আমেরিকা থেকে পাকিস্তান, শুল্ক থেকে সন্ত্রাস: আত্মরক্ষা ও আক্রমণে দেশের ভবিষ্যৎ ‘অস্ত্র’ মোদীর লালকেল্লার বক্তৃতায়

ভারত-পাকিস্তান সামরিক উত্তেজনা। অন্য দিকে, বাণিজ্য নিয়ে ভারত-আমেরিকা কূটনৈতিক টানাপড়েন। এই দুইয়ের আবহে শুক্রবার লালকেল্লা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে দেশের ‘রক্ষাকবচ’-এর উপরেই জোর দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সামরিক এবং অর্থনৈতিক— উভয় দিক থেকেই দেশকে সুরক্ষাবলয়ে ঘেরার বার্তা দিলেন তিনি।

পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ড এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’ পরবর্তী সময়ে এ বারের স্বাধীনতা দিবসের বার্তায় স্বাভাবিক ভাবেই উঠে আসে দেশের সামরিক প্রস্তুতির কথা। প্রধানমন্ত্রী মোদী ঘোষণা করেন, ভারতও নিজস্ব আকাশসুরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যেই সেই কবচ তৈরি করে ফেলার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। শত্রুপক্ষের হামলা থেকে দেশের আকাশকে নিরাপদ রাখতেই এটি তৈরি হচ্ছে। এই আকাশসুরক্ষা প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘মিশন সুদর্শন চক্র’। কেমন হবে এই আকাশসুরক্ষা ব্যবস্থা, তা নিয়ে কোনও বিস্তারিত মন্তব্য করেননি মোদী। তবে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ইজ়রায়েলের আকাশসুরক্ষা ব্যবস্থা ‘আয়রন ডোম’-এর মতো কাজ করতে পারে এটি।

পশ্চিম এশিয়ার সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ইজ়রায়েলের ‘আয়রন ডোম’ বার বার পরীক্ষিত হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও আমেরিকার আকাশসুরক্ষার জন্য অনুরূপ ‘গোল্ডেন ডোম’ তৈরি করছেন। সম্প্রতি আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে পাক সেনাপ্রধান আসিম মুনির সিন্ধুচুক্তি স্থগিত রাখা নিয়ে হুমকি দিয়েছেন ভারতকে। ভারত বাঁধ তৈরি করলে, ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে সেই বাঁধ ধ্বংস করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মুনির। এই আবহে ভারতের আকাশসুরক্ষা কবচ তৈরির ঘোষণা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মোদীর কথায়, “২০৩৫ সালের মধ্যে এই সুরক্ষাবলয়কে সম্প্রসারিত করে আরও শক্তিশালী এবং আধুনিক করে ফেলতে চাই।”

দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য বিদেশি নির্ভরশীলতা কমানোর বার্তাও দেন মোদী। দেশীয় প্রযুক্তিতে যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন তৈরির লক্ষ্যে ভারতকে এগোতে হবে বলে মনে করছেন তিনি। মিশন সুদর্শন চক্রের বিষয়েও সেই একই ভাবনা মোদীর। প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ভগবান কৃষ্ণের অনুপ্রেরণায় আমরা সুদর্শন চক্রের পথ বেছে নিয়েছি। গোটা ব্যবস্থাটি ভারতেই গবেষণা করে তৈরি হওয়া উচিত।”

