনূর্ধ্ব-১৯ পর্যায় থেকে এখানে খেলতে আসছি। তিন দিন ধরে পিচ এ রকম আচরণ করছে, এমনটা কোনও দিন দেখিনি। গৌতম কী বলেছে সেটা শুনেছি। সত্যি বলতে, ওর কথায় আমি দ্বিধাগ্রস্ত। বুঝতে পারছি না ও কী বলতে চাইছে।” গম্ভীরের মন্তব্যে সমালোচনা করে স্টেন বলেন, “ও বলতে পারল যে পিচে কোনও জুজু ছিল না? আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি, ছিল। অনিল (কুম্বলে) একটু আগেই বলছিল, স্পিনারের কোনও বল ব্যাটারের দু’ফুট পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কোনও বল কিপারের কাঁধে লাগছে। পরেরটা পিছলে যাচ্ছে, প্যাডে লাগছে এবং আপনি আউট। এই পিচে ব্যাট করা খুব শক্ত।” স্টেনের কথায়, “চতুর্থ ইনিংসে ওয়াশিংটন এবং বাভুমা খুব ভাল ব্যাট করেছে। তবু ওদের দেখে মনে হয়েছে যে কোনও সময়ে আউট হতে পারে। দু’জনেরই রক্ষণ ভাল বলে ক্রিজ় কামড়ে পড়েছিল। নিশ্চিত ভাবেই এই উইকেটে জুজু ছিল। তিন দিনে কোনও টেস্ট শেষ হয়ে গেলে পিচে জুজু থাকবেই।”
ম্যাচের পর ‘এনডিটিভি’-তে সৌরভ বলেন, “ভাল পিচে খেলা উচিত। আশা করি গম্ভীর এ বার বাকিদের কথা শুনতে পাবে। ম্যাচের আগে পিচ নিয়ে ভাবাই উচিত নয় আর। কারণ ব্যাটারেরা যদি ৩৫০-৪০০ রান তুলতে না পারে, তা হলে কোনও দিন টেস্ট জিততে পারবে না। মনে রাখতে হবে, এই কারণেই ওরা ইংল্যান্ডে জিতেছিল। কারণ ওর দলের ব্যাটারেরা স্কোরবোর্ডে যথেষ্ট রান তুলতে পেরেছিল। অবশ্যই ভারতের উচিত ভাল পিচে খেলা। গম্ভীরের উচিত নিজের দলের উপর ভরসা রাখা এবং তিন দিনে নয়, পাঁচ দিনে টেস্ট জেতা।” দরকার হলে গম্ভীরকে তিনিও যে পরামর্শ দিতে পারেন, সেটাও জানিয়ে রেখেছেন সৌরভ। বলেছেন, “ওর জন্য আমার অনেক সময় রয়েছে। ওকে সমীহ করি। ওর মধ্যে লড়াকু মানসিকতা রয়েছে। ভারতের কোচ হিসাবে ওর পারফরম্যান্সও ভাল। তবে ওকে ভাল পিচে খেলতে হবে। কারণ ওর দলে বুমরাহ, সিরাজ, শামির মতো বোলার রয়েছে। কুলদীপ, জাডেজার মতো স্পিনার রয়েছে।” পুজারা জানান, ভারতের এমন পিচে খেলার দরকারই যেখানে তিন দিনে ম্যাচ শেষ হয়ে যায়। ভারতের প্রাক্তন ব্যাটারের কথায়, “র্যাঙ্ক টার্নার পিচে খেলতে নামলে ভাগ্যের দরকার। ভারতের উচিত আরও ভাল পিচে খেলা। আমি বলছি না যে ঘূর্ণি পিচে খেলো না। তোমরা বরাবরই সেটা করে এসেছ। তবে এমন পিচে খেলো যেখানে অন্তত শতরান করতে পারো। এমন পিচে খেলো যেখানে তোমাদের জেতার সুযোগ থাকবে। যদি দক্ষ হও, সেই দক্ষতাটা দেখাও।”
‘বামন’ বাভুমায় বাজিমাত প্রোটিয়াদের
বাভুমা প্রথম ইনিংসে রান পাননি। লেগ স্লিপে ক্যাচ দিয়ে ফিরেছিলেন। তিনি জানতেন, দ্বিতীয় ইনিংসে পিচ আরও খারাপ হবে। স্পিনারদের সামলানো আরও কঠিন হয়ে পড়বে। তাই নিজের স্টান্সে খানিক বদল করেছিলেন। বাঁ পা কিছুটা লেগ সাইডে (চেস্ট অন স্টান্স) রেখে ব্যাট করা শুরু করেন। ফলে লেগ স্লিপে বা সিলি পয়েন্টে ক্যাচ আউট হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়। পাশাপাশি এলবিডব্লিউয়ের সম্ভাবনাও কমিয়ে দেন বাভুমা। ম্যাচ শেষে সেই বিষয়ে মুখ খুলেছেন বাভুমা। তিনি বলেন, “আমি উপমহাদেশের মাটিতে কয়েকটা ইনিংস খেলেছি। জানি, এখানে কী ভাবে ব্যাট করতে হয়। তাই ওই বদলটা করেছিলাম। ফলে দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং সহজ হয়ে গিয়েছে।” বাভুমার প্রধান শক্তি টেকনিক। পায়ের নড়াচড়া করেন। বলের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেন। আবার পিছনের পায়েও সাবলীল তিনি। কঠিন উইকেটে পায়ের ব্যবহার কতটা জরুরি তা দেখালেন বাভুমা। স্পিনারদের সাবলীল ভাবে খেললেন। দেখে মনে হচ্ছিল, বাকি সকলে এক উইকেটে খেলছেন, আর তিনি অন্য উইকেটে। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রেখেছিলেন বাভুমা। ঠান্ডা মাথায় খেলেছেন।
