(অ্যাভোকাডো চাষ নিয়ে এই সিরিজে, এই লেখকদ্বয়ের এটি দ্বিতীয় নিবন্ধ। পশ্চিমবঙ্গে কী অ্যাভোকাডো সাফল্যের সঙ্গে চাষাবাদ করা যাবে? পূর্ণ উত্তর খুঁজে পেতে এই সিরিজের সবকটি নিবন্ধের নিবিড়পাঠ করতে হবে।)
অ্যাভোকাডোর তিনটি টাইপ:
অ্যাভোকাডোর তিনটি টাইপ বা প্রকারভেদ রয়েছে — ১. ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান টাইপ (Persea americana var americana), ২. মেক্সিকান টাইপ (Persea americana var dryonifolia) এবং ৩. গুয়াটেমালান টাইপ (Persea americana var guatemalensis)। এরা যথাক্রমে ট্রপিকাল (ক্রান্তীয়, যে টাইপটি সর্বনিম্ন মাত্রায় ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে), সেমি-ট্রপিকাল (আংশিক ক্রান্তীয়, সর্বোচ্চ মাত্রায় ঠাণ্ডা সইতে পারে) এবং সাব-ট্রপিকাল (উপ ক্রান্তীয়, মাঝারি মাত্রায় ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারে)। প্রথম টাইপটি ফুল ফোটার পর ৬ মাসে পরিপক্ব হয়, দ্বিতীয়টি ৬ থেকে ৮ মাস এবং তৃতীয়টি ৯ থেকে ১২ মাসে পাকে। প্রথম ও তৃতীয় টাইপটি মাঝারি-বৃহৎ ফল দেয়, দ্বিতীয় প্রকারের ফলগুলি ছোটো। প্রথম দু’টি প্রকারে বীজের আকার বড় এবং বীজের গহ্বর আলগা, তৃতীয় টাইপে বীজের আকার ছোটো এবং গহ্বরে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত। প্রথম প্রকারে মসৃণ চর্মবৎ খোসা এবং তৃতীয় টাইপে খোসা মোটা এবং আঁচিলবৎ মোটা দানাদার গাত্র পরিলক্ষিত হয়। প্রথম টাইপে ফলের রঙ বেগুনি, তৃতীয় টাইপে সবুজ।
ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান টাইপের পরিচিত জাতগুলি হল: Pollock, Simmond, Black Prince, Fuchsia, Peterson. মেক্সিকান টাইপের পরিচিত জাতগুলির মধ্যে Gottfried, Duke এবং Pernod উল্লেখযোগ্য। গুয়াটেমালান টাইপের জাতিগুলির মধ্যে Taylor, Linda, Queen, Itsamma, Benik জনপ্রিয়।
অ্যাভোকাডোর বীজের গাছ:
অ্যাভোকাডোর অধিকাংশ প্রতিষ্ঠিত জাতগুলি এক একটা Chance Seedling. তা সত্ত্বেও বীজের তৈরি চারা সরাসরি লাগানো হয় না, তাতে মা-গাছের গুণ অপত্য উদ্ভিদে বজায় থাকে না। তাছাড়া বীজের চারায় ফুল-ফল আসতে ৫-৬ বছর সময় লাগে, কলমের চারায় পরের মরশুমেই ফুল চলে আসে৷ অ্যাভোকাডোর বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে সংকরায়ন ঘটিয়ে জাত বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। ভারতের ক্রান্তীয় থেকে নিকট ক্রান্তীয় অঞ্চলে গুয়াটেমালান টাইপের সংকর গাছ লাগানো হয়, কম ক্রান্তীয় অঞ্চলে গুয়াটেমালান এবং মেক্সিকান টাইপের সংকর জাত এবং সিকিম সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য মেক্সিকান ও গুয়াটেমালান টাইপের সংকর জাতের প্রচলন আছে।
অ্যাভোকাডোর জাত বৈশিষ্ট্য:
