(দ্বিতীয় পর্ব)
কমিউনিস্টদের সোভিয়েত রাশিয়া বা চীনের প্রতি আনুগত্য নতুন নয়। তাদের সোভিয়েত রাশিয়া বা চীন প্রীতি একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা কারণ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্কুরোদগম হয়েছে বিদেশের মাটিতেই আর বিদেশের অর্থেই তারা নিজেদের কলেবর বাড়িয়েছে।
ইংরেজরা বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে যখন তুরস্কের খলিফা পদটিকে অবলুপ্ত করল তখন ভারতের মুসলমানরা এই বিরুদ্ধে গর্জে উঠলো। আমরা জানি এর প্রতিবাদে খিলাফত আন্দোলন হয়েছিল যার সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার সংগ্রামের কোন যোগাযোগ ছিল না এটি ছিল শুধুমাত্র একটি উপাসনা পদ্ধতির উচ্চাশা পূরণের আন্দোলন। সেই সময়ে ভারতের মুসলমানরা খ্রিস্টান মতাবলম্বী ইংরেজদের শাসনে থাকা অনুচিত মনে করে স্বেচ্ছায় আফগানিস্তানে যেতে শুরু করে — এদের ‘মুহাজির’ বলে। উদ্দেশ্য আফগানিস্তানের মুসলমান শাসকের সহায়তায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা আর তুরস্কে গিয়ে খলিফা পদকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা। মুহাজীরদের এই দল দুই ভাগে ভাগ হয়ে একভাগ সত্যি সত্যি তুরস্কে চলে যায়। অন্য ভাগ পথে বাধা পেয়ে বর্তমান উজবেকিস্তানের তাসখন্দে ঘাঁটি গাড়ে। সেই সময় সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাবাধীন তাসখন্দে মুহাজিরদের থাকার ব্যবস্থা হয়। ‘সীমান্ত গান্ধী’ হিসেবে পরিচিত খান আব্দুল গাফফার খান ফিরে আসা মুহাজিরদের দলে ছিল।
মানবেন্দ্রনাথ রায়ের উদ্যোগে এই মুহাজিরদের দল ইসলামিক লক্ষ্য থেকে সরে এসে কমিউনিজমের আদর্শে নিজেদের ভবিষ্যৎ খুঁজে পায়। তাসখন্দের মাটিতে ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর ৭ জন সদস্য নিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বীজ বপন হয়।
কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং এ সিদ্ধান্ত হয় —
The Indian Communist Party adopts the principles proclaimed by the third International and undertake to work out a programme adopted to the indian condition.” (minutes of the meeting)
রায় একটি চিঠিতে এ খবর তুর্কিস্থানের কমিউনিস্ট পার্টি’র কেন্দ্রীয় কমিটিকেও জানিয়ে দেন। তাঁর স্বাক্ষরিত চিঠিতেই রয়েছে: “This is to state that the communist party of India has been organized here. It is werking in conformity with the principles of the third International under the political guidance of the Turkestan Bureau of the Commintern.”
