নিজের কলেজে ‘ধর্ষিতা’ ছাত্রী। ‘ধর্ষক’ পূর্বপরিচিত এবং ছাত্র রাজনীতিতে দু’জনে ‘সহযোদ্ধা’। খাস কলকাতায় একটি আইন কলেজে এক ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে শোরগোল। উত্তাল রাজ্য রাজনীতি। পুলিশের কাছে ঠিক কী জানিয়েছেন ‘নির্যাতিতা’? বয়ানে কার কার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযোগ? অভিযোগপত্র হাতে পেল আনন্দবাজার ডট কম।
অভিযোগপত্রে মোট তিন জনের নাম রয়েছে। মূল অভিযুক্তকে তাঁর নামের আদ্যক্ষর ‘জে’ দিয়ে সম্বোধন করেছেন ‘নির্যাতিতা।’ বাকি দু’জনকে সম্বোধন করেছেন ‘এম’ এবং ‘পি’ বলে। অভিযোগ, ‘জে’ যখন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁর উপর নারকীয় অত্যাচার করছেন, তখন ‘এম’ এবং ‘পি’ তাঁর নীরব দর্শক এবং কখনও কখনও সাহায্যকারীর ভূমিকা নিয়েছেন। তরুণীর অভিযোগ, অনুনয়-বিনয় করেও তিনি রেহাই পাননি। পায়ে পড়েছেন। উল্টে মিলেছে হুমকি। শারীরিক নির্যাতনের সময় হকি স্টিক দিয়ে মারধর করতেও উদ্যত হন অভিযুক্ত।
পুলিশের কাছে নির্যাতিতার বয়ান অনুয়ায়ী, গত ২৫ মে পরীক্ষার ফর্ম পূরণের জন্য কলেজে গিয়েছিলেন তিনি। দুপুরে নির্দিষ্ট সময়ে ফর্ম পূরণ হয়ে যায়। তার পর তিনি ইউনিয়ন রুমে গিয়েছিলেন। অভিযোগপত্রে তিনি লিখেছেন, ‘‘দুপুর ১২টা ৫ মিনিট নাগাদ আমি ইউনিয়ন রুমে যাই। ‘জে’ ইউনিয়ন রুমে ঢুকে বলেন, ওখানে উপস্থিত সকলে যেন ইউনিয়ন রুমে থাকি। আমরা তা-ই করি। ওই ব্যক্তি কলেজের প্রাক্তনী এবং বকলমে আমাদের কলেজের টিএমসিপি ইউনিটের প্রধান। কলেজে উনি বিশেষ প্রভাবশালী। সকলে ওঁর কথা শোনেন। উনিই আমাদের সকলকে টিএমসিপি-র বিভিন্ন পদে বসিয়েছেন। আমাকে ছাত্রীদের সেক্রেটারি করেছেন উনিই।’’
এর পর নির্যাতিতা অভিযোগে জানান, ওই দিন দুপুরে সকলে ইউনিয়ন রুমে ঠাট্টা-তামাশা করছিলেন। বিকেল ৪টে নাগাদ অনেকেই ইউনিয়ন রুম থেকে বেরিয়ে যান। তিনিও কলেজের গেটের দিকে এগোচ্ছিলেন। সেই সময় কলেজের জিএস-এর (জেনারেল সেক্রেটারি) সঙ্গে দেখা হয় এবং দু’জনে কথা বলেছিলেন। তার পরে ‘জে’ –এর সঙ্গে দেখা হয় তাঁদের। তিনি এক প্যাকেট বিস্কুট তুলে দেন তাঁর হাতে। সেই সঙ্গে জানান, আবার এক বার ইউনিয়ন রুমে যেতে। কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা হবে। মোটের উপর তাঁরা সাত জন ইউনিয়ন রুমে জড়ো হন। সেখানে ‘জে’ তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। তিনি কতটা প্রভাবশালী, সে সব উল্লেখ করেন। ‘নির্যাতিতা’ লেখেন, ‘‘এর কিছু ক্ষণ পরে ‘পি’ আমাকে ইউনিয়ন রুমের বাইরে ডাকেন এবং আমার বিশ্বস্ততার প্রমাণ চান। আমি জানাই, আমি তাঁদের অনুগত। আমরা আবার ইউনিয়ন রুমে যাই। সেখানে ‘জে’ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন ‘পি’ আমাকে সব কিছু ব্যাখ্যা করেছেন কি না। তখন আমি বলি, ‘‘হ্যাঁ, দাদা আমি সর্বদা ইউনিটের সঙ্গে আছি। কিছু ভেবো না।’’ তখন উনি আমাকে বলেন, ‘‘না, ও সব কিছু নয়।’’’ তরুণীর দাবি, এর পর কলেজের ‘দাদা’ তাঁকে প্রেমের প্রস্তাব দেন। ইউনিয়ন রুমের বাইরে বেরিয়ে বলেন, কলেজে প্রথম যে দিন তাঁকে দেখেছেন, সে দিন থেকেই পছন্দ করেন। ছাত্রীটি লিখেছেন, ‘‘উনি (‘জে’) আমায় বলেন, ওঁর গার্লফ্রেন্ডের পরে যদি কাউকে সবচেয়ে বেশি ভালবেসে থাকেন, সেটা আমি। এবং তার পরেই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। আমি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলি, আমার ‘বয়ফ্রেন্ড’ আছে। আমি তাকে ছাড়তে পারব না। তার পরে আর কিছু ক্ষণ আমরা দু’জন কথা বলে ইউনিয়ন রুমে ফিরে যাই।’’
তরুণীর দাবি, তখনও সব কিছু স্বাভাবিক ছিল। সন্ধ্যা ৬টা ১০ মিনিটে ইউনিয়ন রুমে উপস্থিত অন্যান্য ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনিও বাড়ি যাওয়ার জন্য বেরোচ্ছিলেন। ঠিক তখন তাঁকে আটকান ‘জে’ এবং বলেন, একটু থেকে যাওয়ার জন্য। তিনি এবং আরও কয়েক জন ছিলেন। সাড়ে ৭টা নাগাদ তিনি বেরোতে গেলে আবার ‘জে’ তাঁকে বাধা দেন। এবং তাঁর চোখের ইশারায় অন্য দুই অভিযুক্ত ‘পি’ এবং ‘এম’ ইউনিয়ন রুমের বাইরে বেরিয়ে যান। তরুণীর দাবি, ‘‘ওঁরা বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইউনিয়ন রুমের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুরোটা ঘটে যায়। ‘জে’ আমাকে ‘ওয়াশরুমের’ দিকে টেনে নিয়ে যান। এবং জোর করতে থাকেন শারীরিক সম্পর্কের জন্য। আমি বারংবার ‘না’ বলতে থাকি। বাধা দিতে থাকি ওঁকে। কেঁদে ফেলে ওঁকে অনুরোধ করি, আমায় ছে়ড়ে দিতে। কিন্তু আমার কোনও কথাই শোনেননি। আমার উপর আরও জোর খাটাতে থাকেন। আমি ভয়ে পেয়ে যাই। ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হয় আমার। শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। তখন ‘জে’ ‘এম’ এবং ‘পি’-কে হাঁক দিয়ে ডাকেন। আমি ওঁদের সকলকেই বলি, আমায় রুবি জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যেতে। কারণ, আমার শরীর খারাপ লাগছে। কিন্তু ওঁরা কেউ কথা শোনেননি। তখন আমি ওঁদের অনুরোধ করি, আমায় একটি ইনহেলার অন্তত এনে দিন। ‘এম’ তাতে সাড়া দেন। ইনহেলার নেওয়ার পর কিছুটা ঠিক হই আমি। নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে প্রায় পালাতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু দেখলাম, ওঁরা মেন গেট বন্ধ করে দিচ্ছেন! আমি গার্ডের (গেটে দাঁড়ানো রক্ষী) কাছে সাহায্য চাই। কিন্তু উনি অসহায় ছিলেন। আমায় সাহায্য করেননি। ‘এম’ এবং ‘পি’ আবার জোর করে আমায় ইউনিয়ন রুমে নিয়ে যান। আমি ‘জে’-এর কাছে কাকুতি-মিনতি করি। আমি ওঁর পা পর্যন্ত ধরি। উনি ‘এম’ এবং ‘পি’ কে বলেন, আমায় গার্ডস রুমে নিয়ে যেতে। এবং রক্ষীকে বাইরে রাখতে। ওঁরা তাই করেন।’’
