এক সপ্তাহ কেটে গিয়েছে। এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি মেট্রোর ব্লু লাইনের পরিষেবা। একে তো ভিড় কমেনি। সব লাইন মিলিয়ে যেখানে প্রতি দিন প্রায় ৮ লাখ যাত্রী যাতায়াত করেছেন, সেখানে শুধু ব্লু লাইনেই (দক্ষিণেশ্বর থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম) যাত্রীর সংখ্যা ছিল ছ’লাখের কাছাকাছি। সেই ভিড় কোনওক্রমে সামলে দিতে পারলেও সময়ানুবর্তিতায় গোল্লা পাবেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ!
কোনও না কোনও কারণে প্রায় প্রতিটি মেট্রো দেরিতে চলেছে। কখনও কখনও দরজা বন্ধ হয়নি, কখনও কোনও অজানা কারণ। কিন্তু ব্লু লাইনের মেট্রো নিয়ম করে ‘বেসময়ে’ চলছে। কখনও দেরি তিন মিনিট। কখনও তিরিশ মিনিট! কর্তৃপক্ষের অবশ্য যথারীতি দাবি, মেট্রো পরিষেবা ‘খুবই মসৃণ’ হয়েছে আগের চেয়ে। বেশ কয়েক দিন বিবৃতি দিয়েও সে কথা জানিয়েওছে মেট্রো। কিন্তু যাত্রীদের বড় অংশের অভিযোগ, সময়ে না-চালাতে পারলে কিসের মসৃণতা! সবচেয়ে বড় কথা, যাত্রীদের উদ্দেশে ‘পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে’ মেট্রো চলাচল সংক্রান্ত কোনও রকমের কোনও ঘোষণা করাও বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
এক সপ্তাহ আগে আনন্দবাজার ডট কম খতিয়ে দেখেছিল, ব্লু লাইনে মেট্রো পরিষেবা কেমন চলছে। ভিড় কেমন, কতটা সময় মেনে চলছে মেট্রো। পরিষেবার সেই হাল এক সপ্তাহ পরে ফের এক বার দেখল আনন্দবাজার ডট কম।

১ সেপ্টেম্বর সোমবার ব্লু লাইনে সারা দিনে ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৮৯৪ জন যাত্রী যাতায়াত করেছিলেন। সব লাইন অর্থাৎ ব্লু, গ্রিন (সল্টলেক সেক্টর ফাইভ-হাওড়া ময়দান), ইয়েলো (নোয়াপাড়া- জয়হিন্দ বিমানবন্দর), অরেঞ্জ (কবি সুভাষ-বেলেঘাটা) এবং পার্পল (জোকা-মাঝেরহাট) মিলিয়ে যাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ৭ হাজার ৩০। সেই দিনই রাত ৯টা ৩৩ মিনিটে ব্লু লাইনের চাঁদনি চক থেকে মেট্রো ধরেছিলেন পাটুলির বাসিন্দা দীনবন্ধু দত্ত। ট্রেন আসার নির্দিষ্ট সময় ছিল ৯টা ২৯ মিনিট। চার মিনিট দেরিতে আসা মেট্রো ১৭ মিনিটে পৌঁছে দিয়েছিল মহানায়ক উত্তমকুমারে (টালিগঞ্জ)। তার পরে বেশ কিছু ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ট্রেন ছাড়লেও কবি নজরুলের আগে দাঁড়িয়ে পড়ে। শেষমেশ চাঁদনি চক থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম পর্যন্ত ২৯ মিনিটের সফর শেষ হয়েছিল ১ ঘণ্টা ১৬ মিনিটে। ঘটনাচক্রে, সে দিন রাতেই মেট্রো বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘আজ মেট্রো পরিষেবা খুবই মসৃণ ভাবে চলেছে’।
তার ঠিক পর দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার সেই চাঁদনি থেকেই রাত ৮টা ৪৭ মিনিটে আবার মেট্রোয় উঠেছিলেন দীনবন্ধু। শহিদ ক্ষুদিরামে পৌঁছন রাত ৯টা ৫৫ মিনিটে। অর্থাৎ ২৯ মিনিটের সফর সেদিন নিয়েছিল ১ ঘণ্টা ৮ মিনিট! তার পরের দিন বুধবারেও দীনবন্ধু একই পথ গিয়েছেন। চাঁদনি থেকে শহিদ ক্ষুদিরামে পৌঁছেছেন ১৩ মিনিট দেরিতে। বৃহস্পতিবার ২৯ মিনিট দেরি। মঙ্গল, বুধ এবং বৃহস্পতি তিন দিন ব্লু লাইনে যাত্রী হয়েছে যথাক্রমে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ৪৪৬, ৫ লাখ ৩১ হাজার ৩২৯ এবং ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৫২৬। অর্থাৎ, ‘হাজার হাজার ডক্টর হাজরা’র মতো ‘লক্ষ লক্ষ দীনবন্ধু’!
