প্রকাশ্যে কোনও ঘোষণা নেই। কিন্তু ভোটের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল পশ্চিমবঙ্গ বিজেপিতে। আরএসএস আয়োজিত ‘সমন্বয় বর্গ’ থেকে ফিরেই বিজেপির রাজ্য নেতৃত্ব এমন কিছু নির্দেশ জারি করেছেন, যাতে ভোটের প্রস্তুতির ছাপ স্পষ্ট। ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ ভাবে, ভোটের জন্য এখনও এক বছর হাতে রয়েছে ভেবে বিজেপি এগোচ্ছে না। দলীয় সূত্রের খবর, বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসতে পারে ভেবে নিয়ে বিজেপি প্রস্তুতি শুরু করেছে। শীঘ্রই মুরলীধর সেন লেনের পুরনো বিজেপি দফতরে ব্যস্ততা বাড়তে চলেছে।
ওয়েবসাইটে দলের রাজ্য দফতরের ঠিকানা এখনও ‘৬, মুরলীধর সেন লেন, কলকাতা ৭০০০৭৩’। কিন্তু কয়েক বছর আগেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিজেপি নেতৃত্ব ‘জিএন-২৭, সেক্টর ফাইভ, সল্টলেক সিটি’ ঠিকানায় স্থানান্তরিত হয়েছেন। রাজ্য বিজেপির পদাধিকারীরা সেখানেই বসেন। কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষকদের দফতরও সেখানেই। কিন্তু ভোটের সময় দলের রাজ্য দফতরের পাশাপাশি বিজেপি সমান্তরাল কার্যালয়ও খোলে। সেখান থেকেই মূলত নির্বাচনী অভিযান পরিচালিত হয়। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন, সে বছরের শেষে কলকাতা পুরসভার নির্বাচন, দু’টি ভোটই পরিচালিত হয়েছিল হেস্টিংস মোড়ের বহুতল দফতর থেকে। আবার ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত বা ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্য বিজেপির ‘ওয়ার রুম’ হয়ে উঠেছিল সেক্টর ফাইভের দফতরই। এ বার পরিস্থিতি উল্টো। সেক্টর ফাইভের দফতর থেকে মূল সাংগঠনিক কাজ চলছে। তাই নির্বাচনী কাজে মুরলীধর লেনকে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। দ্রুত সেই বাড়ি ঢেলে সাজার নির্দেশ দিয়েছেন সংগঠন সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী।
গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির এই পুরনো রাজ্য দফতরের উপরের তলায় ‘কল সেন্টার’ খোলা হয়েছিল। তাদের উপরে গুচ্ছ কাজের ভার দিয়েছিল বিজেপি। কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্পগুলি রাজ্যের কোথায় কতটা রূপায়িত হয়েছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ছকে দেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচি কোথায় কতটা পালিত হচ্ছে, কোন বিষয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া কী রকম— রাজ্যের প্রতিটি এলাকায় ফোন করে সেই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে রিপোর্ট পাঠাত তারা। দলীয় নির্দেশ বা কোনও বার্তা দ্রুত প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার কাজও এই সব কল সেন্টার থেকেই হত। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোট মিটে যাওয়ার পরে বিজেপির ওই সব কল সেন্টার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সূত্রের খবর, শীঘ্রই সেই কল সেন্টার আবার খুলতে চলেছে।
কল সেন্টার চালু করতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। কারণ, ডেস্ক, চেয়ার, কিউবিক্ল, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার বিন্যাস-সহ বিভিন্ন পরিকাঠামো আছে। কিন্তু গোল বাধিয়েছে দফতরের ‘প্রাচীনত্ব’। ওই বাড়ি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ) সমসাময়িক ব্যবসায়ী মতিলাল শীলের পারিবারিক সম্পত্তি। এখনও শীল পরিবারের হাতেই বাড়ির মালিকানা। রক্ষণাবেক্ষণ বিজেপিই করে। কিন্তু অত পুরনো বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ এমনিতেই কঠিন। উপরন্তু সংগঠনের ভরকেন্দ্র সেক্টর ফাইভে সরে যাওয়ায় গত কয়েক বছরে অযত্ন সইতে হয়েছে মুরলীধর সেন লেনকে। অতএব কোথাও জল-চোঁয়ানো ছাদ, কোথাও ত্রিপল ঢাকা টিন, কোথাও শ্যাওলা ধরা স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়াল। এই পরিস্থিতি বহাল থাকলে ওই বাড়িতে কল সেন্টার তো চালানো যাবেই না, সেই বাড়িকে নির্বাচন ব্যবস্থাপনার মূল কেন্দ্র করে তোলাও কঠিন হবে।
বিজেপির ‘ভবন নির্মাণ’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত পদাধিকারীকে কয়েক দিন আগেই সংগঠন সম্পাদক অমিতাভ ফোন করেছিলেনন। অবিলম্বে জল পড়া বন্ধের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। কল সেন্টারগুলি যে হেতু সরাসরি দিল্লিকে ‘রিপোর্ট’ করে, সে হেতু যে কোনও অব্যবস্থায় নালিশ সরাসরি দিল্লিতেই পৌঁছে যায়। সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে চান না রাজ্য নেতৃত্ব।
কিন্তু নির্বাচনের এক বছর আগে বঙ্গ বিজেপি এত তৎপর আগে কখনও হয়েছে? সঙ্ঘের সমন্বয় বর্গে তেমন কোনও বার্তা দেওয়া হয়েছে? রাজ্য বিজেপির প্রধান মুখপাত্র তথা সাংসদ শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, ‘‘সমন্বয় বর্গের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।’’ তাঁর কথায়, ‘‘বিজেপি ৩৬৫ দিনের দল। বিজেপির প্রস্তুতি সারা বছর ধরেই চলে। এক বছর পরে নির্বাচন নিঃসন্দেহে তৎপরতার অন্যতম কারণ। তবে নির্বাচন এগিয়েও আসতে পারে। এই সরকার ২০২৬ পর্যন্ত চলবে কি না বলা যায় না। সব দিক চিন্তাভাবনা করেই প্রস্তুতি শুরু করা হচ্ছে।’’