বেলা বোস….. ভাবছেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মধ্যে বেলা বোস আবার কোথা থেকে এলো??…
এই বেলা বোস সেই বেলা বোস নয়, যার কথা আপনি ভাবছেন।
তিনি ভারত মায়ের এক বীর কন্যা, এক স্বাধীনতা সংগ্রামী, এক সমাজকর্মী বেলা বোস।
১৯২০ সালে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কোদালিয়া তে জন্ম তাঁর। পিতা ছিলেন সুরেশচন্দ্র বসু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর দাদা। আর এই বেলা বোস হলেন নেতাজির ভাইজি।
১৯৪০ সাল থেকে বেলা সক্রিয়ভাবে যোগ দেন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে। সেই সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেসের রামগড় অধিবেশন ত্যাগ করে বেরিয়ে আসেন। এর পরপরই হরিদাস মিত্র আজাদ হিন্দ ফৌজের গোপনচর দলের সদস্য হন। বেলাও স্বামীর সঙ্গে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে।
তিনি যোগ দেন ঝাঁসির রানি ব্রিগেডে, আজাদ হিন্দ ফৌজের মহিলা রেজিমেন্টে। কলকাতায় নিজের বাড়ি বানালেন এক গোপন আশ্রয়কেন্দ্র, যেখানে বাইরে থেকে আসা বিপ্লবীদের আশ্রয় দেওয়া হতো।
১৯৪৪ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবরে পর্যন্ত, বেলা পরিচালনা করেন আজাদ হিন্দ রেডিওর গোপন ট্রান্সমিটার। কলকাতা থেকে সিঙ্গাপুরে পৌঁছে যেত তাঁর পাঠানো সংকেত। প্রতিটি বার্তাই ছিল ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক তরুণী নারী নিজের হাতেই চালাচ্ছিলেন সেই বিপজ্জনক গোপন বেতারযন্ত্র—যেখানে ধরা পড়লেই শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।
১৯৩৬ সালে বিবাহ করলেন বিপ্লবী হরিদাস মিত্র কে, বেলা বোস হয়েগেলে বেলা মিত্র। এর পর দুজনেই ঝাপিয়ে পড়লেন দেশমাতৃকার সেবায়।
১৯৪৫ সালের ২১ জুন বজ্রাঘাতের মতো খবর এলো—হরিদাস মিত্র গ্রেফতার। ইংরেজ সরকার তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করল।
বেলা মিত্রের জীবন যেন মুহূর্তে অন্ধকার হয়ে গেল। কিন্তু তিনি হার মানলেন না। সরাসরি পুণেতে পৌঁছে তিনি মহাত্মা গান্ধীর কাছে আর্জি জানালেন স্বামীকে বাঁচানোর জন্য।
গান্ধীজি গভীরভাবে অনুরোধ জানালেন তৎকালীন ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়েভেলকে। অসংখ্য চিঠি, আবেদন আর চাপের ফলে অবশেষে ইংরেজ সরকার মৃত্যুদণ্ড রদ করে। শুধু হরিদাস নন, সঙ্গে মুক্তি পান আরও তিন বিপ্লবী—জ্যোতিষ বসু, অমর সিং গিল ও পবিত্র রায়।
ভারত স্বাধীন হলো ১৯৪৭ সালে। কিন্তু বেলার যুদ্ধ থেমে রইল না। তিনি গঠন করলেন একটি সামাজিক সংগঠন—ঝাঁসির রানি রিলিফ টিম, যার মাধ্যমে সমাজসেবামূলক কাজ চালাতে থাকলেন।
১৯৫০ সালে দেশভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে চলে এলো। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ালেন বেলা মিত্র। হাওড়ার ডানকুনির অভয়নগরে শুরু করলেন পুনর্বাসনের কাজ।
কিন্তু ভাগ্য তাঁকে দীর্ঘ জীবন দিল না। মাত্র ৩২ বছর বয়সে, ৩১ জুলাই ১৯৫২ সালে তিনি প্রয়াত হন। এক অগ্নিময় জীবন, এক অসমাপ্ত সংগ্রাম নিঃশব্দে শেষ হয়ে গেল।
তাঁর নাম অমর হয়ে রইল ভারতের রেল ইতিহাসে। ১৯৫৮ সালে হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইনের একটি রেলস্টেশনের নামকরণ করা হলো বেলানগর। এটি ছিল ভারতের ইতিহাসে প্রথম রেলস্টেশন, যেটি কোনো ভারতীয় মহিলার নামে রাখা হয়।
সুরজ মন্ডল


