একটি লাথির জন্য!

সকাল সকাল কালো এসইউভি-টা এসে দাঁড়ায় সিংদরজার সামনে। তিনি নামেন। সাধারণত স্ত্রী থাকেন সঙ্গে। পতির পরনে মামুলি ট্র্যাক বটম আর সাদা টি-শার্ট। পত্নীর পরিধেয়ও তেমনই।

কোনও হাঁকডাক নেই। হল্লাগুল্লা নেই। দু’জনে পাশাপাশি গেট পেরিয়ে ঢুকে পড়েন ভিতরে। তাঁদের সঙ্গে আগত সান্ত্রীরা ঢোকেন না। তাঁরা দাঁড়িয়ে থাকেন পাঁচিলের বাইরে কালো গাড়িটা সসম্ভ্রমে ঘিরে। সে গাড়ির বনেটে তাঁর পদমর্যাদার অভিজ্ঞানসূচক পতাকা তখন ওড়ে না। পিতলের ফাঁকা ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড সকালের রোদে ঝকঝক করে। ঢাকা থাকে নম্বরপ্লেটের নীচের তারকাচিহ্ন সম্বলিত বোর্ডটিও।

ফটক পেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে তিনি পকেট থেকে ঘন কালো রোদচশমাটি বার করে এঁটে নেন চোখে। তার পরে সস্ত্রীক টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে মিশে যান জনারণ্যে। অন্য অনেক প্রাতর্ভ্রমণকারীর ভিড়ে।

পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে একদিন গিয়ে কথা বলেছিলাম। দেখলাম, মনোজ বর্মা চেনা দিতে খুব ইচ্ছুক নন। মনে হল, স্বাভাবিক। বাগদাদের বাদশা যখন ছদ্মবেশে রাতের বেলা তাঁর শহর দেখতে বেরোতেন, তখন তাঁকে কেউ চিনে ফেললে কি তিনি অপ্রতিভ হতেন না? মনোজও তো, পদাধিকার বলে, কলকাতা শহরের বাদশাই বটে!

আরজি কর-কাণ্ড প্রসূত গভীর সঙ্কটের সময়ে বিনীত গোয়েলকে সরিয়ে মনোজকে কলকাতার পুলিশ কমিশনার পদে নিয়ে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিনীতের মতো মনোজ প্রাক্তন আইআইটি নন। ‘অ্যাকাডেমিক’ নন। মনোজ পুরোদস্তুর ‘পুলিশ’। তিনি উত্তাল পাহাড় সামলেছেন। ঠান্ডা করেছেন ব্যারাকপুর। তারও আগে লালগড়ে মাওবাদী আন্দোলন দমন করেছেন। তিনি কাঁধে রকেট লঞ্চার আর কাঁধের ক্রসবেল্টে অ্যাসল্ট কালাশনিকভ নিয়ে চলতে অভ্যস্ত অফিসার। সে অর্থে মিশুকে নন। কিন্তু কাজের মানুষ। মানে পুলিশের যা ‘কাজ’। যাকে পরিভাষায় ‘অ্যাকশন’ বলে। মোদ্দা কথায়, মনোজ উন্মত্ত জনতার সামনে পড়ে টেবিলের তলায় বা কাছাকাছির বাথরুমে লুকিয়ে পড়ার বান্দা নন। বরং তিনি চান নাইন এমএম হাতে খোলা রাস্তায় দ্রুতধাবমান এবং পলায়নপর দুষ্কৃতীর পিছনে ছুটতে।

দায়িত্ব নেওয়া ইস্তক কলকাতা পুলিশের ভাবমূর্তি উদ্ধারের নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এই ডাকাবুকো আইপিএস। বিভিন্ন বড় ঘটনায় নিজে গিয়ে হাজির হয়েছেন। বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়েছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। আরজি করের ঘটনার পরে গুটিয়ে গিয়েছিল কলকাতা পুলিশ। যদি বলি, সমাজে ‘একঘরে’ বা ‘গণশত্রু’ হয়েছিল, মনে হয় না পুলিশের ভাবুক অফিসারেরা খুব দ্বিমত হবেন। মনোজ চেষ্টা করছিলেন সেই হৃতমর্যাদা ফিরিয়ে এনে পুলিশকে যথার্থই ‘রক্ষক’ করে তুলতে। সন্দেহ নেই, সে কাজে অনুঘটক এবং আশ্রয় হয়েছিল আরজি করের ক্রমশ মিইয়ে যাওয়া আন্দোলনও। একটু একটু করে আবার পায়ের তলায় জমি ফিরে পাচ্ছিল মনোজের বাহিনী।

একটি লাথিতে সেই জমি আবার ধসিয়ে দিলেন এক অবিমৃশ্যকারী সাব ইনস্পেক্টর!