ম্যাচ জিতে তিনি বলেন, “আমি নিজেকে নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। নিজের টেকনিক নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কখনও তাড়াহুড়ো করিনি। জানতাম, উইকেটে পড়ে থাকলে রান আসবে।” বাভুমা যেটা করে দেখালেন, সেটা তো পারলেন না ভারতীয় ব্যাটারেরা। খেলা শেষে কোচ গৌতম গম্ভীরও তা স্বীকার করে নিয়েছেন। তিনি বলেন, “এই উইকেটে তো বাভুমা রান করেছে। তা হলে অত খারাপ উইকেটও ছিল না। এখানে টিকে থাকলে রান আসবে। এই উইকেটে ব্যাটারেরা টেকনিক ও মানসিকতার পরীক্ষা হয়। এখানে শুরু থেকে চালিয়ে খেলতে গেলে হবে না।” গম্ভীরের কথা থেকে স্পষ্ট, বাভুমা যে ভাবে খেলেছেন, সে ভাবেই কঠিন উইকেটে খেলতে হয়। বলকে সম্মান দিতে হয়। বোলারদের সম্মান দিতে হয়। প্রতিটি বলের আগে মনঃসংযোগ করতে হয়। প্রতিটি বলের আগে ভাবতে হয়, সেটাই প্রথম বল। নইলে ১৩৬ বলে ৫৫ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলা যায় না। তার মধ্যে মাত্র চারটি চার মেরেছেন বাভুমা। অর্থাৎ, ৩৯ রান তিনি দৌড়ে নিয়েছেন। গোটা দল আউট হয়ে গেলেও বাভুমার উইকেট তুলতে পারেননি ভারতীয় বোলারেরা। ম্যাচের একমাত্র অর্ধশতরান তাঁর ব্যাট থেকেই এসেছে। শান্ত থেকেছেন। শেষে ম্যাচ জিতে উচ্ছ্বাসে ভেসেছেন।
এ ভাবেই জবাব দিতে ভালবাসেন বাভুমা। অধিনায়ক হিসাবে টেস্টে তাঁর রেকর্ড ঈর্ষণীয়। ১১টি টেস্টের মধ্যে ১০টি জিতেছেন তিনি। একটি টেস্ট বৃষ্টির কারণে ড্র হয়েছে। অর্থাৎ, অধিনায়ক হিসাবে এখনও হারেননি বাভুমা। তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে যেমন বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল রয়েছে, তেমনই রয়েছে ইডেনের এই টেস্ট। ভারতের মাটিতে ১৫ বছর পর আবার টেস্ট জিতেছে দক্ষিণ আফ্রিকা। আর তা সম্ভব হয়েছে বাভুমার ওই ইনিংসের জন্যই। দলকে জিতিয়ে নিজের উচ্চতা তিনি এতটাই বাড়িয়ে ফেলেছেন যে তার বিশাল ছায়ায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে গৌতম গম্ভীর, শুভমন গিলদের তারকাখচিত দল।
পয়েন্ট তালিকায় পতন
ইডেন গার্ডেন্সে দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে হেরে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকায় ধাক্কা খেয়েছে ভারত। আরও নীচে নেমেছেন শুভমন গিলেরা। ভারতের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে পাকিস্তান। ইডেন টেস্টের পর বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকায় ভারত চার নম্বরে নেমেছে। ২০২৫-২০২৭ টেস্ট বিশ্বকাপ পর্বে এখনও পর্যন্ত আটটি টেস্ট খেলেছে ভারত। তার মধ্যে চারটি জিতেছে তারা। হেরেছে তিনটি। একটি টেস্ট ড্র হয়েছে। ভারতের পয়েন্ট ৫২। পয়েন্টের শতাংশ ৫৪.