শুক্রবার ছিল বিশ্ব নবিদিবসের ছুটি। মানিকতলার বিশু মজুমদারের যাওয়ার কথা ছিল রবীন্দ্র সরোবরে। সকাল ১০টা ৫১ মিনিটে গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে তিনি দেখেন ট্রেন দাঁড়িয়ে প্ল্যাটফর্মে। মোটামুটি ভিড়। কিন্তু পিছন দিকে মোটরম্যানের কেবিন লাগোয়া প্রথম কামরার প্রথম দরজা বন্ধ হচ্ছে না। তিন জন মেট্রোকর্মী গলদঘর্ম হয়েও কিছু করতে পারছেন না। মিনিট ১৫ পর দরজা কোনওমতে বন্ধ হল। কিন্তু তত ক্ষণে তিনটি মেট্রোর সময় পেরিয়ে গিয়েছে। বিশু ওই মেট্রোয় ওঠেননি। ওই মেট্রে ছাড়ার তিন মিনিটের মাথায় আসা ট্রেনটিরও একটি দরজা সময়মতো বন্ধ হয়নি। দরজা বন্ধ হওয়ার সময় দু’জন মেট্রোয় ওঠার চেষ্টা করাতেই বিভ্রাট। তবে দ্বিতীয় বার দরজা বন্ধ হয়। বিশু গন্তব্যে পৌঁছন প্রায় ২৩ মিনিট দেরিতে। মেট্রো কর্তৃপক্ষ কী বলছেন? তাঁরা বলছেন, গিরিশ পার্কে দরজা বন্ধ হওয়া জনিত একটা সমস্যা হয়েছিল ঠিকই। তবে ১৫ মিনিট নয়, সাড়ে ৭ মিনিটের একটু বেশি। সকাল ১০টা ৫২ মিনিট থেকে বেলা ১১টা।
রাসবিহারীর জয়শ্রী সেন রোজ ধর্মতলার অফিসে আসেন ব্লু লাইনের মেট্রোয়। মেট্রোরই এক কর্মী তাঁকে বলেছিলেন, ব্যস্ত সময়ে মেট্রো পাঁচ মিনিট পর পর আসবে। কিন্তু বুধবার কালীঘাটে এসে অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর জানতে পারেন, ১ সেপ্টেম্বর থেকে মেট্রোর পরিষেবা আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছে। ২৮৪টি পরিষেবার বদলে এখন ব্লু লাইনে চলছে ২৬২টি পরিষেবা। তাঁর কথায়, ‘‘এই সময়সারণি জানতে আমার কালঘাম ছুটে গিয়েছে। মেট্রোর ওয়েবসাইটে আছে বটে। কিন্তু তা খুঁজে বার করা দুষ্কর! আগে প্ল্যাটফর্মে আরপিএফের কর্মীরা থাকতেন। এখন তাঁদেরও দেখতে পাই না। এক বার টিকিট পাঞ্চ করে প্ল্যাটফর্মের ভিতরে চলে গেলে মেট্রোর কাউকে পাওয়া যায় না!’’