অর্থাৎ প্রথম থেকেই এটা স্পষ্ট যে সোভিয়েত রাশিয়া যেমন করে নাচাত ভারতের কমিউনিস্টরা ঠিক সেভাবেই নাচতো। আর এখন ভারতের স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাদের চরিত্রের কোন পরিবর্তন হয়নি শুধুমাত্র সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর আনুগত্য সোভিয়েত রাশিয়া থেকে চীনের দিকে সরে এসেছে।
মুহাজিরদের পার্টি গঠনের ব্যাপারে যত উৎসাহই থাক না কেন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম ৭ জন সভ্যের মধ্যে কিন্তু একজনও মুহাজির ছিলেন না।
অবশ্য ১৫ই ডিসেম্বর পার্টি’র পরবর্তী সভায় মুহাজিরদের মধ্যে থেকে আবদুল কাদির সেহরাই, মাসুদ আলিশাহ কাজী ও আকবর শাহ কে ক্যান্ডিডেট মেম্বার হিসেবে দলে গ্রহণ করা হয়। পার্টির এ জাতীয় সভ্যদের তিন মাস on probation মানে শিক্ষানবিস হিসেবে থাকতে হতো।
পার্টির প্রথম সাত জন সদস্যের মধ্যে আর একজন বাঙালি ছিলেন। নাম অবনী মুখার্জি।
এই অবনী মুখার্জী জাপানে রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখাও করেছিলেন অর্থাৎ প্রথমদিকে এরা জাতীয়তাবাদী ছিল ।ভারতীয়রা একটি জাতি যারা ইংরেজ জাতির কাছে পরাধীন আর তাই ভারতীয়দের ইংরেজদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে হবে — এই মতবাদ থেকে দূরে সরে মানবেন্দ্রনাথ রায় অবনী মুখার্জীরা মার্ক্সবাদকে শিরোধার্য করে ‘জাতি’র ধারণা থেকে সরে এসে ভারতের শ্রমিক আর ইংরেজদের শ্রমিক কে এক গোষ্ঠীভুক্ত করে ফেললেন। মার্ক্সবাদ এর দৃষ্টিতে রাষ্ট্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার একটা কৌশল ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ক্ষুদিরাম, কানাইলাল , ধিংড়া, উল্লাসকর ‘বন্দেমাতরম’ মন্ত্র কে কণ্ঠস্থ করেই ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছিল অর্থাৎ তারা এই দেশকে ‘মা’ হিসেবে এবং এই দেশের সমস্ত সন্তানকে একই মায়ের সন্তান হিসেবে দেখেই স্বাধীনতা সংগ্রামে নেমেছিল। একদিকে রাষ্ট্রকে ‘মা’ হিসেবে দেখা আর অন্যদিকে রাষ্ট্রকে শুধুমাত্র পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটা কৃত্রিম কাঠামো হিসেবে দেখা-এই দুইয়ের মধ্যে বিস্তর ফারাক।
ফল হল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুর্বল হতে থাকলো — একদিকে রাষ্ট্রকে মা হিসেবে পূজা করা জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী আর অন্যদিকে মার্ক্সবাদে দীক্ষিত গোষ্ঠী।
এই মার্ক্সবাদীদের কাছে সোভিয়েত রাশিয়ার অনুকরণে বিপ্লব সংঘটিত করাই উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ায় কোন বিদেশি শাসক কে উৎখাত করা হয়নি , তারা স্বদেশী জারের বিরুদ্ধে একটি স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাকে খাড়া করেছিল। তাই সোভিয়েত রাশিয়ার বলশেভিকদের বিদেশী শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না।
রাসবিহারী জাপানে, অরবিন্দ ঘোষ পন্ডিচেরিতে সাধনার জন্য চলে গিয়েছেন, বাঘা যতীন প্রাণ বলিদান দিয়েছেন , উল্লাসকর দত্ত- বারীন ঘোষ আন্দামানের জেলে।
এই সময় ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মার্ক্সবাদীদের অনুপ্রবেশ ইংরেজদেরকে সুবিধা করে দিল। তারা দেখল ভারতবাসী এক হয়ে লড়বে কি স্বাধীনতা সংগ্রাম মতাদর্শের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে গেল। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল এই মার্ক্সবাদী তথা কমিউনিস্টদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসবে কিন্তু একই সাথে এদের খুব বেশি বাড়তেও দেওয়া যাবে না।
এর সাথেই কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের ব্রেন ওয়াজ করে তাদের মগজে মাছ বা ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় কোন খামতি রাখলো না। অনেকেই বিভ্রান্ত হয়ে মার্ক্সবাদকেই শ্রেষ্ঠ মতাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করলো আবার অনেকেই মার্ক্সবাদের বিষ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে সমর্থ হল — এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য দুইবার কালাপানি সাজা ভোগ করা , রাসবিহারী বসুর সহযোগী শচীন্দ্রনাথ সান্যাল।
(চলবে)
পিন্টু সান্যাল