১৭। ভারতের পয়েন্ট বাকি সব দেশের থেকে বেশি। কারণ, ভারত বাকিদের থেকে বেশি টেস্ট খেলেছে। পয়েন্ট বেশি হলেও ভারত চার নম্বরে রয়েছে। কারণ, পয়েন্ট নয়, পয়েন্টের শতাংশের উপর নির্ভর করে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের পয়েন্ট তালিকা তৈরি হয়। এই তালিকায় সকলের উপর রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। তিনটি টেস্ট খেলে তিনটিই জিতেছে তারা। প্যাট কামিন্সদের পয়েন্ট ৩৬। পয়েন্টের শতাংশ ১০০। এ বার সামনে রয়েছে অ্যাশেজ় সিরিজ়। সেই সিরিজ়ের উপর নির্ভর করছে, অস্ট্রেলিয়ার শীর্ষে জায়গা পাকা রাখতে পারবে কি না। ইডেনে ভারতকে হারিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে টেস্ট বিশ্বকাপের গত বারের চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকা। তিনটি টেস্ট খেলে দু’টি জিতেছে তারা। হেরেছে একটি। টেম্বা বাভুমাদের পয়েন্ট ২৪। পয়েন্টের শতাংশ ৬৬.৬৭। তৃতীয় স্থানে শ্রীলঙ্কা। দু’টি টেস্ট খেলে একটি জিতেছে তারা। অপর টেস্ট ড্র হয়েছে। শ্রীলঙ্কার পয়েন্ট ১৬। তবে তাদেরও পয়েন্টের শতাংশ ৬৬.৬৭।
শুভমনের চোট
শনিবার ইডেন টেস্টের দ্বিতীয় দিনে ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়ায় মাত্র তিন বল ব্যাট করেছিলেন শুভমন গিল। সন্ধ্যায় তাঁকে ভর্তি করানো হয় হাসপাতালে। এখনও তাঁর ঘাড় শক্ত হয়ে আছে বলে জানা গিয়েছে। গুয়াহাটি টেস্টে শুভমন খেলতে পারবেন কি না, তা নিয়ে রবিবারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ভারতের কোচ গৌতম গম্ভীর। রবিবার ম্যাচের শেষে গম্ভীর বলেন, “এখনও গিলের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। দেখা যায় কী হয়। আজ রাতের মধ্যে ওকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ফিজিয়োরা। তার পর দল হিসাবে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।” ফলে গুয়াহাটি টেস্টে শুভমনের খেলা নিয়ে ধোঁয়াশা চলছেই।
ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসে পন্থ বলেন, “এ রকম একটা ম্যাচের পর খুব একটা কিছু বলার থাকে না। আমাদের এই রান তাড়া করা উচিত ছিল। চাপ ক্রমশ বেড়েই গিয়েছে। আমরা সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। পিচ থেকে বোলারেরা সাহায্য পেয়েছে।” ইডেন টেস্টে হারলেও গুয়াহাটিতে যে তাঁরা শক্তিশালী হয়ে ফিরবেন সেই আশ্বাসও শুনিয়ে গিয়েছেন পন্থ। বলেছেন, “এই পিচে ১২০ রান তোলা একটু কঠিন ছিল ঠিকই। তা সত্ত্বেও বলছি, আমাদের এই চাপ সামলে নিয়ে সুযোগ কাজে লাগানো দরকার ছিল। কোথায় কোথায় উন্নতি করতে হবে সেটা নিয়ে এখনও ভাবার সুযোগ পাইনি। তবে নিশ্চিত ভাবেই শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসব।”
শাস্তি দিলেন গম্ভীর
ইডেন গার্ডেন্সে টেস্ট হার মেনে নিতে পারছেন না গম্ভীর। সেই কারণেই হয়তো ক্রিকেটারদের শাস্তি দিলেন তিনি। পাঁচ দিনের টেস্ট শেষ হয়ে গিয়েছে তৃতীয় দিনে। খেলা শেষ হয়ে গেলেও এখনও শহর ছাড়ছে না ভারতীয় দল। মঙ্গলবার পর্যন্ত কলকাতাতেই রয়েছেন ক্রিকেটারেরা। কোনও টেস্ট পাঁচ দিনের আগে শেষ হয়ে গেলে সাধারণত বাকি দিনগুলি বিশ্রাম পান ক্রিকেটারেরা। ইডেন টেস্টে ভারত জিতলে সেটাই পেতেন ঋষভ পন্থ, জসপ্রীত বুমরাহেরা। কিন্তু ভারত জিততে পারেনি। ফলে শাস্তি পেতে হয়েছে। ছুটি পাচ্ছেন না ক্রিকেটারেরা। জানা গিয়েছে, সোমবার বিশ্রাম দেওয়া হবে ক্রিকেটারদের। তবে মঙ্গলবার তাঁদের পুরোদমে অনুশীলন করতে হবে। সেটা হবে ইডেনেই। অনুশীলন শেষে গুয়াহাটি রওনা হবেন ক্রিকেটারেরা। আগে যে সূচি অনুযায়ী গম্ভীরদের যাওয়ার কথা ছিল, সেই সূচি অনুযায়ীই শহর ছাড়বেন তাঁরা।

