কলকাতায় চাঁদিফাটা গরমে উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই ক্রিকেট! মৃত্যুতেও হুঁশ ফেরে না

প্রাণপণ ছুটেও বলের নাগাল পেলেন না তরুণ ক্রিকেটার। বাউন্ডারির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরে বেশ কিছু ক্ষণ কেটে গেলেও উঠলেন না। সতীর্থদের ডাকে সাড়া না মেলায় তৎপরতা শুরু হল মাঠে। জল ছিটিয়ে, বরফ ঘষে তাঁকে সুস্থ করার চেষ্টা হল। দ্রুত ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে যাওয়া হল এসএসকেএমে। রবিবার সকালে ময়দানে অনুষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিকেট ম্যাচের এই ঘটনা বর্ণনা করে এক তরুণ ক্রিকেটার বললেন, ‘‘আর একটু দেরি হলেই কিছু করার থাকত না। চিকিৎসকেরা জানালেন, গরমে কাহিল হয়ে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়েছিল আমাদের ওই বন্ধু।’’

এপ্রিলের মাঝামাঝি পুড়ছে শহর কলকাতা। যে কারণে দিনভর হাঁসফাঁস করছেন মানুষ। আবহাওয়া দফতর থেকে জারি করা হয়েছে গরমের সতর্কতা। বলা হয়েছে, উত্তর-পশ্চিমের শুষ্ক বাতাস ঢুকে আরও এক-দুই ডিগ্রি গরম বাড়াতে পারে। গরমের এমন তীব্র দাবদাহের মধ্যেও ময়দান এবং শহরের একাধিক মাঠে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলির ক্রিকেটের আসর বসছে। দুপুরের রোদে বিভিন্ন ছোট-বড় ক্লাবের প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন শিবির যেমন চলছে, তেমনই হচ্ছে সিএবি-র নিজস্ব প্রতিযোগিতা। অথচ এই গরমে খেলা চালিয়ে যাওয়া তো দূর, বেলা ১২টার পরে রাস্তায় কয়েক পা হাঁটাও কঠিন।

ক্রিকেটারদের অভিযোগ, গরমে খেলতে বা অনুশীলন করতে গিয়ে কেউ অসুস্থ হলে তাঁরচিকিৎসার ন্যূনতম ব্যবস্থাও থাকে না। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শমেলে না। শুধুমাত্র ঠান্ডা জল আর বরফের ভরসায় চলে। ইডেন গার্ডেন্স লাগোয়া ময়দানে কেউ অসুস্থ হলে তবু সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটের সাহায্য মেলে। সিএবি-র অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু, শহরের অন্য মাঠে সেইসুযোগ নেই।

গত দু’বছরে গরমেই খেলা চলাকালীন মৃত্যু হয়েছে দুই উঠতি ক্রিকেটারের। ২০১৯ সালে উত্তর কলকাতার পাইকপাড়া মাঠে পাইকপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে অনুশীলন ম্যাচ খেলছিলেন বছর একুশের অনিকেত শর্মা। রান নিতে গিয়ে হঠাৎই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন অনিকেত। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করাহয়। জানানো হয়, হৃদ্‌যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই মৃত্যু। একই ভাবে মৃত্যু হয়েছিল সিএবি-র দ্বিতীয় ডিভিশন ক্লাব বালিগঞ্জস্পোর্টিংয়ের ক্রিকেটার, একবালপুরের সোনু যাদবের। বাটার মাঠেখেলছিলেন সোনু। ব্যাটিং করে আসার পর অজ্ঞান হয়ে পড়েন। মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরানোর পরে ফের সংজ্ঞা হারান সোনু। তাঁকে সিএবি মেডিক্যাল ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁকে এসএসকেএমে রেফার করা হয়। কিন্তু, বাঁচানো যায়নি।

রবিবার ময়দানে অনুশীলনের মধ্যে এক ক্রিকেটার বললেন, ‘‘গরমে আইপিএল-ও চলছে, কিন্তুওই ধরনের টুর্নামেন্টে যে ব্যবস্থা থাকে, অন্যত্র সেটা কল্পনাও করা যায় না। সোনুর ঘটনার পরে জানাগিয়েছিল, সিএবি-র মেডিক্যাল ইউনিটে চোট-আঘাতের প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও জীবনদায়ী চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। তাই রেফার করতে হয়। কিন্তু হাসপাতালে নিয়ে যেতেই তো মূল্যবান সময় পেরিয়ে যায়!’’

অথচ হৃদ্‌রোগ চিকিৎসক বিশ্বকেশ মজুমদার বলছেন, ‘‘হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হলে প্রথম এক ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেইসময়ে ঠিকঠাক চিকিৎসা পেলে বিপদ এড়ানো যায়।’’ সেই সঙ্গে তাঁর পরামর্শ, গরমে শরীরে সোডিয়াম, পটাশিয়ামের মাত্রায়গোলমাল হয়। শরীর জলশূন্য (ডিহাইড্রেশন) হয়ে কাহিল হতে পারে। কিডনির অসুখ রয়েছেযাঁদের, তাঁদের হৃদ্‌যন্ত্রে প্রভাব পড়তে পারে। তাই গরমে খেলার আয়োজন থাকলে মাঠেই চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখতে হবে। খেলোয়াড়দের রুটিন চেক আপের মধ্যে থাকতে হবে। অন্তত ইসিজি, ইকো করিয়ে রাখা অবশ্যই দরকার।

সিএবি-র কর্তা নরেশ ওঝার দাবি, ‘‘এর মধ্যে যে ক’টা মাঠে আমাদের খেলা হয়েছে, সেখানে চিকিৎসক এবং অ্যাম্বুল্যান্স রাখা হয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পর্যবেক্ষক এবং আম্পায়ারদের এখন ‘সিপিআর’ (কার্ডিয়ো-পালমোনারি রিসাসিটেশন)-এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’’

কিন্তু, প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, বিবেকানন্দ পার্ক, পাইকপাড়া বা ময়দান জুড়ে সিএবি-র প্রতিযোগিতার বাইরে যে অনুশীলন কেন্দ্রগুলিপ্রবল গরমেও খেলা চালিয়ে যাচ্ছে, সেখানে কী হবে? ক্রিকেট প্রশিক্ষক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদেশ থেকে ফোনে বলেন, ‘‘আমাদেরকেন্দ্রে সকাল সাড়ে ন’টায় প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। আবার দুপুর তিনটে থেকে শুরু হচ্ছে। কলকাতায় ফিরে কিছু দিন গরমের জন্যপ্রশিক্ষণ বন্ধ রাখব।’’ আর এক প্রশিক্ষক শরদিন্দু মুখোপাধ্যায়ও জানালেন একই কথা।

বাংলার ক্রিকেট দলের বোলিং কোচ শিবশঙ্কর পালের আবার বক্তব্য, ‘‘আমরাও প্রবল গরমে খেলেছি। খেলোয়াড়দেরই নিজেদেরকে সুস্থ রাখতে হয়। খাওয়া ঠিক রেখে পর্যাপ্ত বিশ্রামই সুস্থ থাকার অন্যতম পথ।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.