Kick-Cop of Kasba & the embarrassment of Kolkata Police

প্রতিটি চাকরিরই কিছু কিছু শর্ত থাকে। কী করণীয়, কী পরিত্যাজ্য। ডু’জ় অ্যান্ড ডোন্টস। পুলিশের চাকরিতেও থাকে। আইন অমান্য করলে, আন্দোলন হিংসাত্মক হলে পুলিশ বলপ্রয়োগ করবে। লাঠি চালাবে। সেটা করণীয়ের মধ্যেই পড়ে। ডু’জ়। পুলিশ যে লাঠিচার্জকে বলবে ‘হালকা’ বা ‘সামান্য’। ধোলাই যাঁরা খেলেন, তাঁরা বলবেন ‘বেধড়ক মার’ (সংবাদমাধ্যমে একদা লেখা হত ‘মৃদু লাঠিচার্জ’। পরিচিত এক অফিসার হালকাচালে বলেছিলেন, ‘‘লাঠিচার্জ কখনও মৃদু-টিদু হয় না। যাতে লাগে, পুলিশ সে ভাবেই লাঠি চালায়। লাঠি বুলোয় না। মারার আগে লাঠি মাটিতে ঠুকে ভয়-টয় দেখায় কখনও-সখনও। তবে সেটা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।’’ তার পর থেকে লাঠিচার্জের আগে ‘মৃদু’ শব্দটি বসানো সচেতন ভাবে বন্ধ করেছি)। পুলিশ অভিযুক্তের কোমরে দড়ি পরাবে, জামার কলার বা ট্রাউজ়ার্সের কোমরের কাছটা কষে ধরে প্রিজ়ন ভ্যানে তুলবে, বেচাল দেখলে দু’-চারটে চড়-থাপ্পড় মারবে বা একটু আবডাল রেখে কনুইয়ের গুঁতো। সেগুলোও করণীয়। ডু’জ়।

কিন্তু লাথি মারবে? প্রকাশ্যে? এক বিক্ষোভকারীকে? যাঁর পেশাগত এবং সামাজিক পরিচয় ‘শিক্ষক’? নাহ্! সেটা কঠোর ভাবে ডোন্টস-এর মধ্যে পড়ে। পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, সেটা পরিত্যাজ্যের তালিকাভুক্ত।

সেই ঘটনা ঘটে-যাওয়া ইস্তক মনোজকে একটু অপ্রতিভই মনে হচ্ছে। তড়িঘড়ি অন্য মনোজের (পন্থ, মুখ্যসচিব) ডাকা সাংবাদিক বৈঠকে হাজির হয়ে বলতে হয়েছে, এমন ঘটনা অবাঞ্ছিত। হওয়া উচিত হয়নি। যে দৃশ্য দেখা গিয়েছে, তা হওয়া উচিত ছিল না। ভিডিয়ো দেখিয়ে, পরিপার্শ্বের শব্দাবলি শুনিয়ে বলতে হয়েছে, পুলিশই প্রথমে আক্রান্ত হয়েছিল। পুলিশকে ‘গুন্ডা’, ‘শয়তান’ ইত্যাদি বলা হয়েছে। পুলিশকে মার খেতে হয়েছে। পুলিশকে কেউ মারবে আর পুলিশ কিছু করবে না, এটা মানা যায় না। কসবার ডিআই দফতরে বিক্ষোভকারীরা একে একে দু’টি ব্যারিকেড ভেঙে ফেলেছিলেন। তৃতীয় ব্যারিকেড ভাঙলে গোটা দফতর তাঁদের দখলে চলে যেত। পুলিশবাহিনী তা হতে দিতে পারে না।

ঠিকই। এই সবই সত্য। কিন্তু তার চেয়েও অধিক সত্য এবং অভিঘাত সৃষ্টিকারী ছবি বা ভিডিয়ো হল (পুলিশের একাংশের বক্তব্য, ভিডিয়োটা না থাকলে কিস্যু হত না) বিক্ষোভকারী শিক্ষককে পুলিশের লাথি। কারণ, পদাঘাতে অপমান অনেক বেশি। লাঠির বাড়ি গায়ে কালশিটে ফেলে বটে। কিন্তু তাতে অন্তত লাথি খাওয়ার অপমানটা থাকে না। লাঠি খায় বিপ্লবী আর আন্দোলনকারীরা। লাথি খায় চোর-ছ্যাঁচড়েরা (যাদের পরিচয় দিতে বাঙালির ভাষ্যে ‘লাথখোর’ শব্দটি বা ‘লাথি-ঝাঁটা খেয়ে পড়ে আছি’ ধরনের অপমানসূচক বাক্য তৈরি হয়েছে)।