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল ভারতের সামরিক বাহিনীর সাফল্যের কথা। উঠে আসে পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের কথাও। সীমান্তের ও পার থেকে জঙ্গিরা পহেলগাঁওয়ে এসে ধর্ম জিজ্ঞাসা করে করে মানুষকে হত্যা করেছে। সে কথাও তুলে ধরেন মোদী। প্রধানমন্ত্রীর কথায়, দেশের জওয়ানেরা শত্রুদের কল্পনাতীত শাস্তি দিয়েছেন। তিনি জানান, গোটা দেশ ক্ষোভে ফুঁসছিল। অপারেশন সিঁদুর হল সেই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। দেশের সামরিক বাহিনী যা করে দেখিয়েছে, তা গত কয়েক দশকে কখনও হয়নি। সিন্ধুচুক্তি নিয়েও নয়াদিল্লির অবস্থান ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন মোদী। তাঁর কথায়, ওই চুক্তি ‘একপেশে’ এবং ‘অন্যায্য’। মোদী বলেন, “ভারতের নদীর জল আমাদের শত্রুদেশের চাষের খেতে যাচ্ছে, অথচ আমাদের দেশ, দেশের কৃষকেরা জল পাচ্ছেন না। এই চুক্তি গত সাত দশক ধরে দেশের কৃষকদের অকল্পনীয় ক্ষতি করেছে। এখন থেকে এই জলের উপর অধিকার থাকবে শুধুমাত্র ভারতের কৃষকদের।”

সম্প্রতি রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কের কারণে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে। আমেরিকা চাইছে না রাশিয়ার থেকে তেল কিনুক ভারত। তা নিয়ে নয়াদিল্লির উপর চাপ বৃদ্ধি করতে চড়া হারে শুল্ক চাপিয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনাও বন্ধ রাখার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ অবস্থায় দেশকে শুধু সামরিক রক্ষাকবচে নয়, অর্থনৈতিক সুরক্ষাবলয়েও ঘেরার বার্তা দিয়েছেন মোদী। দেশের অর্থনীতিকে আরও মজবুত করার বার্তা দিয়েছেন তিনি। ভারতকে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত করার লক্ষ্য শুক্রবার লালকেল্লা থেকে ফের স্পষ্ট করে দেন মোদী। বিশ্ববাজারে ভারতীয় পণ্য যাতে ‘রাজত্ব’ করতে পারে, তার জন্য মূলমন্ত্রও বেঁধে দিয়েছেন তিনি। মোদীর কথায়, ‘কম দাম, উচ্চ মান’— দেশীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এটাই সকলের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

সরাসরি আমেরিকার নাম না-করলেও ট্রাম্পের শুল্ক-হুমকি যে ভারতকে টলাতে পারবে না, তা লালকেল্লা থেকে দীর্ঘ ১০৩ মিনিটের ভাষণে স্পষ্ট করে দিয়েছেন মোদী। স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে তিনি বলেন, “আমাদের কৃষকেরা আমাদের স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। তাই ভারত সরকার কৃষকদের স্বার্থের সঙ্গে কোনও আপস করবে না। দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে মোদী।” বস্তুত, ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যচুক্তির ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে উঠেছে কৃষি এবং দুগ্ধজাত দ্রব্য নিয়ে দুই দেশের একমত হতে না-পারা। আমেরিকা চাইছে কৃষি ও দুগ্ধজাত ক্ষেত্রে ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে। কিন্তু তাতে সায় নেই নয়াদিল্লির। এ অবস্থায় শুক্রবার মোদীর বার্তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। মোদীর এই বক্তৃতার পরে ভারতকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছাবার্তা পাঠিয়েছেন মার্কিন বিদেশসচিব মার্কো রুবিয়ো।

পরমাণু শক্তি ১০ গুণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা

দেশের স্বাধীনতার ১০০ বছর পূর্তির আগে ভারতের পরমাণু শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করতে চাইছে নয়াদিল্লি। সেই লক্ষ্যের কথাও ফের বুঝিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী। মোদী জানান, ২০৪৭ সালের মধ্যে দেশের পরমাণু শক্তিকে ১০ গুণ বৃদ্ধি করার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। নতুন দশটি পরমাণু চুল্লি তৈরির কাজ চলছে। তাঁর মতে, জ্বালানি ক্ষেত্রে দেশকে স্বনির্ভর হতে হবে। পরমাণু শক্তিকে আরও বৃদ্ধি করতে পারলে শক্তি ক্ষেত্র অন্য দেশ থেকে আমদানির উপর আর নির্ভর করতে হবে না ভারতকে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পরমাণু ক্ষেত্রে বড় মাপের সংস্কার করা হচ্ছে বলেও জানান মোদী।

