১৯৬১ সালের ১৩ আগস্ট। পূর্ব জার্মানির (East Germany) মানুষ গভীর ঘুমে। কিন্তু একদল মানুষ নির্ঘুম। তাঁরা প্রাচীর নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। যে প্রাচীর পূর্ব জার্মানিকে পশ্চিম জার্মানি (West Germany)থেকে আলাদা করে দেয়। অসংখ্য পরিবারের সদস্যদের মুখদেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধুকে চিরতরে হারায় বন্ধু। প্রায় ২৮ বছর পর ভাঙা হয় বার্লিন প্রাচীর (Berlin Wall)। আবারও একত্র হন দুই জার্মানির মানুষ।
১৯৪৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করে জার্মানি। মিত্রশক্তির মধ্যে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধশেষে মিত্রশক্তির দেশগুলো জার্মানিকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিটি দেশ জার্মানির একটি করে অঞ্চলের দায়িত্ব নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স নেয় পশ্চিমাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ, আর পূর্বাঞ্চল দখলে রাখে সোভিয়েত ইউনিয়ন। জার্মানির রাজধানী বার্লিনের অংশ পড়ে পূর্বাঞ্চলে। তাই শহরটিকে চারটি অংশে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতিটি দেশ বার্লিনের একটি করে অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। পশ্চিম বার্লিন চলে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের হাতে আর পূর্ব বার্লিনের নিয়ন্ত্রণ নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন।
বার্লিন প্রাচীর
বার্লিন প্রাচীরের দৈর্ঘ্য ছিল ১৫৫ কিলোমিটার (৯৬ মাইল)। উচ্চতা ৪ মিটার বা ১৩ ফুট। ১৯৮৯ সালে ভেঙে ফেলা পর্যন্ত প্রাচীরে ৩০২টি ওয়াচ টাওয়ার (নজরদারি টাওয়ার) ছিল। দুটি সমান্তরাল দেয়ালের সমন্বয়ে প্রাচীরটি তৈরি করা হয়। দুটি দেয়ালের মাঝখানে একটি ফাঁকা অংশ রাখা হয়। এই অংশে সৈন্য মোতায়েন করা হত। শুধু তা-ই নয়, কেউ যাতে লুকিয়ে সীমান্ত পার না হতে পারেন, সে জন্য মাইন পুঁতে রাখা হত। দ্রুতই এই প্রাচীর ইউরোপের পশ্চিম ও পূর্ব অংশের বিভেদের প্রতীক হয়ে ওঠে। আয়রন কার্টেন বা লোহার পর্দা নামে যা পরিচিতি পায়।
বার্লিন প্রাচীরের পতন
সেদিন বার্লিন প্রাচীরের পশ্চিম পাশের মানুষ পূর্ব জার্মানির মানুষের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। এত বছর বিচ্ছিন্ন থাকার পর পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের জড়িয়ে ধরে সঙ্গে সঙ্গেই উৎসব শুরু হয়ে যায়। কেউ কেউ প্রাচীরের ওপর ওঠে নাচতে থাকেন।
বার্লিন প্রাচীরের পতন হয় ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর। তবে ওই দিন পুরো প্রাচীর একবারে ধ্বংস করা হয়নি। এরপর কয়েক সপ্তাহ ধরে অসংখ্য হাতুড়ি দিয়ে প্রাচীর ভাঙতে থাকেন মানুষ। তাঁরা প্রাচীরের টুকরাগুলো রেখে দেন। কারণ, প্রাচীরের টুকরাগুলো গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। জার্মান সরকার শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালে প্রাচীরটি ধ্বংস করে। তবে দর্শনার্থীদের পরিদর্শনের জন্য প্রাচীরের অনেক অংশ এখনো অবশিষ্ট হয়েছে। এরপর পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি একত্রীকরণ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। বার্লিন প্রাচীর পতনের ১১ মাস পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে মিলিত হয়ে আজকের পরিচিত জার্মানি রাষ্ট্র গড়ে তোলে।