ডাকেটকে গলা জড়িয়ে ‘বিদায়’! আকাশদীপের কি দু’ম্যাচ নির্বাসন, না কি আর্থিক জরিমানা? দ্বিধাবিভক্ত ক্রিকেটবিশ্ব

‘আমি থাকলে ঘুষি মারতাম!’ সরাসরি হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন রিকি পন্টিং। মার্কাস ট্রেসকোথিক আবার জানিয়েছেন, কনুইয়ের গুঁতো মারতেন তিনি। কিন্তু কাকে? দু’জনেরই নিশানায় আকাশদীপ। ভারতের পেসার। বাংলার পেসার। ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজ়ের উত্তাপ ওভালে সবচেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। ইংল্যান্ডের বেন ডাকেটকে আউট করে তাঁর গলা জড়িয়ে ‘বিদায়’ জানিয়েছেন আকাশদীপ। এই কাজ করে তিনি কি ক্রিকেটের নিয়ম ভেঙেছেন? তবে কি এ বার ভারতের আরও এক পেসার শাস্তি পাবেন?

ঠিক কী হয়েছিল? ওভালে ইংল্যান্ডের ইনিংসের শুরু থেকেই লেগে গিয়েছিল আকাশদীপ ও ডাকেটের। তাঁর একটা বল রিভার্স পুল করে ছক্কা মারেন ডাকেট। তার পর ইংরেজ ব্যাটার আকাশদীপকে বলেন, “তুমি আমাকে আউট করতে পারবে না।” এতে আকাশদীপও উত্তেজিত হয়ে পড়েন। দু’জনের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে। আকাশদীপের একটা বল ডাকেটের প্যাডে লাগলে এলবিডব্লিউয়ের আবেদন করে ভারত। আম্পায়ার আউট দেননি। রিভিউ নিয়ে দেখা যায়, বল উইকেটের উপর দিয়ে যাচ্ছে। পরের ওভারেই আকাশদীপের বলে তিনটে চার মারেন ডাকেট।

৪৩ রানের মাথায় আকাশদীপের বলে রিভার্স স্কুপ করার চেষ্টা করেন ডাকেট। বল ব্যাটের কানায় লাগে। উইকেটরক্ষক ধ্রুব জুরেল ক্যাচ ধরেন। ৩৮ বলে ৪৩ রান করে আউট হন ডাকেট। তার পরে দেখা যায়, আকাশদীপ ডাকেটের গলা জড়িয়ে ধরে কিছু একটা বলছেন। তাঁর মুখে হাসি থাকলেও ধারাভাষ্যকারদের মনে হয়েছে বিদ্রুপ করছেন তিনি। ডাকেটের মুখে কিন্তু হাসি ছিল না। কিছু ক্ষণের মধ্যে আকাশদীপকে সরিয়ে নিয়ে যান লোকেশ রাহুল।

ওভালে শুধু আকাশদীপই নন, বিতর্কে জড়িয়েছেন ভারতের আর এক পেসার প্রসিদ্ধ কৃষ্ণও। ঘটনাটি ঘটে ইংল্যান্ডের ইনিংসের ২২তম ওভারে। প্রসিদ্ধের একটা বল রুটের ব্যাট ঘেঁষে বেরিয়ে যায়। তা দেখে প্রসিদ্ধ কিছু একটা বলেন রুটকে। পরের বলেই জবাব দেন রুট। পয়েন্ট দিয়ে চার মারেন তিনি। তার পরে নিজেকে সামলাতে পারেননি রুট। হেঁটে প্রসিদ্ধের কাছে গিয়ে রুটকে কিছু বলতে শোনা যায়। তাঁকে দেখে যথেষ্ট উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। সাধারণত রুট এতটা মেজাজ হারান না। প্রসিদ্ধও চুপ ছিলেন না। তিনিও জবাব দেন।

cricket

পরিস্থিতি সামলাতে এগিয়ে আসেন আম্পায়ারেরা। তাঁদের কাছে প্রসিদ্ধ কিছু বলেন। তিনি হয়তো বোঝাতে চাইছিলেন, তাঁকে রুট কী বলেছেন। তাঁর কথা শুনে আম্পায়ারেরা রুটের সঙ্গেও কথা বলেন। তার মধ্যে জড়িয়ে পড়েন রাহুল। তিনিও আম্পায়ারদের কিছু একটা বলেন। শেষ পর্যন্ত আম্পায়ারদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।

কিন্তু আকাশদীপের মতো প্রসিদ্ধ প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারের গায়ে হাত দেননি। যা হয়েছে, তা কথার যুদ্ধ। আকাশদীপ সেই সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছেন। সেই সময় ধারাভাষ্য দিচ্ছিলেন সুনীল গাওস্কর, চেতেশ্বর পুজারা। তাঁদেরও মনে হয়েছে, ডাকেটকে আউট করে নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি আকাশদীপ। কিন্তু ওই পরিস্থিতিতে ভারতীয় বোলারের ও ভাবে গলা জড়িয়ে কথা বলা উচিত হয়নি বলে মনে করেছেন তাঁরা।

বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে পন্টিং সরাসরি ঘুষি মারার কথা বলেছেন। সম্প্রচারকারী চ্যানেলে ধারাভাষ্য দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “প্রথমে দেখে তো ভেবেছিলাম ওরা বন্ধু। প্রতি দিন এই ছবি দেখা যায় না। পাড়ার পার্কে দেখা যেতে পারে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নয়। ডাকেটের খেলা দেখে আমার ভাল লাগে। কিন্তু ও যে ভাবে নির্লিপ্ত থাকল তাতে ওর প্রতি শ্রদ্ধা আমার বেড়ে গিয়েছে।” সে কথা শুনে আর এক ধারাভাষ্যকার ইয়ান ওয়ার্ড বলেন, “আমি কয়েক জনের কথা মনে করতে পারছি যারা এই পরিস্থিতিতে থাকলে ঘটনাটা অন্য রকম হত। তার মধ্যে তুমিও একজন। তুমি থাকলে কি পন্টিংয়ের ডানহাতের ঘুষিটা দেখা যেত?” জবাবে পন্টিং হলেন, “অবশ্যই।”

ইংল্যান্ডের সহকারী কোচ ট্রেসকোথিক জানিয়েছেন, ডাকেটের জায়গায় তিনি নিজে থাকলে কনুইয়ের গুঁতো মারতেন আকাশদীপকে। ম্যাচের পর সাংবাদিক বৈঠকে ট্রেসকোথিক বলেন, “আমি এটুকু বলতে পারি, আমাদের সময়ের বেশ কয়েক জন ব্যাটার ওই পরিস্থিতিতে আকাশদীপকে কনুইয়ের গুঁতো মারত। তার মধ্যে আমিও একজন। আউট করার পর কোনও বোলারকে ওই ভাবে গলা জড়িয়ে ধরতে আমি কোনও দিন দেখিনি। অনেকে মুখে অনেক কিছু বলে। কিন্তু ওই কাজ করে না।”

ইংল্যান্ডের প্রাক্তন স্পিনার তথা বিবিসি-র ধারাভাষ্যকার ফিল টাফনেলের মতে, মহম্মদ সিরাজের মতো আকাশদীপেরও শাস্তি হতে পারে। লর্ডস টেস্টে ডাকেটকে আউট করে উল্লাস করতে গিয়ে তাঁকে ধাক্কা মেরেছিলেন সিরাজ। সেই কারণে সিরাজের ম্যাচ ফি-র ১৫ শতাংশ কেটে নেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি তাঁকে একটা ডি-মেরিট পয়েন্টও দেওয়া হয়েছিল। সেই কথা মনে করিয়ে দিয়ে টাফনেল বলেন, “কাউকে আউট করে সঙ্গে সঙ্গে তার গলা জড়িয়ে ধরা কি ঠিক? আমার মনে হয় না। আমি এমন অনেককে চিনি যাদের আউট করে যদি আমি ও রকম করতাম, তা হলে তারা খুশি হত না। ম্যাচ রেফারির বিষয়টা দেখা উচিত।”

cricket

ব্যাটারকে আউট করে বোলারদের উল্লাসের বিচিত্র ধরন ক্রিকেটে কম নেই। কারণ, কোনও ব্যাটারকে আউট করা বোলারের ক্ষেত্রে যুদ্ধজয়ের থেকে কম নয়। তাই অনেকেই চেষ্টা করেন বিষয়টা উদ্‌যাপন করতে। সেটা করতে গিয়ে অনেকে সীমা পেরিয়ে যান। যেমন লর্ডসেই ঋষভ পন্থকে আউট করে জফ্রা আর্চার চিৎকার করে বলেছিলেন, “সকলে ওর দিকে তেড়ে যাও।” আবার সেই টেস্টেই যখম জাক ক্রলিকে শুভমন গিল স্লেজ করছেন, তখন সিরাজ-সহ বাকি বোলারদের দেখা গিয়েছিল, তাঁর কাছে গিয়ে হাততালি দিচ্ছেন। সিরাজ মুখেও কিছু বলেছিলেন।

সিরাজের ক্ষেত্রে এই ধরনের বিতর্ক অবশ্য কম নয়। গত বছরের শেষে অ্যাডিলেডে অস্ট্রেলিয়ার ট্রেভিস হেডকে আউট করে তাঁকে সাজঘরের দিকে যাওয়ার ইশারা করেছিলেন সিরাজ। ফিল্ডিং করার সময় সিরাজকে বিদ্রুপ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার সমর্থকেরা। পরে হেড বলেছিলেন, “আমি ওকে বলেছিলাম, ‘ভাল বল করেছ।’ জানি না, কেন ও রেগে গেল। আমি যে ভাবে খেলছিলাম, তাতে একটু সম্মান আশা করেছিলাম। ওর উল্লাসের ধরন দেখে আমি অবাক হয়েছিলাম। তবে আমি জবাবে কিছু বলতে চাইনি।”

