এক স্মরণীয় প্রেস কনফারেন্সের বাহন হলো ‘শিক্ষা’

‘সত্য শোনার ক্ষমতা থাকা দরকার, সত্য বোঝার ক্ষমতাও’ — বললেন চীফ ইলেকশন কমিশনার জ্ঞানেশ কুমার।
ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালের শেষ কয়েক ওভার বা ফুটবল ওয়ার্ল্ড কাপের টাইব্রেকারের মতো উত্তেজনা ছিল এই প্রেস কনফারেন্স জুড়ে কিন্তু তাদের কাছেই যারা ‘SIR’ বা স্পেশাল ইনটেন্সিভ রিভিশন নিয়ে সাম্প্রতিককালে নিয়মিত খবর দেখছেন, রাজনৈতিক নেতাদের প্রতিক্রিয়া – পাল্টা নির্বাচন কমিশনের উত্তর শুনেছেন।

মিথ্যা বলার থেকেও সত্য কে ধূমিত করে দেওয়া বড় অপরাধ বিশেষ করে সেই দেশে যেখানে মানুষ শুধুমাত্র অন্যের কথা শুনে ‘মত’ তৈরি করে। অন্যের কথা শুনে ‘মত’ তৈরি করা মানেই তা অশিক্ষিতের কাজ নয় বরং তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই এর প্রয়োগ বেশি।
কেমন করে?
ধরা যাক, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে ‘ছুটি’ নিতে গেলেন বা কোনো প্রশাসনিক আবেদন করতে গেলেন । কর্মকর্তা মহাশয় যদি অলস-অযোগ্য হন , তাহলে ফোন করবেন নিজের সমপর্যায়ের আধিকারিক কে — নিজে পড়বেন না, বোঝার চেষ্টাও করবেন না আইনের মারপ্যাঁচ, অলিগলি ঘুরবেন না — তার চেয়ে বরং পাহাড়ের কোলে ঘুরে বেড়ানো সহজ ! আর উল্টোদিকের আবেদনকারী ‘শিক্ষিত’ হলেও শিক্ষাকে বাহন না করে ঐ এর-ওর শুনেই নিজের অধিকারের সীমাটা ছোটো করে শিক্ষাকে ‘বহন’ করবেন!
তাই সত্যি সত্যিই’পড়তে হয়’ নাহলে পিছিয়ে পড়তে হয় আর এই পড়া খবর শুনে বা কথা শুনে ‘মত’ তৈরি নয় বরং সত্য ঘটনা দেখেশুনে ‘মত’ তৈরি করার অভাবেই অনেক ফাইনাল ম্যাচে গোল খেতে হয় তাদের যারা ‘কাগজ’ না পড়েই কাগজ নিয়ে প্রশ্ন করেন বা ভাবেন যে ‘কাগজ’ তার কেনা গোলাম আর তার ঐ চেয়ারটাকে মানে ।
‘কাগজ’ শুধু তাঁকেই মানে যে কাগজ বোঝে!

‘রাজনীতি’ করতে গেলে যে পুঁথিগত বিদ্যা থাকতেই হবে এমন কোনো ব্যাপার নেই কিন্তু পুঁথিগত বিদ্যা’র উপরে উঠতে গেলে এদেশের ঐতিহ্য-সাধারণ মানুষ – তাদের জীবনযাত্রা- কষ্ট ও আনন্দ-সমস্যা ও সমাধানের অধ্যয়ন জরুরী।

আর যদি পুঁথিগত বিদ্যা না থাকে আর সোনার চামচ মুখে নিয়ে রাজনীতি করতে নামা যায় তাহলে রাজনীতি তে শুধুই নেমে যেতে হবে!

সাংবাদিকরা এই ঐতিহাসিক (লেখকের মতে) প্রেস কনফারেন্সে নিজেরা যে অধ্যয়ন করে আসেন নি , তারা এক বিশেষ রাজনৈতিক ব্যক্তির প্রশ্নগুলোই রেখেছেন আর তা ভালোই করেছেন কারণ দেশের মানুষের কাছে অসত্য-ধূমায়িত মিথ্যা পরিবেশনের যে প্রথা শুরু হয়েছে তার ‘ইতি’ টানা দরকার।

যে প্রশ্নগুলো উঠে এসেছে এবং সাধারণ মানুষের সামনে রাখা হচ্ছে তার যথাযথ উত্তর হাসিমুখে, শান্তচিত্তে শ্রী জ্ঞানেশ কুমার দিচ্ছিলেন বলে বোঝাই যাচ্ছিল না এই ম্যাচের ভেতরের উত্তেজনা কিন্তু সাংবাদিকদের মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তারা উত্তর শুনে শুধু তৃপ্তই নয় অবাকও বটে — আর হয়তো নিজেদের কাছে তাদের একটা প্রশ্নও উঠে এলো , যাকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন গণতন্ত্রের স্বার্থেই, তার কি এই গুরুত্ব পাওয়া উচিত ?