বিভিন্ন জাতের বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকম। Pollock হচ্ছে উর্ধে ধাবমান একটি জাত (Upright variety), এটি লবনাক্ততা সইতে পারার বৈশিষ্ট্য-সম্পন্ন। Fuerte হচ্ছে ছড়ানো জাত (Spreading variety). বিশ্বের সফল বাণিজ্যিক জাত Fuerte আমদানি হয়েছে মেক্সিকো থেকে, আর Hass জাতটি ক্যালিফোর্নিয়া থেকে আমদানি। Duke জাতের সিডলিং বা গুটির গাছগুলি শেকড় পচা রোগ-প্রতিরোধী হয়, এমনকি ঠাণ্ডা সইতে পারে।
ভারতে দীর্ঘদিন গুয়াটেমালা টাইপের Green এবং ওয়েস্ট ইণ্ডিয়ান টাইপের Purple জাত দুটি চাষ হয়ে আসছে। এখন এই দুই জাতের বীজ থেকে তৈরি এলাগাছের উপর পছন্দের পরশাখীর জোড়ের সম্ভবনা রয়েছে বলে জানা গেছে। অন্যান্য যে সম্ভাবনাময় জাতগুলির নাম আসছে, তার মধ্যে Fuerte, Pollock, Waldin, Nabal, Gottfried, Linda প্রভৃতি অন্যতম। ভারতে সম্প্রতি মুক্ত হওয়া অ্যাভোকাডোর উন্নত জাতগুলির মধ্যে Arka Supreme ২০২০ সালে এবং Arka Coorge Ravi ২০২২ সালে IIHR, ব্যাঙ্গালুরু থেকে রিলিজ হয়েছে৷ উভয় জাতের ফলন সক্ষমতা গাছ প্রতি ৮০ থেকে ১০০ কেজি। প্রথম জাতটি গুচ্ছাকারে ফলন দেয়৷ প্রথমটিতে ৬৫ থেকে ৭০ শতাংশ এবং দ্বিতীয়টিতে ৮০ শতাংশ শাঁস পাওয়া যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় জাতটির ফলের ওজন যথাক্রমে ৩৫০ এবং ৪৮৫ গ্রাম বলে উদ্ভাবকদের তরফে দাবী করা হয়েছে। ফলের আকার যথাক্রমে উপগোল এবং ডিম্বাকৃতি। ফ্যাটের মাত্রা যথাক্রমে ২০ ও ১৪ শতাংশ। মে-জুলাই মাসে এই জাতের ফল পাড়া হয়। ৬ মাসে ফল পরিপক্ব হয়। শাঁসে মোট দ্রবণীয় কঠিনের পরিমাণ ৬ ডিগ্রি বিক্সের কিছু বেশি। এছাড়া তামিলনাড়ু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের থাড়িয়ানকুড়িসাই হর্টিকালচার রিসার্চ স্টেশন থেকে উদ্ভাবিত TKD-1 জাতটি ঘনভাবে (৫x৫ মিটার দূরত্বে) চাষ করার জন্য উপযুক্ত। এটি উচ্চ বৃষ্টিপাত যুক্ত অঞ্চল এবং ঠান্ডা এলাকায় অর্থকরীভাবে চাষ করা যাবে বলে জানা যাচ্ছে। জাতটির ফলন উচ্চ, মাঝারি-উচ্চ গাছ, ফলের ওজন ৪২৫ গ্রাম, ফল ডিম্বাকার, খোসার রঙ ঘন সবুজ।

অ্যাভোকাডোর প্রজনন:
অ্যাভোকাডোর ব্রিডিং বা প্রজনন সাফল্য অন্যান্য ফলের চাইতে কম। নতুন জাত বৈচিত্র্যের অভাব। ফসল উন্নয়ন সময় সাপেক্ষও বটে। সংকরায়ন ঘটানোর পর বীজের গাছে ফল আসতে ৫-৬ বছর সময় লাগে। অ্যাভোকাডোর প্রজনন উদ্দেশ্য দ্বিবিধ: ১. সায়ন কেন্দ্রিক বা পরশাখী কেন্দ্রিক, ২. এলাগাছ বা রুটস্টক কেন্দ্রিক। অ্যাভোকাডোর প্রজনন উদ্দেশ্যগুলি এইরকম: ১. গাছবৃদ্ধির অভ্যাস হতে হবে উর্ধমুখী এবং কিছুটা প্রসারিত, ২. পরিবেশগত পীড়ন প্রতিরোধী গুণসম্পন্ন জাত উদ্ভাবন, ৩. প্রধান কীটশত্রু ও রোগ প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবন, ৪. দৃঢ়তার সঙ্গে বৃদ্ধিপ্রাপ্তি, উদ্ভাবিত গাছের জলদি ফলন, নিয়মিত ফলন এবং অধিক ফলন, সেই সঙ্গে ব্যাপক অভিযোজন যোগ্যতা, ৫. মাঝারি আকৃতির ফল, ৬. শাঁসের উত্তম গুণগত মান, ৭. ফসল পরিপক্ব হওয়ার পরও গাছে দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা, অর্থাৎ ফসল পাড়ার জন্য অনেকটা বেশি সময় পাওয়া (দীর্ঘস্থায়ী ফলন সম্ভাবনা), ৮. দ্রুত ফসল পরিপক্বতার গুণসম্পন্ন জাত উদ্ভাবন।