আগেও অনেক টেস্টে এই ছবি দেখা গিয়েছে। ২০১৫ সালে গ্রেনাডায় ইংল্যান্ডের বেন স্টোকসকে আউট করে সেলাম ঠুকেছিলেন মার্লন স্যামুয়েলস। যদিও স্যামুয়েলসের সেই কাজকে আড়াল করেছিলেন কার্টলি অ্যামব্রোজ়। তিনি বলেছিলেন, “যত ক্ষণ না সীমা অতিক্রম করছে তত ক্ষণ আমার সমস্যা নেই। ও কিন্তু সেলাম করেছে। সেটা তো সম্মান দেখাতে করা হয়। আমার মনে হয় ও সেটাই করেছে।”

আবার অনেক বোলার মুখে কিছু করার বদলে কাজে করে দেখিয়েছেন। উদাহরণ হিসাবে ইংল্যান্ডের জেমস অ্যান্ডারসনের কথা বলা যেতে পারে। ২০১০ সালে পার্‌থে অ্যাশেজ়ে তাঁকে স্লেজ করেছিলেন মিচেল জনসন। বলেছিলেন, “কী ব্যাপার, কোনও উইকেট নিতে পারছ না।” পরের বলেই অস্ট্রেলিয়ার রায়ান হ্যারিসকে বোল্ড করে মুখে আঙুল দিয়ে অ্যান্ডারসন বুঝিয়েছিলেন, বেশি কথা বলা ভাল নয়।

ডাকেট যেমন আকাশদীপকে কোনও জবাব দেননি, ঠিক তার উল্টো ছবি দেখিয়েছেন রুট। তিনি রেগে গিয়েছেন। দিনের খেলা শেষে প্রসিদ্ধ জানিয়েছেন, তিনি ভাবতে পারেননি রুট এতটা রেগে যাবেন। রেগে যাওয়ার মতো কিছু বলেননি তিনি। প্রসিদ্ধ বলেন, “আমি জানি না কেন রুট এতটা রেগে গেল। আমি বলেছিলাম, তোমাকে দেখে বেশ তরতাজা লাগছে। সেটা শুনে ও একের পর এক খারাপ কথা আমাকে বলল।” রুট তাঁকে ঠিক কী কী বলেছেন, তা অবশ্য খোলসা করেননি ভারতের পেসার।

ট্রেসকোথিক অবশ্য বিষয়টা নিয়ে বেশি ভাবতে নারাজ। তাঁর মতে, খেলার মাঠে অনেক সময় এই ধরনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু রুটকে তিনিও আগে এ ভাবে রেগে যেতে দেখেননি। ট্রেসকোথিক বলেন, “আমার মনে হয় ওরা কিছু বলেছিল। ওরা নিশ্চয়ই রুটকে রাগাতে চাইছিল। গত কয়েকটা ইনিংসে রুট খুব ভাল খেলেছে। সেটা ওরা দেখেছিল। কিন্তু সাধারণত রুট রাগে না। হেসে বিষয়টা উড়িয়ে দেয়। এ বার ও রাগল। হতে পারে ও এ ভাবেই বিষয়টা সামাল দিতে চেয়েছিল।”

cricket

আকাশদীপ যা করেছেন, তাতে কি তিনি শাস্তি পাবেন? ক্রিকেটের ২.১২ ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ক্রিকেটার ইচ্ছাকৃত ভাবে যদি অন্য ক্রিকেটারকে আঘাত করেন তা হলে তিনি শাস্তি পাবেন। তবে সে ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় দেখতে হয়। তিনি সত্যিই ইচ্ছাকৃত ভাবে আঘাত করেছেন কি না। তিনি যাঁকে আঘাত করেছেন তিনি আগে তাঁকে উত্তেজিত করেছিলেন কি না। যাঁকে আঘাত করা হয়েছে তাঁর কতটা চোট লেগেছে। সর্বোপরি, যাঁকে আঘাত করা হয়েছে তাঁর বক্তব্যও শোনা হয়।

আকাশদীপ গলা জড়িয়ে ধরলেও কোনও ভাবে ডাকেটকে আঘাত করেননি। উল্টে হাসিমুখে তাঁকে কথা বলতে দেখা গিয়েছে। ডাকেটও পাল্টা কিছু বলেননি। এখনও পর্যন্ত তিনি বা ইংল্যান্ড শিবির কোনও অভিযোগ করেননি। উল্টে ওভালে তৃতীয় দিন আকাশদীপ ব্যাট করার সময় আবার সেই ছবি দেখা যায়। এ বার ফিল্ডার ডাকেট তাঁর কাছে আসেন। দু’জনেই দু’জনের ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলেন। হয়তো আগের দিনের ঘটনা নিয়েই কিছু বলছিলেন তাঁরা। কিন্তু ডাকেটকে দেখে মনে হয়নি তিনি বিরক্ত। তাই এ ক্ষেত্রে হয়তো আকাশদীপের কোনও শাস্তি হবে না।

তবে ভবিষ্যতে আইসিসি-কে নিয়মে বদল করতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে আঘাত না করলেও বিদ্রুপের জন্য কারও গায়ে হাত দিলে শাস্তি হতে পারে। অন্তত আকাশদীপের কাজ সেই পথ খুলে দিল বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ামক সংস্থার সামনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.