আদিবাসীদের অধিকারের জন্য লড়েছিলেন বিরসা

কিশোর বিরসা মুন্ডা জনজাতিদের নিজস্ব অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি বড়গাঁওয়ে বৈষ্ণব ধর্মগুরু আনন্দ পাঁড়ের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হন। রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে পবিত্র পৈতা ধারণ করেন এবং তুলসী গাছে পূজার্চনা করে নিরামিষাশী হন।

৫ নভেম্বর জিনজাতি গৌরব | দিবস। গত বছর থেকে এই দিনটি অর্থাৎ বিরসা মুন্ডার জন্মদিনটিকে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার জনজাতি গৌরব দিবস’ হিসাবে পালন করছে।

১৮৭৫ সালের ১৫ নভেম্বর ঝাড়খণ্ডে ‘আদিবাসী ভগবান বিরসা মুন্ডা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং সমাজ সংস্কারক রূপে মাত্র ২৫ বছর বয়সে শহিদের মৃত্যুবরণ করে অমর হয়ে আছেন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অত্যাচারী ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে জনজাতি সমাজকে সঙ্গে নিয়ে তিনি। লড়াই করে মুন্ডা বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিরসা মুন্ডার বীরত্বপূর্ণ কার্যকলাপ এবং মহৎ কাজ তাঁকে অসংখ্য অনুগামীর কাছে মহান তথা ধরতি আবা অর্থাৎ ভগবান হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।

১৮৯৪ সালে ব্রিটিশ সরকার অরণ্য আইন প্রবর্তন করে ভারতের বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিলে আদিবাসীদের হাজার হাজার বছর ধরে জঙ্গলের ওপরে যে অধিকার ছিল, তা কেড়ে নেওয়া হয়। সে সময় ব্রিটিশরা ছোটনাগপুর ও পূর্ব ভারতের বেশ কিছু অঞ্চলে জনজাতিদের কৃষিব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করে একটি সামন্ততান্ত্রিক জমিদারি প্রথা চালু করেছিলেন। এছাড়াও বনবাসীদের শোষণ, তাঁদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক লোকাচারকে অপমান এবং তার ওপর হস্তক্ষেপ করে মিশনারি ক্রিয়াকলাপ নিরবচ্ছিন্ন ভাবে ব্রিটিশ রাজের সক্রিয় সমর্থনে কাজ করতে থাকে। সে সময়ই কিশোর বিরসা জনজাতিদের নিজস্ব অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে এই অঞ্চলে আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি বড়গাঁওয়ে বৈষ্ণব ধর্মগুরু আনন্দ পাঁড়ের কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে হিন্দু ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হন। রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়ন করে পবিত্র পৈতা ধারণ করেন। এবং তুলসী গাছে পূজার্চনা করে নিরামিষাশী হন।

ছোটনাগপুরের সংরক্ষিত বনাঞ্চল ব্রিটিশরা দখল করার উদ্যোগ নিতেই মুন্ডার নেতৃত্বে গেরিলা বাহিনী তির-ধনুক ও অন্যান্য অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ১৮৯৫ সালে ব্রিটিশ পুলিশ বিরসাকে বন্দি করে দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়। ছাড়া পাওয়া মাত্রই ফের তিনি ব্রিটিশ বিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। ১৮৯৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাঁচি ও গুপ্তি শহরে বিরসা বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণে বেশ কিছু পুলিশ-সহ নিহত হন অনেক মানুষ। আক্রমণের জবাবে ব্রিটিশ সরকার ১৫০ জনের সেনাবাহিনী নিয়ে পালটা আক্রমণ করে ডোম্বারি পাহাড়ে। নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৪০০ জন আদিবাসীকে। কিন্তু বিরসা মুন্ডাকে ধরতে না পেরে তাঁর মাথার দাম ৫০০ টাকা ঘোষণা করে। ১৯০০ সালে চত্র-ধরপুরে বনের মধ্যে ঘুমন্ত অবস্থায় নিরস্ত্র বিরসাকে বন্দি করা হয়। অবশ্য এর পিছনে ছিল নিজেদের অন্তর্ঘাত। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আদেশ দেয়। কিন্তু বন্দি অবস্থায় জেলে বিষ প্রয়োগ করায়, কারও কারও মতে, কলেরা হয়ে বিরসা মুন্ডা মাত্র ২৫ বছর বয়সে শহিদের মৃত্যুবরণ করেন।

কর্ণাটক, মহীশুর ও কোদাও জেলার আদিবাসীরা আজও ধুমধাম করে বিরসার জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে থাকেন। এছাড়া বিরসা মুন্ডা বিমানবন্দর, বিরসা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি, বিরসা মুন্ডা সেন্টার ফর ট্রাইবাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগ চালু হয়েছে আদিবাসী জীবন নিয়ে গবেষণার জন্য। ২০০৪ সালে বিরসার জীবন নিয়ে উলগুলান এক ক্রান্তি নামে একটি হিন্দি সিনেমা প্রদর্শিত হয়। আবার এই মহান জনজাতিকে নিয়ে মহেশ্বেতা দেবী একটি উপন্যাস লিখেছেন, যার নাম ‘অরণ্যের অধিকার”। এই উপন্যাসের জন্য তিনি সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ভারতীয় পার্লামেন্ট মিউজিয়ামে একমাত্র আদিবাসী নেতা হিসাবে বিরসার ছবি সযত্নে রাখা আছে। ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা স্মরণ রেখেই ২০০০ সালে তাঁর জন্মদিনে অর্থাৎ ১৫ নভেম্বর ঝাড়খণ্ড রাজ্য গঠন করা হয়। ভারতের জনজাতি সমাজের অগ্রদূত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিরসা মুন্ডার জন্মবার্ষিকীতে তাঁকে সশ্রদ্ধ অভিবাদন জানাই।

তরুণকুমার পণ্ডিত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.