Durga, Chatna Rajbari, মল্লভূমের মৃন্ময়ী মায়ের আদলে দেবী দুর্গা পূজিত হন ছাতনা রাজবাড়িতে

বাঁকুড়া জেলার দুর্গাপূজার ইতিহাসে ছত্রিনানগর বা ছাতনা রাজবাড়ির দুর্গাপূজাতে মল্ল রাজের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এখানে মল্লভূমের দেবী মৃন্ময়ীর আদলে দেবী দুর্গার প্রতিমা আজও প্রাচীন রীতি ও পরম্পরা মেনে নিষ্ঠায় পূজিতা হন। প্রাচীন রীতি মেনে এখনও রাজ পরিবারের সদস্যরা পুজোর পর আর মায়ের মুখ দেখেন না। দশমীর সন্ধে নামতেই চুপি চুপি হয়ে যায় বিসর্জন।

রাজ পরিবারের বর্তমান সদস্যদের মতে, ছাতনা রাজ বাড়ির কুলদেবী মা বাসুলী। সামন্তভূম ছাতনার সঙ্গে কুলদেবী মা বাসুলীর গভীর সম্পর্ক। মল্লভূম বিষ্ণুপুরের সঙ্গে সামন্তভূম ছাতনার মধ্যে এক বিবাদের জেরে প্রায় সাড়ে ৫০০ বছর আগে ছাতনা রাজবাড়িতে শুরু হয় দূর্গাপুজো।

রাজপরিবারের সদস্যদের বক্তব্য, ছাতনার ভূমিপুত্র চারণ কবি বড়ু চন্ডীদাসকে কেন্দ্র করে বিবাদ হয় মল্লভূম বিষ্ণুপুর ও সামন্ত ভূম ছাতনার মধ্যে।এই বিবাদ মেটাতে সন্ধি হয়। কথিত আছে সেই সন্ধি অনুসারে সামন্তভূমের কুলদেবী মা বাসুলি পুজিত হন বিষ্ণুপুরে এবং মল্লভূমের মা মৃন্ময়ীর আরাধনা শুরু হয় সামন্তভূম ছাতনায়। তখন থেকেই ছাতনা রাজবাড়িতে মা মৃন্ময়ীর আদলে দুর্গা প্রতিমার পূজা হয়ে আসছে ।মা মৃন্ময়ীর পূজার পর কুলদেবী বাসুলি মায়ের পূজা করা হয়। ছাতনার রাজবাড়িতে মা মৃন্ময়ীর পূজো শেষ হলে আর মন্দিরে এসে মায়ের মুখ দেখেন না রাজ পরিবারের সদস্যরা। প্রাচীন প্রথা অনুসারে বিসর্জনের দিন সূর্যাস্তের পর ছাতনার এক বিশেষ পাড়ার বাসিন্দারা হাজির হন।পরম্পরা গত ভাবে তারাই বিসর্জন দেওয়ার সব কাজ করেন। গত সাড়ে ৫০০ বছর ধরে এভাবেই বিসর্জনের কাজ হয়ে আসছে। অন্য দিকে রীতি মেনে এই বিসর্জনের সময় ঘরের ভেতরে থাকেন রাজ পরিবারের সদস্যরা। তাদের অনুপস্থিতিতে হয় মা মৃন্ময়ীর বিসর্জন।

উল্লেখ্য,গত ৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম দুর্গাপুজোর আয়োজন করে ছিলেন বিষ্ণুপুরের রাজা জগৎ মল্ল। প্রতিমার নাম মৃন্ময়ী। রাজবাড়ি লাগোয়া মন্দিরও নির্মাণ করেন তিনি। পুজোর ১৫ দিন আগে জিতাষ্টমী থেকে পুজো শুরু হয়ে যায়।দুর্দান্তপ্রতাপী রাজার এই পুজো দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। জেলার বিভিন্ন রাজ ও জমিদার বাড়িতে এই অনুকরণে পূজা শুরু হয়। মল্লভূম বিষ্ণুপুর রাজবাড়ীর দুর্গাপূজার অনুকরণে সামন্তভূমের ছত্রিনানগর বা বাঁকুড়ার ছাতনা রাজবাড়ীর দূর্গা প্রতিমা থেকে পূজার রীতিনীতি প্রায় অভিন্ন।ছাতনার এই পুজো প্রায় সাড়ে ৫০০ বছরের পুরনো হলেও বর্তমান দুর্গা মন্দিরটি প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। বর্তমানে এই মন্দিরটিতে বেশ কিছু সংস্কার করা হয়েছে পুরোনো ঐতিহ্যকে বজায় রেখে। জানা যায়, এই মন্দিরটি তৈরি করেছিলেন রানী আনন্দ কুমারী। বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের তৈরি‌ মন্দিরের মায়ের প্রতিমার সঙ্গে এখানকার প্রতিমার মিল রয়েছে।মল্ল রাজাদের অনুকরণে এখানেও দেবীর বোধন হয় জীতাষ্টমীতে। তোপধ্বনির মাধ্যমে সম্পন্ন হয় সন্ধিপুজো। তবে এখানকার পুজোয় ডালা দৌড় ও খাড়া দৌড়ের মত কিছু নিজস্ব আকর্ষন আছে।অতিতে দুর্গা পুজোতে প্রজারা ভেট নিয়ে ছাতনা রাজবাড়িতে উপস্থিত হতেন। কিন্তু সে প্রথা এখন নেই। তবে সন্ধিপূজার সময় ছাতনার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ডালা ভর্তি নৈবেদ্য নিয়ে আসেন ভক্তরা।দেবীর কাছে আগে নৈবেদ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য সংলগ্ন এলাকাবাসীদের দৌড়ে আসতে দেখা যায়। এটা প্রাচীন প্রথাও। এটি ‘ডালা দৌড় ‘নামে পরিচিত। আবার বিজয়ার দিন প্রতিমা বিসর্জনের সময় রাজাদের ব্যবহৃত পুরোনো তরোয়াল সহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে ক্ষত্রিয়রা বিসর্জনের শোভা যাত্রা করেন। বিসর্জনের পর সেসব অস্ত্র নিয়ে কুলদেবী বাসুলি মায়ের মন্দির পর্যন্ত দৌড়ে এসে শ্রদ্ধা জানান তারা। এটি ‘খাড়া দৌড় ‘ নামে পরিচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.