বিদেশি নির্ভরশীলতা কমানোয় জোর

লালকেল্লা থেকে মোদী জানান, সমুদ্রের নীচে তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের খোঁজের জন্য ‘সমুদ্র মন্থন’ অভিযান শুরু করছে ভারত। বর্তমানে রাশিয়া থেকে তেল কেনা নিয়ে ভারত-আমেরিকা কূটনৈতিক টানাপড়েনের আবহে মোদীর এই বার্তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কৃষি ক্ষেত্রে সারের জন্যও বিদেশের উপর নির্ভরশীলতা কমানোয় আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন মোদী। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে আমরা অনেক দেশের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রকৃতার্থে আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তুলতে হলে আমাদের জ্বালানির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা লাভ করতে হবে।’’ দেশীয় ব্যবসায়ীদের স্বদেশী পণ্যের উপর জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। যদি সরকারি নীতিতে কোনও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়, তা-ও কেন্দ্রকে জানানোর প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী। চলতি বছরের শেষের দিকে ভারতের নিজস্ব সেমিকন্ডাক্টর চিপ বাজারে চলে আসবে বলেও জানান মোদী। দেশবাসীর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘অন্য দেশের উপর নির্ভরশীল হওয়া বিপর্যয়ের অন্যতম অংশ। স্বার্থরক্ষার জন্য আমাদের অবশ্যই স্বনির্ভর হতে হবে।’’

অনুপ্রবেশ বরদাস্ত হবে না

অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে বিভিন্ন বিজেপিশাসিত রাজ্য। বাংলাদেশি সন্দেহে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদেরও বাংলাদেশি সন্দেহে হেনস্থার অভিযোগ উঠেছে। এই আবহে শুক্রবার লালকেল্লা থেকে অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে ফের বার্তা দেন মোদী। দেশবাসীকে সতর্ক করে মোদী বলেন, “সুচিন্তিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে এই দেশের জনবিন্যাস বদলে দেওয়া হচ্ছে। নতুন নতুন সমস্যার বীজ বপন করা হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জীবিকা কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের মা-বোনেদের নিশানা করছে। এটা সহ্য করা হবে না।” প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘‘সীমান্ত এলাকায় জনবিন্যাসে পরিবর্তন জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। এর মাধ্যমে সংঘর্ষের বীজ বপন হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীদের সামনে কোনও দেশ মাথা নত করতে পারে না। আমরা কী ভাবে করব? পূর্বপুরুষেরা আমাদের স্বাধীনতা উপহার দিয়ে গিয়েছেন। অনুপ্রবেশকারীদের রুখে তাঁদের প্রতি কর্তব্য আমাদের পালন করতে হবে।’’

দেশবাসীর জন্য ‘উপহার’

জিএসটি ব্যবস্থা সরলীকরণ করার জন্য ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে কেন্দ্র। জিএসটি পরিকাঠামোয় যে বদল আসতে পারে, সেই আভাস মিলেছিল গত জুলাইয়েই। এ বার লালকেল্লা থেকে প্রায় পৌনে দু’ঘণ্টার ভাষণ থেকে মোদী ঘোষণা করলেন, দীপাবলিতে জিএসটি পরিকাঠামোয় বদল আসছে। তিনি বলেন, “এ বারের দীপাবলি আমি আপনাদের জন্য দ্বিগুণ আনন্দের করে দিচ্ছি। এই দীপাবলিতে দেশবাসী একটি বড় উপহার পাবেন। আমরা নতুন প্রজন্মের জিএসটি সংস্কার আনছি। এর ফলে সারা দেশে করের বোঝা কমবে। দীপাবলির আগে এটিই হবে উপহার।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.