বিধান রায়-জ্যোতি বসু-মমতা-মোদী- গীতা পাঠ! বিবর্তনের হাত ধরে অতীতের লাল ব্রিগেড আজ গেরুয়া হয়ে উঠেছিল

 ব্রিগেড মানে স্লোগান, ব্রিগেড মানে আগুন ঝরা ভাষণ, ব্রিগেড মানে লক্ষ মাথার ভিড়। সেই ব্রিগেডে আজ স্লোগানের বদলে ছিল শঙ্খধ্বনি। যেখানে লাল পতাকার দোলা দেখতে অভ্যস্ত ছিল রাজ্যবাসী সেখানে হল লক্ষ কণ্ঠে গীতা পাঠ। আজকের ব্রিগেড ছিল একেবারেই অন্য ব্রিগেড।

সকাল থেকেই আজ ভিড় দেখা গেছে হাওড়া শিয়ালদায়। জেলা থেকে যাত্রী বোঝাই বাসের দল এসেছে ব্রিগেডের ময়দানে। কিন্তু না, কোনো রাজনৈতিক স্লোগান বা প্রতিবাদ করতে নয়। যে ব্রিগেড একসময় জ্যোতি বসু, বিমান বসু, বুদ্ধ ভট্টাচার্যের মত বাম নেতাদের আগুন ঝরানো ভাষণে কেঁপে উঠতো, সেই ব্রিগেড রবিবারের সকালে মুখরিত হলো শঙ্খ ধ্বনিতে। বেদ পাঠ, গীতা পাঠে এক অন্য রূপ ধারণ করেছিল ব্রিগেড ময়দান। যে ব্রিগেড ময়দানে রাজনৈতিক কর্মীরা মিছিল করে ঢোকে, সেখানে আজ মিছিল করে ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে ঢুকলেন হাজার হাজার সাধু সন্তরা। লাল ব্রিগেড যেনো এক লহমায় গেরুয়া হয়ে উঠেছিল।

গেরুয়া শিবিরের এই কর্মসূচি নিয়ে বিস্তর কাটা ছেঁড়া চলছে রাজনৈতিক পরিসরে। বামেরা বলেছেন, ধর্মকে বর্ম করে অপকর্ম চলছে। খোঁচা দিতে ছাড়েনি তৃণমূলও।

এই ব্রিগেডে এক সময় পা পড়েছে দেশ বিদেশের তাবড় নেতাদের। ইতিহাস বলছে, স্বাধীনতা পরবর্তী ভারত বারবারই বিশাল বিশাল রাজনৈতিক কর্মযজ্ঞের সাক্ষী থেকেছে এই ব্রিগেড। ১৯৫৫ সালের ব্রিগেডে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সোভিয়েত রাশিয়ার তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান নিকিতা ক্রশ্চেভ। এসেছিলেন রাশিয়ার আরো এক রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই বুলগানিন। তখন দেশে কংগ্রেসের শাসনকাল। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জহরলাল নেহেরু। তারাও এসেছেন ব্রিগেড ময়দানে।

১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঝড়ও ব্রিগেডের বুকের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছিল। ব্রিগেডে সাড়া জাগানো বক্তৃতা দিতে দেখা গিয়েছিল বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে। সেদিন তাঁর সঙ্গী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।

বামফ্রন্টের জমানায় বার বার গেরুয়াকে মুছে দিয়ে বাম নেতারা সমাজ বদলের ডাক দিয়েছেন, এই ব্রিগেড ময়দান থেকে। আজ সেই ব্রিগেড দখল করলো গেরুয়া।

এই ব্রিগেড ময়দান থেকে বামেদের মৃত্যু ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯২–এ তৃণমূলের জন্ম হয়নি, সেই সময় মমতা ছিলেন কংগ্রেসে, বামেদের বিরুদ্ধে বিরাট সমাবেশ হয়েছিল এই ব্রিগেডে। আবার মমতার পাল্টা তড়িঘড়ি সভা করেছিল সিপিএম। ২০০৬ সালের সপ্তম বামফ্রন্ট সরকার গড়ার লক্ষ্য নিয়ে ব্রিগেড সমাবেশ করেছিল বামেরা। শেষবার দেখা গিয়েছিল জ্যোতি বসুকে। ১৯৯২ সালের পর আবার ২০১১ সালের ব্রিগেডে পা পড়েছিল মমতার। একুশে জুলাই শহিদ দিবস পালন হয়েছিল ব্রিগেডের মাঠে।

একুশের বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে বাম, বিজেপি একের পর এক সমাবেশ হয়েছে এই ব্রিগেড ময়দানে। এখানে এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেই বছরেই ব্রিগেড সমাবেশের ডাক দিয়েছিল বামেরাও। ৭ জানুয়ারি ব্রিগেডে সমাবেশ করেছিল সিপিআইএমের যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই। কিন্তু এবার সেখানে হলো আরতি, হরিনাম সংকীর্তন, গীতা পাঠ। হিন্দুদের এক থাকার বার্তা দিলেন শঙ্করাচার্য। পদ্ম নেতারা একে হিন্দু জাগরণ বললেন। আর এভাবেই ব্রিগেডের এক বিবর্তন দেখল সাধারণ মানুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.