ছাত্রীর অভিযোগ, এর পর ‘জে’ তাঁকে বিবস্ত্র করেন। এবং ধর্ষণ করেন। যখন আমি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলাম, তখন আমায় ব্ল্যাকমেল করতে শুরু করেন উনি। আমায় হুমকি দিয়ে বলেন, এ সব আগেও করেছেন। এমনকি, আমার প্রেমিককে খুন করে দেওয়া এবং বাবা-মাকে পুলিশ দিয়ে গ্রেফতার করিয়ে দেবেন বলে হুমকি দেন। তার পরেও যখন আমি বাধা দিই, তখন আমার বিবস্ত্র অবস্থার দু’টি ভিডিয়ো দেখিয়ে উনি বলেন, সকলকে এই ভিডিয়ো দেখাবেন। ‘জে’ যখন আমায় ধর্ষণ করছিলেন, তখন ‘এম’ এবং ‘পি’ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। আমি নিজেকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টা করে গিয়েছি। কিন্তু পারিনি…।’’
এর পরে ওই ছাত্রীর বিবরণ আরও ‘ভয়াবহ।’ তিনি লেখেন, ‘‘আমার মাথায় প্রচণ্ড জোরে আঘাত লাগে। কিন্তু তা-ও আমায় ছাড়েননি। আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাই। তখন আমায় হকি স্টিক দিয়ে মারধর করতে চান। এক সময়ে আমি নিজেকে ছাড়ানোর যুদ্ধ বন্ধ করে দিই। অর্ধমৃত অবস্থায় পড়েছিলাম। উনি আমায় ধর্ষণ করে উঠে চলে যান। ১০টা ৫০ মিনিটে যখন আমি কোনও রকমে ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসছি, তখনও ‘জে’ আমায় হুমকির সুরে বলেন, এ সব যেন কাউকে না বলি। আমার ফোন ছিল ‘এম’-এর কাছে। আমি ফোনটা নিই। কলেজ থেকে বেরিয়ে আমার বাবাকে ফোন করি। বলি, আমায় যেন নিয়ে যেতে আসেন। বাবাকে সব বলি। কিন্তু পুলিশের কাছে যেতে আমার ভয় করছিল। আমি ‘জে’-র ক্ষমতা জানি। ওঁর ক্ষমতাকে ভয় পাই। কিন্তু আজ (২৬ জুন) আমি মনস্থির করেছি পুলিশকে জানাব। তাই পুরো ঘটনার কথা লিখলাম।’’
চিঠির শেষাংশে ‘নির্যাতিতা’ লিখেছেন, ‘‘আইনের ছাত্রী হয়ে আজ আমি নিজেই নির্যাতিতা। আমি নিজের জন্য বিচার চাইছি। দয়া করে ‘জে’, ‘এম’ এবং ‘পি’-এর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিন।’’
অতঃপর কসবা-কাণ্ড
পুলিশ সূত্রে খবর, গত ২৫ জুন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১০টা ৫০ মিনিটের মধ্যে সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পরের দিন কসবা থানায় তরুণী লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পার্ক সার্কাসের কলকাতা ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে ওই তরুণীর শারীরিক পরীক্ষা করানো হয়। বয়ান রেকর্ড করা হয়েছে সাক্ষীদের। এর পর অভিযোগের ভিত্তিতে এফআইআর দায়ের করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। তালবাগান ক্রসিংয়ের সামনে থেকে অভিযুক্ত দু’জনকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ তৃতীয় অভিযুক্ত ধরা পড়েন। শুক্রবার তাঁদের আলিপুরের আদালতে হাজির করানো হয়। আগামী ১ জুলাই পর্যন্ত তিন জনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।