এটা ঠিক যে, পুলিশদের মধ্যে একজনই লাথি মেরেছেন। ঘটনাস্থলে কর্তব্যরত বাকি পুলিশকর্মী বা অফিসারেরা তা করেননি। অন্তত তেমন কিছু দেখা যায়নি। বরং তাঁরা ‘ম্যানুয়্যাল’ বা ‘ড্রিল’ মেনেই বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তা করতে গিয়ে আহতও হয়েছেন একাধিক পুলিশকর্মী এবং অফিসার। বিনা বাধায় ক্রুদ্ধ জনতা ডিআই দফতরের দখল নিলে বা সেখানে তাণ্ডব চালালে যাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হত, তাঁরাও সেই পুলিশই। বাধা না-দিলে তাঁরাই কর্তব্যে অবহেলার দায়ে পড়তেন। কিন্তু সেই নিক্তিতে তো আর সমাজ ঘটনা বা তার অভিঘাত মাপে না। বিশেষত সেই সমাজ, যা কাউকে ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। যে সমাজ অন্যে কাদায় পড়লে খুশি হয়। অন্যের ব্যর্থতার নিরিখে নিজের সাফল্য নির্ধারণ করে। অতএব, এ একেবারেই আশ্চর্যের নয় যে, পদাঘাতরত যে উর্দিধারীর ছবি দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছে, তাঁরও অতীতের সমস্ত অধীত পেশাগত কৃতিত্বের ইমারত ভেঙে পড়েছে ওই একটি লাথিতে।

অন্যায়? হতে পারে। কিন্তু পৃথিবীটা তো এমনই নির্মম! ন্যায়-অন্যায়ের তুলাদণ্ড সেখানে কখনও সমান-সমান থাকে না। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে চাকরি-হারানো যে হাজার হাজার মানুষ রাজ্যের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন, তাঁরা কোন ন্যায়টা পেলেন? যোগ্য এবং অযোগ্যের (শীর্ষ আদালতের ভাষায় ‘দাগি’। ‘টেন্টেড’) ভেদরেখা যে গুলিয়ে গেল, সৎপথে খেটেখুটে চাকরিপ্রাপকদের সঙ্গে অসদুপায়ে খিড়কির দরজা দিয়ে শিক্ষক হয়ে যাওয়াদের যে কোনও তফাত রইল না, তা-ও কি ন্যায়? এটা কি হওয়া উচিত ছিল? মোটেই ছিল না। দু’দিন আগে নেতাজি ইন্ডোরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁদের আশ্বাস দিলেন সরকার তাঁদের পাশে আছে বলে, তাঁদেরই এক জন পুলিশের লাথি খেলেন! এটা কি হওয়া উচিত ছিল? অবশ্যই ছিল না।

আবার এই যে ওই একটি লাথি মাজা ভেঙে দিল পুলিশবাহিনীর ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ নীতির, প্রায় চৌপাট করে দিল পুনরুদ্ধৃত ভাবমূর্তি (নইলে বার বার তার জন্য প্রকারান্তরে দুঃখপ্রকাশ করতে হত না বাহিনীর দাপুটে নেতাকে), সামগ্রিক ভাবে পুলিশ সম্পর্কে আবার একটা ‘ন্যারেটিভ’ বা ভাষ্য তৈরি হয়ে গেল ওই একটি লাথির জন্য, তা-ও কি উচিত ছিল? শিক্ষকদের যে আন্দোলন জনমানসে আরজি করের মতো প্রভাব ফেলতে পারেনি, ওই একটি লাথি সেই ঈপ্সিত অভিঘাত তৈরি করে দিল। আমজনতার একটা অংশ ভাবতে শুরু করল, ওই লাথিটা আসলে তাদেরই মারা হয়েছে। ভাবল, পুলিশ তো এই রকমই। সেই ভাবনা আরজি করের ঘটনায় পুলিশের বিভিন্ন ভূমিকার ‘ব্র্যান্ড রি-কল’ করাচ্ছে জনমনে। লোকে ফ্ল্যাশব্যাকে অতীতে ফিরে গিয়ে বর্তমানের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিচ্ছে। ক্ষোভের যে আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল, স্মৃতির ছাই উড়িয়ে তাতে আবার নতুন নতুন স্ফুলিঙ্গ জুড়ে যাচ্ছে।

সে অর্থে দেখলে এ-ও কি হওয়া উচিত ছিল? হয়তো ছিল না। হয়তো ছিল। সেই উচিত-অনুচিতের তর্কে না ঢুকে বলতে পারি, কাম্য ছিল না। একেবারেই কাম্য ছিল না।

কারণ, পৃথিবীটা খুব নির্মম। এবং বিবিধ অন্যায় দিয়ে ভরা। সেখানে ন্যায়-অন্যায়ের নিক্তি কখনও ভারসাম্য মেনে চলে না। অন্যায়ের বাটখারাই সাধারণত ওজনে বেশি হয়ে থাকে। সকাল সকাল সাদা পোশাকে সহ-নাগরিকদের ভিড়ে মিশে যেতে যেতে ডাকাবুকো মনোজ বর্মা কি দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে সেটাই ভাবছেন? ভাবছেন, স্রেফ একটি লাথির জন্য!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.