প্রশ্নের উত্তরগুলোর সংক্ষিপ্ত রূপমোটামুটি এইরকম ছিল —-
১) মতদাতার সূচী(Electoral roll)আর মতদান (Voting) দুটো আলাদা প্রক্রিয়া আর এই দুটোকে গুলিয়ে দিয়েই মিথ্যাচার করা হচ্ছে।

২) মতদাতার সূচী তে এক ব্যক্তির (Elector) একাধিকবার নাম আসলেই ঐ ব্যক্তি যে একাধিকবার মতদান করেছেন তার নিশ্চয়তা নেই অর্থাৎ ‘ভোটচুরি’র প্রশ্নই ওঠে না।

৩) মতদাতার সূচী তৈরির সময় নির্বাচন কমিশনের তরফ থেকে যেমন BLO থাকেন , তেমনি প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের ব্লক লেভেল এজেন্ট BLA থাকেন — তাই এটি একটি সামূহিক প্রক্রিয়া। শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশন কে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না।
আর মতদাতা সূচী তে নির্বাচনের আগে একটি নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত ভুল ধরা ও সংশোধনের আবেদন ঐ অঞ্চলের যে কোনো মতদাতা, সাংসদ , বিধায়ক করতে পারেন আর ঐ ত্রুটি সংশোধন ঐ নির্দিষ্ট জেলার ডি এম বা ঐ রাজ্যের CEO পর্যন্ত এসে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। মতদাতা সূচী সংক্রান্ত সংযোজন বা বিয়োজনের কাজ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দপ্তর পর্যন্ত আসার অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়, এমনকি চীফ ইলেকশন কমিশনার নিজেও কোনো নাম সংযোজন বা বিয়োজন করতে পারেন না।

৪) যে বা যারা কোনো প্রশ্ন বা দাবি করবেন, আইন অনুযায়ী তাকে হলফনামা দিতেই হবে, নাহলে তার আইনী বৈধতা থাকে না।

৫) বিহারে গতবার জুলাই – অগাস্টের সময়েই SIR এর কাজ হয়েছে আর সফলভাবে হয়েছে। তাই নির্বাচন কমিশনের উপর এই অভিযোগ সত্য নয় যে তাঁরা তড়িঘড়ি এইবার বিহারে ‘SIR’ করছেন।

৬) কয়েকলক্ষ ভোটারের মতদান কে ভুয়ো বা অবৈধ বলা কি সেই সমস্ত ভোটারদের অপমান নয় ? ইলেকশন কমিশন কি কোনো হলফনামা ছাড়াই ঐ কয়েক লক্ষ ভোটার কে নোটিশ জারি করতে পারে?
আর এরকম তথ্য মিডিয়া তেই উঠে আসছে যে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ভোটারের অনুমতি ব্যতিরেকে তার ছবি ব্যবহার করছে ও মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করছে।

৭) ভোটার তালিকায় ভুল থাকা মানেই ভুয়ো মতদান নয় কারণ প্রত্যেক পোলিং বুথে রাজনৈতিক দলের এজেন্ট থাকে।

৮) নির্বাচন কমিশনের কাছে কোনো রাজনৈতিক দল পক্ষ বা বিপক্ষ নয় , সবাই সমকক্ষ কারণ সব রাজনৈতিক দল কে ‘বৈধতা’ নির্বাচন কমিশনই দিয়েছে।

৯) বিহারে প্রায় ২০ লক্ষের বেশি মৃত ভোটার শুধুমাত্র ২০২৪ এর আগেই হঠাৎ করে ‘জমা’ হয় নি, বিগত বছরগুলোতে ধীরে ধীরে মৃত ভোটার বাদ না যাওয়াতেই সংখ্যা টা এই জায়গাতে পৌঁছেছে।
আর যতক্ষণ না মৃত ভোটারের পরিবারের সদস্য এই তথ্য BLO কে নিজে থেকে না জানাচ্ছেন, নির্বাচন কমিশনের জানার উপায় থাকে না।
আর নির্বাচন কমিশনের কাছে একমাত্র উপায় বলতে প্রত্যেক মতদাতার নামে ‘Enumeration form ‘ জারি করা, যাকে আমরা ‘SIR’ বলছি।
এতসংখ্যক ভোটারের নাম বাদ যাওয়া, ব্যক্তি এক – EPIC অনেক বা EPIC অনেক – ব্যক্তি এক —- এই সমস্ত সমস্যার সমাধান যে ‘SIR’, বিহারের ‘SIR’ তা প্রমাণ করেছে।

১০) অনেক বাড়ির নম্বর ‘শূন্য’ দেওয়া হয়েছে কারণ যারা গৃহহীন তাদের মতদানের অধিকার কে সুরক্ষিত করতেই নির্বাচন কমিশন তাদের ‘হাউস নাম্বার’-এর জায়গায় ‘শূন্য’ লিখেছেন।
তাই হাউস নাম্বার একই হয়ে যাওয়া মতদাতা সূচীর ত্রুটি নির্দেশ করে না।

১১) Representation of People Act -1950 মতদাতাদের সূচী তৈরির জন্য আর Representation of People Act – 1951 মতদান প্রক্রিয়ার জন্য। তাই মতদাতাদের সূচী তৈরি আর মতদাতাদের ‘মত’ নেওয়া দুটো আলাদা প্রক্রিয়া এবং এই দুটো প্রক্রিয়া নির্বাচন কমিশনের নেতৃত্বে পরিচালিত হলেও সমস্ত স্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এই প্রক্রিয়া তে জড়িত থাকেন আর আইনী প্রক্রিয়া মেনে যে কোনো সময় ত্রুটি দেখিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আবেদন করতে পারেন।

ভারতীয় রাজনীতি আর বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান আর ভারতের সাধারণ মানুষ যে অহেতুক বিভ্রান্তির মধ্যে ফেঁসে যাচ্ছেন তার মূল কারণ সোনার চামচ মুখে দেওয়া ; পড়াশোনায় অনভ্যস্ত আর ভারত কে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ‘Deficiency’ দ্বারা প্রভাবিত Mal-nutritioned রাজনীতিক।

তবে শ্রী জ্ঞানেশ কুমার এই প্রেস কনফারেন্সে যেভাবে উত্তর দিয়েছেন তা পুষ্টির অভবজনিত রোগ সারাতে না পারলেও আসল ‘শিক্ষা’ সম্পর্কে ভারতের মানুষের সামনে একটা উদাহরণ রাখলেন।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.