অ্যাভোকাডোর আদি বাসভূমি ও বিস্তারণ:
অ্যাভোকাডোর আদি বাসভূমি মধ্য আমেরিকা এবং মেক্সিকো। মেক্সিকো বিশ্বের সর্বোচ্চ অ্যাভোকাডো উৎপাদক ও রপ্তানিকারক দেশ। এরপর অ্যাভোকাডো উৎপাদনে নাম আসে চিলি, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কলোম্বিয়া, ব্রাজিল, পেরু ইত্যাদি দেশের। মধ্য এশিয়ায় সীমাবদ্ধ চাষ পরিলক্ষিত হয়, যেমন চীন, ভিয়েতনাম, কোরিয়া।
ভারতে সীমিত পরিসরে এখনও অবধি দক্ষিণের ট্রপিকাল বা গ্রীষ্মপ্রধান রাজ্য যেমন মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, কেরালা এবং তামিলনাড়ুতে চাষ হয়। চাষ হয় দক্ষিণের পালানি হিলস্, নীলগিরি, কোডাইকানাল, কোর্টালাম প্রভৃতি পার্বত্য অঞ্চলে। হিমালয়ের পাদদেশে, উত্তর-পূর্ব ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষত সিকিম রাজ্যে (পুরোটাই জৈবচাষ)। পার্বত্য অঞ্চলে ভূমিক্ষয় দূরীকরণের জন্য লাগানো হয়েছিল অ্যাভোকাডো। পাহাড়ি ঢালের ৮০০ থেকে ১৬০০ মিটার উচ্চতায় এই ফসলের চাষ হয়। শ্রীলঙ্কার মতো কৃষি-জলবায়ু অবস্থা দৃশ্য ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে। সেখানেও এই ফসল চাষ হতে পারে।
অ্যাভোকাডোর সর্বভারতীয় ট্রায়াল:
ICAR-এর তত্ত্বাবধানে সর্ব ভারতীয় সমন্বিত ফল গবেষণা প্রকল্প ২০২৩ সালে কর্ণাটকের চেট্টাল্লি গবেষণা কেন্দ্রের নেতৃত্বে একটি ভারতব্যাপী পরীক্ষা শুরু করেছে৷ ভারতের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫ টি কেন্দ্রে এই ট্রায়াল শুরু হয়। স্থানগুলি হচ্ছে — পাঞ্জাবের আবোহার, আসামের জোরহাট ও তিনসুকিয়া, পশ্চিম ত্রিপুরার লেম্বুচেরা, নাগাল্যাণ্ডের মেডজিফেমা, পশ্চিমবঙ্গের মোহনপুর, হিমাচল প্রদেশের নেরি, উত্তরাঞ্চলের পন্থনগর, গুজরাটের পারিয়া, তামিলনাড়ুর পেরিয়াকুলাম, বিহারের পুসা, ছত্তিসগড়ের রাইপুর, ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, তেলেঙ্গানার সাঙ্গারেড্ডি, মহারাষ্ট্রের ভেঙ্গুরলা। এইসব কেন্দ্রে ৬x৬ মিটার দূরত্বে আর্কা সুপ্রিম (Arka Supreme) এবং আর্কা কুর্গ রবি (Arka Coorg Ravi), TKA-1 জাতগুলি পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করা হয়েছে। ২০২৪ সালের ২৪ শে আগষ্ট তামিলনাড়ুর পেরিয়াকুলামে অনুষ্ঠিত হয় International Conference on Precisian Horticulture. এই কনফারেন্স দক্ষিণভারতে অ্যাভোকাডো চাষের সম্ভাবনা নিয়ে সুদীর্ঘ আলোচনা হয়।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: ICAR-AICRP on Fruits, Mohanpur Center, BCKV. প্রয়োজনীয় তথ্যসূত্র তৃতীয় পর্বে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। অ্যাভোকাডো গাছ ও পুষ্পবিন্যাসের ছবি ড. কল্যাণ চক্রবর্তীর নিজস্ব তোলা, ফলের ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।]
অস্মিতা চক্রবর্তী এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