মেট্রো কর্তৃপক্ষের অবশ্য এখানেও যুক্তি আছে— ‘ব্যতিক্রম কখনও উদাহরণ হতে পারে না’। দীনবন্ধু এবং বিশুর অভিজ্ঞতা নিতান্তই ঘটনাচক্র। গত এক সপ্তাহে তাঁরা প্রায় সবটাই সামলে নিয়েছেন। এক কর্তার কথায়, ‘‘একটা বিষয় সকলেই ভুলে যাচ্ছেন। ব্লু লাইনের একটা প্রান্তিক স্টেশন সম্পূর্ণ বন্ধ। তার কিছু প্রভাব তো পড়বেই। তবে এক সপ্তাহ আগে যা ছিল, তার থেকে অনেক অনেক ভাল হয়েছে পরিষেবা। মসৃণ হয়েছে। যাত্রী সংখ্যা তো কমেনি। কিন্তু আমরা বেশ কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে। সেই পদক্ষেপগুলো কাজ করছে।’’ জয়শ্রীর অভিযোগ প্রসঙ্গে ওই কর্তার জবাব, ‘‘আরপিএফের কর্মীদের অন্যত্র মেট্রোর কাজেই ব্যবহার করা হয়। প্ল্যাটফর্মে আর তেমন ভাবে রাখা হচ্ছে না। তবে দরকারে যাত্রীরা সব সময়েই মেট্রো কর্মীদের সাহায্য পান। আর সময় তো পাল্টেছে ১ সেপ্টেম্বর থেকে। এটা তো ঘোষণাও করা হয়েছিল।’’
‘প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা’ প্রসঙ্গে আসা যাক। ইয়েলো লাইনে মেট্রোপথের পরিষেবা সম্পূর্ণ আলাদা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মেট্রো কর্তৃপক্ষ। পৃথক রেক ব্যবহার করে ব্লু এবং ইয়েলো লাইনে পরিষেবা দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে দৈনিক পরিষেবা শুরুর আগে নোয়াপাড়া এবং মহানায়ক উত্তমকুমার স্টেশনে তিনটি করে রেক মজুত রাখা হচ্ছে। যাতে রেকের অভাবে পরিষেবা বিলম্বিত না হয়। পাশাপাশি, টালিগঞ্জ কারশেড নতুন করে চালু করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার কাজ চলছে। একই সঙ্গে শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে ট্রেন ডাউন লাইন থেকে আপ লাইনে আনার (রিভার্সাল) কাজ চলছে। ইঞ্জিনিয়ারিং অংশের কাজ শেষ। কিন্তু সেটি কার্যকর হতে সময় লাগবে। রিভার্সালের কাজ শেষে শহিদ ক্ষুদিরাম থেকেই ট্রেন লাইন বদলাতে পারলে সময় অনেকটাই বাঁচবে বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। তখন আবার মেট্রো সময়ে চালানো সম্ভব হবে।
অসমর্থিত সূত্রের খবর, শনিবার ৬ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা থেকে রবিবার ৭ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত টালিগঞ্জ থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম পর্যন্ত পরিষেবা সম্পূর্ণ বন্ধ রেখে সংস্কারের কাজ হতে পারে। তবে অন্য এক সূত্রের বক্তব্য, সেই পরিকল্পনা আপাতত বাতিল হয়েছে। শুক্রবার রাতে মেট্রো আনুষ্ঠানিক ভাবে এ বিষয়ে জানিয়েছে, রবিবার ব্লু লাইনে কোনও ট্র্যাফিক ব্লক করে কাজ হবে না। ফলে টালিগঞ্জ থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম পর্যন্ত অন্যান্য রবিবারের মতোই মেট্রো পাওয়া যাবে।
যাত্রীদের প্রশ্ন, কেন এই সমস্ত পরিষেবাভিত্তিক কাজ শেষ না করে ব্লু লাইনের সঙ্গে ইয়েলো এবং গ্রিন লাইন জুড়ে দেওয়া হল? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ২২ অগস্ট যখন মেট্রোর তিনটি নতুন যাত্রাপথের উদ্বোধন করেন, তার অনেক আগেই কবি সুভাষ স্টেশনে ফাটল দেখা দিয়েছিল এবং পরিষেবায় তার প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল। তার মধ্যে নতুন পরিষেবা জুড়ে না-দিলে এত ভিড় হত না। কিছুটা হলেও সময়সূচি সামাল দেওয়া যেত।
মেট্রো কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছেন, সব ‘মসৃণ’। বাকিটা ‘ব্যতিক্রম’। এবং ‘ঘটনাচক্র’। যাত্রীরা বুঝছেন, ঘটনা নয়, আসলে দুর্ঘটনাচক্র!